ডক্টর বসু শুনলেন। মায়ের ব্যাকুলতা দেখলেন। সুন্দর মুখে একমাত্র ছেলের মৃত্যুর ছায়া কাঁপছে। ডক্টর বসুর মনে হল তবু মেয়েটি যুঝছে–ছেলে বাঁচবে না বিশ্বাস করতে চাইছে না, মুখের ওপর ওই ছায়াটাকে বসতে দিতে চাইছে না।
কিন্তু তবু এই আকুতি যেন মর্মস্থলে পৌঁছুচ্ছে না ডক্টর বসুর। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে, তিরিশ-বত্রিশের এই স্থিরযৌবনে দোলা লাগলে, এই সুন্দর মুখে হাসি ঝরলে, ওই টানা বিষণ্ণ চোখের গভীরে কটাক্ষের বিদ্যুৎ ঝলসালে কার সঙ্গে যেন মিলবে। যার স্মৃতি বাঞ্ছিত নয় আদৌ, যার স্মৃতি একরাশ বাষ্পীয় ক্ষোভের মতো অবচেতন মনের তলায় জমাট বেঁধে আছে।
কিন্তু কার স্মৃতি? ভেবে না পেয়ে ডক্টর বসু নিজেই অবাক!
-আপনি যান, আমি যাচ্ছি।
মহিলা এবারে হয়ত অন্যরকম আশা করেছিলেন। ভেবেছিলেন তার সঙ্গেই আসবেন। আবার অনুরোধের ভরসা না পেয়ে কাতর মিনতি-ভরা চোখে তাকালেন
-আপনি যান, আমার দেরি হবে না।
চলে গেলেন। গেট পর্যন্ত দেখা গেল। ডক্টর বসু দেখলেন। এই রমণীর চলা ফেরা, গাড়িতে ওঠা–মাধুর্য-ভরাই বটে। কিন্তু ডক্টর বসু তা দেখলেন না। মায়ের বিষণ্ণ করুণ মাধুর্য দেখলেন। আর, কি ঐক মস্ত মিলের মধ্যে ঠিক ততবড়ই একটা বিপরীত অমিল দেখলেন।
ডক্টর বসু মানুষটা বাইরে রুক্ষ হলেও নির্দয় নন আদৌ। বরং উলটো। তার কাজের নিষ্ঠা আর একাগ্রতা সুবিদিত বলেই বড় বড় ডাক্তাররা তার কাছে কেস পাঠান, তার রিপোর্টের ওপর অসংশয়ে নির্ভর করেন। যা শুনলেন, হাতের সব কাজ ফেলে তার তক্ষুণি ছোটার কথা, তবু উঠতে একটু দেরিই হল।
ডক্টর বসু ভাবছেন। ভাবা ঠিক নয়, অতীত হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। নিজের এমন। অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার দরুন নিজেই হতভম্ব তিনি। ছেলেবেলায় অবশ্য খুবই আবেগপ্রবণ ছিলেন। একটু কিছু হলেই ভিতরে ভিতরে চাপা অভিমানে গজরাতেন। বাবাকে মনেও পড়ে না। শুধু মা ছিল। এই মাকে ঘিরেই যত মান-অভিমান। অথচ দু-দণ্ড ওই মা চোখের আড়াল হলে অন্ধকার দেখতেন চোখে।
বিগত দিনের পরিচিত মুখগুলো মনে করতে চেষ্টা করলেন ডক্টর বসু। কিন্তু এই মুখ মনে পড়ছে না। তার পরিচিতের সংখ্যাও মুষ্টিমেয়, তাদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ নেই বললেই চলে। দিবারাত্র কাজে ডুবে থাকেন, সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দেবার ফুরসতও মেলে না। অনভ্যাসের দরুন এখন অবকাশ পেলেও যান না কোথাও।
কোনো পেশেন্টের বাড়িতে কেউ তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল কিনা ভাবতে চেষ্টা করলেন। দু-দশটা বাড়ি থেকে রোজই কল আসে। গিয়ে রক্ত নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু এই ঠিকানায় কখনো গেছেন বলে মনে পড়ল না।
এ-ধরনের স্থূল ব্যাপার কিছু নয়, ডক্টর বসু নিজেই ভালো জানেন। সামান্য ঝগড়া-বিবাদে বা কারো দুর্ব্যবহারে এ-রকম প্রতিক্রিয়া তাঁর হয় না। নিজের যে চাপা আবেগটাকে তিনি খুব ভালো করে চেনেন, সেটাই কোনো কারণে আঘাত খেয়ে জখম হয়েছিল। অন্যথায় এ-রকম হতে পারে না। কিন্তু ও-ভাবে আঘাত দেওয়া দূরে থাক, ওই মেয়েও তো জীবনে তাকে এই প্রথম দেখল মনে হয়। অথচ এমন বিরূপতার মূলে এই মেয়ের সঙ্গেই যে নিবিড় যোগ কোথাও আছে, ডক্টর বসুর তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।
ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে সচকিত হলেন। আরো আগেই ওঠা উচিত ছিল। তাড়াতাড়ি গাড়ি বার করলেন।
.
