গাড়ি ছাড়তে ভবনাথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন–শ্রীবিলাস কি বলে গেল?
–ওই খাতাটার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে বলল।
ইতিমধ্যে কবি বা কবিতা প্রসঙ্গে আর একটি কথাও হয় নি। এখনো কিছু না বলে ভবনাথবাবু বাইরের অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। কিন্তু আমি চুপ করে থাকতে পারলুম না, ভেতরটা থেকে থেকে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। উষ্ণ হয়ে উঠছে।
সাদাসিধে ভাবেই জিজ্ঞাসা করলাম–খাতাটা চেয়ে নিয়ে এলেন কেন, সত্যিই কবিতা ছাপবেন নাকি?
ঈষৎ বিস্ময় মেশানো গাম্ভীর্যে আমার দিকে ফিরলেন তিনি।–এ কবিতা ছাপব কি করে?
-তাহলে নিয়ে এলেন কেন? ভদ্রমহিলা আশা করে থাকবেন, শ্রীবিলাসবাবুও তাগিদ দিতে ছাড়বে না।
নির্লিপ্ত মুখে ভবনাথবাবু জবাব দিলেন–কিছুদিন বাদে খাতাটা হারিয়ে যেতে দোষ কি?
আমি হতভম্ব কয়েক মুহূর্ত।
এতকাল ভদ্রলোকের প্রতি আমার শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না। কিন্তু সামান্য চক্ষুলজ্জা বাঁচানোর জন্য তিনি এই কাণ্ড করে এলেন মনে হতে সব যেন এক মুহূর্তে যেতে বসল। নিজের অগোচরে প্রায় রূঢ়কণ্ঠেই বলে উঠলাম, ভদ্রমহিলার সব কথা জানলে এভাবে তাঁকে আপনি
থেমে গেলাম। কেন, বা কি দেখে থামলাম জানি না।
ভবনাথবাবু বললেন, আসার সময় শ্রীবিলাস তোমাকে বলছিল, শুনছিলাম
আবারও বিস্ময়। অর্থাৎ, আসার সময় ট্রেনে তিনি আদৌ ঘুমোন নি। কনকদেবীর বৃত্তান্ত সব শুনেছেন।
আমি বিমূঢ় মুখে অপেক্ষা করছি। ভবনাথবাবু বাইরের অন্ধকার দেখছেন। শেষে আমার নীরব প্রতীক্ষা অনুভব করেই যেন মুখ ফেরালেন। বললেন–শুনেছি বলেই খাতাটা নিলাম। না নিলে আজ হোক, কাল হোক, মেয়েটির এই কবিতার আশ্রয়টুকও যেত। আমার হাত দিয়ে খাতাটা খোয়া গেছে শুনলে ভয়ানক দুঃখ পাবে, পাঁচজনের কাছে দুঃখের কথা বলবে, মনে মনে হয়ত আমাকে ঠিক বিশ্বাসও করবে না। …তবু তাতে সান্ত্বনা থাকবে, নিজের কাছে তার কবিতার দাম কমবে না। বরং বাড়বে। আবার নতুন খাতা হবে। আশ্ৰয়টা হয়ত আরো পাকাঁপোক্ত হবে।
.
ট্রেন ছুটছে।
দূরে দূরে এক-একটা ল্যাম্পপোস্টের আর কুঁড়েঘরের আলো চোখে পড়ছে। অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে ওগুলোও যেন এক অজ্ঞাত অখ্যাত কবি-রমণীর মুখের মতো। আঁধারে মেশে না।
ভবনাথবাবু জানলায় ঠেস দিয়ে চোখ বুজে বসে আছেন। সৌম্য, গম্ভীর। থেকে থেকে আমি তাকেও দেখছি। মনে হচ্ছে, এত কাছ থেকে আর বুঝি তাকে কোনোদিন দেখি নি।