ভবনাথবাবুর পায়ের কাছে মাথা রেখে প্রণাম করলেন। তারপর খাতাখানা তার পায়ের কাছেই রাখলেন।
আমার মনে হল, আত্মজ সন্তানকে পরম নির্ভয়ে গুরুপায়ে সমর্পণ করে দিলেন।
-বসুন মা, বসুন। ভবনাথবাবু গম্ভীর। সভয়ে তার মুখে সম্পাদকের সেই চিরাচরিত গাম্ভীর্য দেখছি আমি।
তিনি খাতাটা তুলে নিলেন। একটি একটি করে পাতা উল্টে দেখে যেতে লাগলেন। সকলে উন্মুখ। তার একটি কথা, একটি মন্তব্যের ওপর যেন অনেক কিছু নির্ভর করছে।
অনেকক্ষণ ধরে দেখে তিনি একটিও কথা না বলে খাতাটা শুধু আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
সেটা নেবার ফাঁকে মহিলার দিকে চোখ পড়ল। মনে হল, দুই চোখে এমন অধীর প্রতীক্ষা, এমন নীরব প্রত্যাশা, আমি আর দেখি নি।
পাতাগুলো শুধু উল্টেই গেলাম, পড়া হল না। আঁকা-বাঁকা কঁচা ছাঁদের লেখা, খাতা বোঝাই কবিতা। কংসের অত্যাচার, দেবকীর মনোবেদনা, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, বেহুলার শোক, গান্ধারীর বিলাপ, সাবিত্রীর সঙ্কল্প, লব-কুশের বীরত্ব–এমনি অজস্র প্রসঙ্গে এক পাতা দু পাতা করে এক-একটা কবিতা।
মুখ তুলতেই ভবনাথবাবু আবার হাত বাড়িয়ে খাতাটা নিয়ে নিলেন। অস্ফুট স্বরে বললেন–আশ্চর্য!তারপর একটা পাতার ওপর চোখ বুলিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি অক্ষর চেনেন না, অথচ কোন পাতায় কোন কবিতা আছে দেখলে বলে যেতে পারেন?
কনকদেবী যেন জীবনের সব থেকে বড় সংশয়টা উত্তীর্ণ হয়েছেন। অদ্ভুত কমনীয় দেখাচ্ছে মুখখানা। প্রত্যয়ভরা দুচোখ মেলে তাকালেন তাঁর দিকে, তারপর মাথা নাড়লেন।…পারেন।
–আচ্ছা, এই কবিতাটা বলুন তো শুনি।
ঈষৎ ঝুঁকে পাতাটা ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলেন কনক দেবী। ভবনাথবাবু খাতাটা এগিয়ে দিলেন।
কিন্তু তার আগেই কবিতাটা হয়ত চেনা হয়ে গেছে। আবার যথাপূর্ব স্থির হয়ে মহিলা মাথা নুইয়ে বসে রইলেন একটু। সংকোচ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও হতে পারে। ঘরসুদ্ধ সকলে উৎকর্ণ। আমিও।
টানা সুরের আবৃত্তি কানে এল। মৃদু কণ্ঠ ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল:
প্রহ্লাদ কহে, আমার অন্তর্যামী যিনি
সর্বত্র বিরাজেন তিনি।
শূন্যে জলে স্থলে সমুদ্রে পর্বতে।
তিনি বিনা কিছু নাই নিখিলে ভবেতে।
তারে যদি চাহ পিতা অশ্রুজলে ভাসি
তোমারে দিবেন দেখা মৃদু মৃদু হাসি।
দর্পভরে চাহ যদি দেখিবারে তারে।
দর্পহারী রূপে তিনি আসিবেন দ্বারে।
ভক্তসখা রূপে যদি নাও তারে বরি
দেখিবে সম্মুখে তোমার দাঁড়ায়ে শ্রীহরি।
ভাষা ভাব ছন্দ মিলের কথা কিছু মনে হল না, অনুচ্চ রমণীকণ্ঠের একটুখানি মূর্ত আবেগ যেন কানে লেগে থাকল। ঘরের জোড়া জোড়া মুগ্ধ চোখ এবারে ভবনাথবাবুর মুখখানাকে হেঁকে ধরল। তাদের উক্তি যে একবর্ণও মিথ্যে নয়, তাই যেন প্রমাণ হয়ে গেল।
ভবনাথবাবুও বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠলেন বোধহয়। কবিকে দেখলেন একটু। কনকদেবী অধোবদন।
