ব্যাগ রেখে ডক্টর বসু তার সামনে বসলেন। চোখের কোল টেনে পরীক্ষা করলেন, আঙুলের ডগা টিপে দেখলেন। একটুখানি আশ্বাসের আশায় তার মা সশঙ্ক নেত্রে চেয়ে আছেন অনুভব করলেন। যেমনটা তখনো খোঁজায় মগ্ন, তাকে ডক্টর বসু জোর করেই যেন এবারে কাজের দিকে ফেরালেন।
ব্যাগ খুলে ধীরে-সুস্থে কর্তব্য সম্পন্ন করলেন। রক্ত নেওয়া হল। ডক্টর বসু উঠে দাঁড়ালেন। এবারে মহিলার সঙ্গে চোখোঁচাখি হতে মৃদু গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করে বসলেন–আপনার নাম?
যেন রিপোর্ট লেখার জন্যই নামটা জানা দরকার।
–মিসেস নন্দী।
মিস্টার নন্দী কে বা কোথায় থাকেন জিজ্ঞাসা করাটা আর রিপোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত মনে হবে না। তাই জিজ্ঞাসা করা হল না, নইলে জানার ইচ্ছে ছিল।
মহিলা বিনীত অনুরোধ করলেন–ডাক্তারবাবু রিপোর্টটা যদি একটু তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়–যাবে না?
মায়ের এই কাতরতা আর উদ্বেগে তো ভেজাল নেই, তবু যেন কি দেখতে চেষ্টা করছেন ডক্টর বসু!
–তিনটে সাড়ে-তিনটেয় লোক পাঠাবেন।
–আমি নিজেই যাব, ওটা নিয়ে তক্ষুণি আবার–
বলতে বলতে ফীয়ের কথা মনে পড়ল। তক্ষুণি প্রায় ছুটেই ওধারের কোণের একটা টেবিলের ড্রয়ার খুলে কয়েকটা নোট হাতে ফিরে এলেন।–কত দিতে হবে। আমি তো
ডক্টর বসু জানালেন কত দিতে হবে। টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। বারান্দা, সিডি, সেই বসার ঘর, রাস্তা, নিজের গাড়ি। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে আর একবার দোতলার বারান্দার দিকে তাকালেন। কেউ নেই। ডক্টর বসু নিজের ওপরেই বিলক্ষণ বিরক্ত। হয়ত কিছুই না, নিছক একটা কাল্পনিক আবেগের ধকল চলছে সেই থেকে। আর, কিছু হলেও এ-রকম আবেগপ্রবণতা ডাক্তারের অন্তত থাকা উচিত নয়।
– বাড়ি ফিরে ল্যাবরেটারিতে ঢুকলেন। এই কাজটাই আগে সারবেন। কাজ নিয়ে বসলেন। তন্ময় হলেন। যত পরীক্ষা করছেন, মায়ের মুখ সরে গিয়ে ছেলেটার মুখই চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। বুকের ভিতরটা কেমন খচখচ করছে ডক্টর বসুর।
শেষ হল। তার পরেও চুপচাপ বসে রইলেন খানিক। তারপর রিপোর্ট লেখায় মনোযোগী হলেন। হাতে লেখেন না, ছাপা ফর্মে একবারে টাইপ করে ফেলেন। টাইপ শেষ হল। খামও টাইপ হয়ে গেল।…মায়ের মুখখানাই চোখে ভাসল এবার।
সঙ্গে সঙ্গে কোন মন্ত্রবলে চোখের সামনে থেকে একটা কালো পর্দা সরে গেল যেন। আশ্চর্য, এতক্ষণ এত হাতড়েও যার হদিস মেলে নি, এক মুহূর্তে তাই যেন দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ স্পষ্ট হয়ে উঠল। একটা ঘটনাস্রোত যেন পর পর চোখের সামনে দেখতে পেলেন ডক্টর বসু। খুব অভিনব ঘটনাও কিছু নয়, উলটে মামুলিই বলা চলে। কিন্তু যৌবনস্বরূপিণী রমণীর হিংস্র নির্মম প্রভাবটুকুই বোধ করি ওই ঘটনার অন্তরালে বুকের তলায় দুর্ঘটনার মতো চেপে বসেছিল ডক্টর বসুর। অবচেতন মন থেকে এতকালেও সেটা যায় নি।