বাড়ির নম্বর মিলিয়ে গাড়ি থেকে নামতে প্রথমেই দোতলার দিকে চোখ গেল। বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকে মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তারই প্রতীক্ষায় উদগ্রীব মনে হল। চোখাচোখি হতে ওপরে উঠে আসতে ইঙ্গিত করলেন তিনি। নিজেও রেলিং থেকে সরে গেলেন।
বাঙ্গালী-অবাঙ্গালীর মিশেল অভিজাত এলাকা এটা। ছবির মতো ছোট বাড়ি। বাড়ির গায়ে শুধু নম্বর ছাড়া কারো নামের চিহ্ন নেই। ভিতরে ঢুকেও মালিকের রুচির পরিচয় মেলে। বসার ঘরের ভিতর দিয়েই ঢুকলেন তিনি। পরিপাটি করে সাজানো। সুপরিচিত শৌখিন আসবাবপত্র। দেওয়ালে অজ্ঞাত শিল্পীর দুই-একটা হালকা রঙিন ছবি। মেঝেতে পুরু নরম কার্পেট।
ডক্টর বসু এগিয়ে যাবার আগে তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য মহিলাটি নিজেই তরতর করে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে এলেন। তার আগে আরো একটি মাঝবয়সী রমণী সামনে। এসে দাঁড়িয়েছিল। খুব সম্ভব পরিচারিকা। কত্রীকে দেখে সে সসস্ত্ৰমে সরে দাঁড়াল।
আসুন ডাক্তারবাবু।
মহিলা আগে আগে ওপরে উঠতে লাগলেন। ডক্টর বসু তার দুই সিঁড়ি পিছনে। আবারও তাকে দেখামাত্র সেই অস্বস্তি, সেই বিরূপ অভিব্যক্তি। মনের এই অবস্থাটা যেন তার দখলের বাইরে। কোনো সুশ্রী মহিলার বাঁকা সিঁথি দেখলে এই রকম হয় কিনা। চিন্তা করে নিলেন। তক্ষুণি নিজেই আবার বাতিল করলেন চিন্তাটা। সিঁড়ি দিয়ে এভাবে নেমে আসা, ধীর পায়ে এভাবে ওঠা–এও যেন অচেনা নয়, অথচ তিনি চিনতে পারছেন না। তার চোখে এই তনুমাধুর্যও যেন অপরাধ।
ডক্টর বসু নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা করলেন। ভদ্রমহিলা ছেলের অসুখে চিন্তাগ্রস্ত, কাতর। আর তিনি কর্তব্যের ডাকে এসেছেন–এ-কথাই ভাবতে চেষ্টা করলেন। ওপরে উঠেও আরো জনা-দুই মেয়েছেলের মুখই দেখলেন, কোনো পুরুষের মুখ দেখা গেল না।
চারদিক খোলা একটা পরিচ্ছন্ন ঘরের মাঝামাঝি পুরু গদির খাটে রোগী শয়ান। সাত বছরের ফুটফুটে ছেলে। রোগের ধকলে বিবর্ণ, কিন্তু তাও সুন্দর। শিয়রের কাছে নার্স দাঁড়িয়ে।