ভবনাথবাবু বললেন–এই খাতায় নেই এ-রকম একটা কবিতা বলুন শুনি
অর্থাৎ, এইখানে বসে মুখে মুখে কবিতা বানানোর আশ্চর্য ক্ষমতাটুকুও যাচাই না করে নড়বেন না তিনি। কনকদেবী আবার মুখ তুললেন। আশায় আশ্বাসে তামাটে মুখখানা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। প্রথমবারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তার আস্থা বেড়েছে, আর এবারেও যে উত্তীর্ণ হবেন, তাতেও কোনো সংশয় নেই।
চোখ বুজে ভাবলেন খানিক। নিশ্চল মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। ঘরের মধ্যে আবারও একটা স্তব্ধতা ভরাট হয়ে উঠেছে। যারা চেয়ে আছে কবির দিকে, দেখলে মনে হবে পরীক্ষা তাদেরই। বেশ একটু সময় নিয়ে কনকদেবী চোখ মেলে তাকালেন। তিনি প্রস্তুত।
আগের বারের মতোই একটা আবেগ ঘরের মধ্যে পুষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। এবারের এই আবেগ জ্বালাভরা, বেদনাভরা, দরদভরা। একটা তীব্র অনুভূতি যেন কবির মুখে শিখা হয়ে জ্বলছে। তাই
..করজোড়ে নতশিরে অভিবারে সাজা।
মুনির সমুখে আসি দাঁড়াইল রাজা।
পুত্রশোকে মুনি কান্দে, কান্দে মুনিজায়া
কেমনে বাঁচিবে তারা–প্রাণ বিনা কায়া।
সহসা শোকানলে জ্বলি মুনি কহেন রাজারে
শব্দভেদী বান হানি শুধু হিংসা করিবারে
পানরত গজভ্রমে বধিলে সিন্ধুরে
রাঙাইলে সরযূর নীরে।
হারায়ে প্রাণের ধন।
এই প্রাণ মোর দিব বিসর্জন।
তোমা পরে রাজা এই অভিশাপ
তুমিও ত্যাজিবে দেহ লভি পুত্রশোক-তাপ।
অবাক বিষণ্ণ রাজা কাপে থর-থর।
নিঃসন্তানেরে একি অভিশাপ দিলা মুনিবর!
মুনি বরে অভিশাপ সত্য যদি হয়
সন্তান গেহে তবে আসিবে নিশ্চয়।
অনেকক্ষণ বাদে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন ভবনাথবাবু। সমাধি-ভঙ্গ হল যেন। কবিতা প্রসঙ্গে কোনোরকম আলোচনা করলেন না, ভালো-মন্দ একটি কথাও বললেন না। কিন্তু যে কথা বললেন, শুনে শুধু আমারই বিস্ময়ের শেষ নেই।
বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন ভবনাথবাবু, তারপর বললেন–আপনার এই খাতাটা আমাকে দেবেন? আপনার তো এটা কোনো কাজে লাগবে না, আমি দেখি যদি কিছু করতে পারি।
এক ঝুড়ি প্রশংসার থেকেও এই কটা কথার মূল্য বেশি। ঘরের সবকটি লোকের মনে যেন এক নীরব খুশীর তরঙ্গ বয়ে গেল। তৃপ্তিতে কৃতজ্ঞতায় কনকদেবী একটি কথাও বলতে পারলেন না। ভবনাথবাবুর পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করে আস্তে আস্তে উঠে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। কবিতার খাতা ভবনাথবাবুর হাতে।
.
যথাসময়ে আমরা আবার স্টেশনে পৌঁছলাম। শ্রীবিলাসবাব এবং আর একজন আমাদের। ট্রেনে তুলে দিয়ে গেল। শ্রীবিলাসবাবু আনন্দে ডগমগ, ট্রেন ছাড়ার আগে আমার কানে কানে আর একবার বলল, খাতাটার কথা ওঁকে মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেবেন কিন্তু, আমি পরে খবর নেব।