আজ ভবানীবাঈ স্বামীর আরতি করবে।
একজন মিসেস নন্দী
মুখ না তুলেও ডক্টর বসু টের পেলেন আর একজন কেউ ঘরে এলেন।
ছোট মেয়েটার হাতসুষ্ঠু একটা আঙুল তাঁর এক হাতের থাবার মধ্যে। অন্য হাতে গ্লাস-স্লাইডে আঙুলের রক্ত লাগিয়ে নিচ্ছেন। মুখও চলছে। ছোট মেয়েটিকে ভোলাবার জন্যে অনেক হাসির কথা বলছেন। কিন্তু আঙুলে আচমকা পিনের খোঁচা খেয়ে আর রক্ত দেখে মেয়েটা ভরসা করে হাসতে পারছে না। ডক্টর বসু আর একটা গ্লাস-স্লাইডে ঘষে ঘষে এই স্লাইডের রক্তটা শুকিয়ে নিয়ে জোড়া-স্লাইড দুটো সামনের চামড়ার বাক্সের খুপরিতে রাখলেন। তারপর আগন্তুক দাঁড়িয়েই আছে মনে হতে ঘাড় ফেরালেন।
একজন মহিলা! বছর ত্রিশ-বত্রিশ হবে বয়েস।
এখানে অবারিত-দ্বার সকলের। পুরুষ আসে, মহিলা আসে–যার প্রয়োজন। সে-ই আসে। রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষা করানোর চার্জ এখানে কিছু বেশি। এই বেশিটুকু দেবার যাঁদের সংগতি আছে, বা কিছু বেশি দিয়েও যাঁরা সতোর ওপরে নির্ভর করেন।–তারাই আসেন। রোগের ব্যাপারে এ-রকম লোকের সংখ্যাই বেশি।
ডক্টর বসুর চকিত-বিভ্রান্ত, প্রায়-বিমূঢ় অভিব্যক্তিটুকু মহিলার পদার্পণের দরুন নয়। তার সামনেই তো আর এক মহিলা বসে। যে ছোট মেয়েটার রক্ত নিচ্ছেন, তার মা। ডক্টর বসুর পরিবর্তন এই একজনকে দেখেই।
-বসুন।
ঈষৎ ব্যগ্রমুখে মহিলা বলতে গেলেন–আমার বিশেষ একটু
-বসুন।
অর্থাৎ হাতের কাজ শেষ না করে তার শোনার অবকাশ নেই। ডক্টর বসু রাশভারী মানুষ। কম কথা বলেন। এক কাজের ফাঁকে আর এক কাজের কথা শুনে নেওয়ার অভ্যেস নেই। কিন্তু যেভাবে বললেন, নিজের কানেই বিসদৃশ লাগল। কণ্ঠস্বর ঈষৎ অসহিষ্ণু রূঢ় শোনাল। এমন কি, বাচ্চা মেয়েটির মাও একবার ফিরে নবাগতাকে দেখলেন।
বিব্রত মুখে মহিলা একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।
ধীরে-সুস্থে হাতের কাজ সারতে লাগলেন ডক্টর বসু। তিন জোড়া স্নাইডে রক্ত লাগানো, দুটো সরু টিউবে রক্ত টেনে আরকে মেশানো–এসব কাজে এমনই অভ্যস্ত যে চোখ বুজে করতে পারেন। অত গম্ভীর নিবিষ্টতায় সম্পন্ন করার মতো কিছুই নয়। আসলে মনটা তার এই কাজের দিকে নেইও। সুশ্রী রমণীটিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার অন্দরমহলে দুর্বোধ্য আলোড়ন শুরু হয়েছে একটা। তিনি কিছু স্মরণ করতে চেষ্টা করছেন। কিছু হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।– কোনো একদিনের কোনো এক পুঞ্জীভূত বিরূপতার উৎসে হঠাৎ নাড়া পড়েছে যেন। অথচ এই উৎসটার সম্বন্ধে তিনি সচেতন ছিলেন না আদৌ। এ-রকম বাত রাগের হেতু নিজেই জানেন না। নিজের অগোচরে স্মৃতির আয়নায় কোনো একখানি। মুখ ধরা আছে হয়ত। কিন্তু ধরা যে আছে সেটা অনুভব করলেন এই সুযৌবনা রমণীটিকে একনজর দেখে। দেখামাত্র একটা বিমুখ প্রতিক্রিয়া অনুভব করলেন। অথচ আশ্চর্য, কাজের ফাঁকে নিজের নিভৃতে বিচরণ করেও তিনি ওই স্মৃতি-তটে পৌঁছুতে পারলেন না। কিছুই মনে করতে পারলেন না ডক্টর বসু।
