অভিনেত্রীটি অর্থাৎ আজকের মিসেস নন্দী এই ধরনের ভূমিকার সুপরিচিতা সেই আর্টিস্টই হবেন বোধ করি। কারণ, ছবি শেষ হতে অনেকের, বিশেষ করে স্বল্প মাসুলের দর্শকদের, অনেকরকম চটুল রসালো মন্তব্য শোনা গিয়েছিল। ছবির কষ্ট-কল্পিত আবেদনের থেকেও ছলা-কলাময়ী রমণী-যৌবনের সেই নির্মম স্থল দিকটার আকর্ষণ যাদের কাছে অনেক বেশি।
ছবিটা দেখার পর থেকে ডক্টর বসু সেই মনে-ধরা মেয়েটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগই আর রাখেন নি।
.
সাড়ে-তিনটের দু-পাঁচ মিনিট আগেই মিসেস নন্দী রিপোর্ট নিতে এলেন। শুকনো উদগ্রীব মুখ, আশায় আশঙ্কায় চাপা অস্থিরতা সুস্পষ্ট।
ডক্টর বসু নিঃশব্দে রিপোর্টের খামটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
খামটা হাতে নিলেন তিনি। চোখে কাতর প্রশ্ন, কি শুনবেন সেই শঙ্কায় সাহস করে মুখ ফুটে জিজ্ঞাসাও করে উঠতে পারছেন না। কিন্তু চুপচাপ ফিরে যেতেও পারলেন না শেষ পর্যন্ত।
–কি দেখলেন?—
আগের সেই প্রতিক্রিয়া আর অনুভব করছেন না ডক্টর বসু। বরং একটু বিচলিত বোধ করছেন।
–তেমন ভালো মনে হল না, আপনার ডাক্তারবাবুকে দেখান, তিনি বুঝবেন।
এক নিমেষে সমস্ত আশা যেন নির্মূল হয়ে গেল। স্থাণুর মতো মহিলা দাঁড়িয়ে রইলেন খানিক। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। নিঃশব্দ কান্না। নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
গাড়িটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত ডক্টর বসু ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন।
.
প্রায় বছরখানেক পরে।
ডক্টর বসু বাংলা ছবি দেখতে এসেছেন আবার একটা।
কতকাল বাদে সিনেমা দেখছেন ঠিক নেই। হঠাৎ আসেন নি, অবকাশ বিনোদনের জন্যেও নয়, কাগজে এক রমণীমূর্তির বিজ্ঞাপন আর নাম চোখে পড়তে এসেছেন।
বহুকাল আগের সেই গোছেরই একটা ভূমিকা। তবে এই ছবিতে কিছুটা আত্মত্যাগের মিশেল আছে। হাস্যলাস্যময়ী এক রমণী নিজের যৌবনের অস্ত্রে এক প্রবল প্রমত্ত পুরুষকে বশীভূত করে তার কোপ থেকে এক সাধারণ মানুষকে রক্ষা করছে। ওই সামান্য মানুষটিই একদা তার অনুরাগের পাত্র ছিল।
ছবির প্রগলভ মুহূর্তগুলিতে অনেক হাসাহাসি, স্থূল মন্তব্য, কটুক্তি এমন কি সামনের দিক থেকে শিসও শোনা গেছে। কিন্তু ডক্টর বসু নির্বিকার চিত্তে দেখে গেছেন, দেখার পরে তেমনি নির্বিকার মুখেই প্রেক্ষাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এবারেও চটুল উক্তি কানে এসেছে দুই-একটা। কে একজন তার তরুণ সঙ্গীকে কনুইয়ের গুতো দিয়ে বলছে-কেমন রঙ-ঢঙ দেখলি–একখানা পার্ট দেখালে বটে!