দৃশ্যগুলো একে একে আবার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন যেন!…একটি মেয়ে, ওই মিসেস নন্দী, সেদিন কি তার পরিচয় সেটা আজ আর মনে নেই–জীবন বাস্তবে আর যৌবন-বাস্তবে এক পুরুষকে সে চেয়েছিল। চাইতে গিয়ে চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে কিছু ফারাক আছে, সেই প্রথম অনুভব করেছিল। একটা কটাক্ষে, একটুখানি ভঙ্গিতে, ঠোঁটের এক টুকরো বিলোল হাসিতে যে দুনিয়া জয় করতে পারে, এই পরাজয় আগুন হয়ে তার বুকের তলায় ধিকি ধিকি জ্বলছিল। যাকে পেল না তার সুখের ঘরে আগুন ধরাবার জন্য সেই জ্বালা সে সন্তর্পণে পুষেছে। তারপর আগুন ধরিয়েছে। কামনার নগ্ন পঙ্কিলতার মধ্যে সে একদিন সেই ভাগ্যহত পুরুষকে টেনে নামিয়েছে, নামিয়ে তারপর জাহান্নমের পথে ঠেলে দিয়েছে। পুরুষের অসহায় স্ত্রীটি ছেলে-কোলে করে তার কাছে এসে নতজানু হয়ে স্বামীকে ভিক্ষা চেয়েছে –ভিক্ষা মেলে নি। সুন্দরী রমণীর হিংসা, মাতৃত্বের সঙ্গেও তার আপোষ নেই।
সত্যি ঘটনা নয়, অবাস্তব বাংলা ছবি একটা।
কিন্তু এক যুগ আগে এই ছবি দেখেই ভিতরে ভিতরে ভয়ানক অস্বস্তি আর গ্লানি বোধ করেছিলেন ডক্টর বসু, তার ভিন্ন কারণ। রমণীর মাতৃত্ববোধশূন্য এই অসুন্দরের দিকটা এত দর্শকের মধ্যে শুধু তাকেই হয়ত বিশেষভাবে আঘাত করেছিল।
একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন তিনি। সিনেমা-টিমো বড় দেখেন না, কিন্তু নতুন বউ নিয়ে দৈবক্রমে সেদিন এই ছবিটাই দেখতে এসেছিলেন। আর দেখার পরে মনে হয়েছিল, এটা যেন তাঁর জীবনেই একটা কালো ছায়া বিস্তার করতে এগিয়ে আসছে।
প্রেম নয়, একটি মেয়েকে মনে ধরেছিল। ভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন গোত্রের মেয়ে। সুশ্রী, সপ্রতিভ, মিষ্টি মেয়ে। সেও তাঁকে অপছন্দ করত না। কিন্তু মা বেঁকে বসেছিলেন। মা-ছেলে দুজনারই অভিমান বড় কম নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলে আর বিয়েই করে না দেখে মা-ই প্রথম ভেঙে পড়লেন একদিন। কেঁদে ফেলে বললেন–তোর যাকে খুশি নিয়ে আয়, ঘর সংসার কর, আমি আর বাধা দেব না, বউ এলে আমাকে কাশী পাঠিয়ে দিস।
ডক্টর বসু তারপর বউ ঘরে এনেছেন। নিজের যাকে খুশি তাকে নয়, মায়ের যাকে খুশি তাকে। মা পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন–তোদের জীবন খুব সুখের হবে দেখিস।
ডক্টর বসু বিশ্বাস করেছিলেন, মায়ের কথার থেকে বড় কিছু নেই। অ-সুখেরও নয় তার সংসার।
কিন্তু সেদিন ওই ছবি দেখে একটা বড় রকমের নাড়া-চাড়া খেয়েছিলেন ডক্টর বসু। বিয়েতে সেই মেয়েও এসেছিল, হাসিমুখে উপহার দিয়েছে, অভিনন্দন জানিয়েছে, নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে। ততটা তো এগোন নি ডক্টর বসু, কোনোরকম দাগ পড়ার। কথা নয়। তবু সেই মেয়ের চোখ-দুটো এক-একবার যেন বেশি চকচকিয়ে উঠছিল মনে হয়েছে। কদিনের মধ্যে এই ছবির প্রতিক্রিয়া। যাকে একদিন মনে ধরেছিল তাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করতেন ডক্টর বসু। সেই শ্রদ্ধার মেয়েকে ছবির এই মেয়ে কেমন করে যেন গ্রাস করেছিল। ভীতি-বিহ্বল চোখেই ছবিটা দেখেছিলেন। শেষে ছেলে নিয়ে এসে ভিক্ষা চাওয়া সত্ত্বেও যখন আর এক রমণীর মাতৃত্ববোধ বড় হয়ে উঠল না, সেদৃশ্য আর যেন সহ্য করে উঠতে পারছিলেন না ডক্টর বসু।