ঘুরে বসে আর একবার সুন্দর মুখখানা দেখার ইচ্ছে। সুন্দর কিন্তু সুবাঞ্ছিতা নয়। ঘুরে বসলেন না। দেখার অবকাশ এক্ষুণি মিলবে। কিন্তু কার সঙ্গে কাকে মেলাবেন মনে না পড়লে দেখে কি করবেন? মনে পড়ছে না।
হাতের কাজ সারলেন। সরঞ্জামগুলো চামড়ার বাক্সয় গুছিয়ে রাখলেন। ছোট মেয়েটার মায়ের কাছ থেকে ফী নিলেন। পেশেন্টের বাড়ি যেতে হলে ডবল চার্জ, এখানে এলে অর্ধেক। তাকে বললেন, বিকেলে লোক পাঠিয়ে রিপোর্ট নিয়ে যেতে। মেয়ের হাত ধরে মা চলে গেলেন।
ডক্টর বসু ঘুরে বসলেন।
…সেই রকমই দীর্ঘাঙ্গী স্বাস্থ্যবতী।…গৌর তনু, রূপসী…সেই রকমই ঢলঢলে মুখ। সেই রকম বাঁকা সিঁথি।
কিন্তু কোন রকম? কার মতো?
-হ্যাঁ, বলুন।
সুন্দর মুখখানি ভারি শুকনো, ক্লান্ত, উৎকণ্ঠাভরা। এই রূপের আড়ালে –অনেকদিনের একটা দুশ্চিন্তা যেন থিতিয়ে বেঁধে আছে। স্বল্প প্রতীক্ষার দরুন ঈষৎ অধীরও। বললেন–আপনাকে দয়া করে এক্ষুণি একবার আমার বাড়িতে আসতে হবে, আমার ছেলেটির
-বাড়ি কোথায়?-কথার মাঝেই বাধা পড়ল।
–বেশি দূর নয়, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে–
ডক্টর বসু চেয়ে আছেন। লক্ষ্য করছেন। বাঁকা সিথির ফাঁকে সিঁদুরের আঁচড়, কমনীয় ভুরু, টানা চোখ। বললেন–গাড়ি একটা আমারও আছে, আপনি বাড়ির ঠিকানা। বলে যান, যাব–
মহিলা থতমত খেলেন একটু। এ-রকম গম্ভীর নির্লিপ্ততার কারণ খুঁজে পেলেন না। ঠিকানা দিলেন। তারপর সানুনয় অনুরোধ করলেন–কেসটা খুব আরজেন্ট ডাক্তারবাবু, আপনার ব্লাড-রিপোর্টের ওপর আমার ছেলের প্রাণ নির্ভর করছে।
বলতে বলতে টানা চোখের কোণদুটো একবার কেঁপে উঠল বুঝি। সামলে নিয়ে বললেন–বড় ডাক্তার বিশেষ করে আপনাকে দিয়ে ব্লাড় করানোর কথা বলে দিয়েছেন
ডক্টর বসু প্যাথলজিস্ট। রোগীর চিকিৎসা করেন না। রোগের বীজাণুর হদিস দেন। কিন্তু এই কাতরোক্তি শুনেই হোক বা তাকে আর একটু বসিয়ে, আরো একটু লক্ষ্য করে কোনো ভুলে-যাওয়া স্মৃতির দরজা খোলার তাড়নাতেই হোক, জিজ্ঞাসা করলেন–কি হয়েছে?
মহিলা সাগ্রহে জানালেন কি হয়েছে। জানিয়ে যেন ভরসা পেতে চাইলেন। কিন্তু ডক্টর বসু যা শুনলেন সত্যি হলে ভয়ের ব্যাপার। সাত বছরের ছেলে। রক্তের শ্বেত কণিকা অসম্ভব রকম বেড়ে যাচ্ছে। লিউঁকিমিয়া। এই রোগ হলে বাঁচেই না বলতে গেলে। আগে অন্যত্র ব্লাড় করানো হয়েছিল। সেখানকার ওই রিপোর্ট ছিল। আজ আবার। একজন ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। তিনি একটু সংশয় প্রকাশ করেছেন, ওই রোগ নাও হতে পারে। অবিলম্বে তিনি আর একবার রক্ত-পরীক্ষা করাতে বলেছেন। আর বিশেষ করে ডক্টর বসুরই নাম করেছেন।