সঙ্গী পালটা উচ্ছ্বাস জ্ঞাপন করল–তার থেকেও চোখের ভাষা দেখেছিস? মাইরি, যেন কটকট করে।
ডক্টর বসু নির্লিপ্ত মুখে নিজের গাড়িতে এসে উঠলেন। তিনি কিছুই দেখেন নি। আর দেখে থাকলেও এরই মধ্যে সব মুছে গেছে। তার চোখে শুধু একটা দৃশ্যই লেগে আছে। সে-দৃশ্য তারই বাড়ির নিচের একটা ঘরের। ছেলের ব্লাড-রিপোর্ট হাতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে এক রমণী ঝরঝর করে কাঁদছে।
সেই মুখের সঙ্গে সকলের মায়ের মুখই খানিকটা করে মেলে বোধ করি।
ঝড়
খুব বেশি দিনের কথা নয়।
একদিনের মাত্র কয়েক ঘণ্টার প্রচণ্ড ঝড়ে শহর কলকাতার স্বাভাবিক জীবন যাত্রা লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। বড় বড় গাছগুলো শিকড় উপড়ে পথের ওপর মুখ থুবড়ে পড়েছে। পরদিন দেখে মনে হয়েছে যুদ্ধ-হত এক-একটা অতিকায় দানব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে অভিযোগ জানাচ্ছে। ভাঙা ডাল, ভেঁড়া তার আর উড়ন্ত টিনের চাল সরিয়ে চলাচলের পথ সুগম করতে এক সপ্তাহ লেগেছিল।
কিন্তু আমি সেদিনের কথাই বলছি। সেই প্রলয়-সন্ধ্যার কথা।
কাক চিল পটাপট মাটিতে আছাড় খেয়ে মরেছে। গাছ আর ভাঙা বাড়ি চাপ পড়ে অনেক লোক হতাহত হয়েছে। ট্রাম-বাস বন্ধ হওয়ায় বহু মেয়ে-পুরুষ পথে আটকে গেছে, আর ঘরে ফিরতে পারবে কিনা, সেই ত্রাস চোখ ঠেলে উঠেছে। যারা ভাগ্যক্রমে আগেই ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল তারা ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়েছে।
কিন্তু সেই সন্ধ্যাটাকে আমি প্রত্যক্ষভাবে দেখি নি। কিছু শুনেছি, কিছু অনুমান করেছি। বাড়িতে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে সকলে দুটো করে চোখ কপালে তুলে নিরীক্ষণ করেছে আমি সেই লোক কি না, আমার হাত-পাগুলো সব যথাযথ আছে কি না। আশঙ্কা কাটতে মা-ই প্রথম মুখব্যাদান করেছেন- তুই এর মধ্যে এলি কি করে, বিপদ-আপদ হয় নি তো? এদিকে যে কাণ্ড, ঠাকুর রক্ষা করেছেন
দুই এক কথায় সকলকে আশ্বস্ত করে কাণ্ড শোনার দিকে মন দিতে চেষ্টা করেছি। নিজেকে ভুলতে হলে, নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে হলে, অন্যের কথা মন দিয়ে শোনার মতো ওষুধ আর নেই। কিন্তু সে পারা বড় শক্ত। আমারও সহজ হচ্ছিল না।
ঝড় থেমে গেছে, তাই এরা ঝড়ের গল্প করতে পারছে। কার কত বড় ফাড়া গেল তার রোমাঞ্চকর বিবরণ কানে আসছে। বিপদ হতে পারত বই কি, খুব বিপদ হতে পারত।
কিন্তু আমার বুকের ঝড় এখনো থামে নি। দেহের সবগুলো স্নায়ুতে টান ধরে আছে। ওদের কথা শুনতে শুনতে সেগুলিকেই শিথিল করার চেষ্টা। সহজ হওয়ার চেষ্টা।
আমি তখন আকাশে ছিলাম।
একটা মালবাহী প্লেনে। যার পাইলট ক্যাপ্টেন সিং। যোগীন সিং। আর একটু বিস্তৃত করে বলা দরকার। কলকাতা থেকে কুচবিহার ট্রেনে প্রায় দুদিনের পথ, প্লেনে দেড় ঘণ্টার। খবরের কাগজের কাজে প্রায়ই তখন এদিকে আসতে হত। এই সূত্রে যোগীন সিংয়ের সঙ্গে আলাপ। মাসে চারবারও প্লেনে যাতায়াত করেছি। তাছাড়া দুই একবার আসাম বা বাগডোগরা থেকে ফেরার সময়ও যোগীন সিংয়ের প্লেন পেয়ে গেছি। ছোট একটা বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানের সর্বপ্রধান পাইলট যোগীন সিং। গোড়ার জীবনে তিন বছর মিলিটারীতে ছিল। সেই সুবাদে ক্যাপ্টেন। মিলিটারীর ওপরঅলাদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়াতে পার্মানেন্ট কমিশন পায় নি বা নেয় নি। প্রথম শর্তের মিয়াদ ফুরোতেই ছেড়ে এসেছে।