এমন কি, অতটা সচেতন বেশবাস, সুচারু প্রসাধন না করে এলে, বা ও-রকম হাসিমুখে তার আবির্ভাব না ঘটলেও হয়ত ছাপা হত।
সভাপতিত্ব করতে ডেকে এনে এ-হেন লোককে অক্ষরজ্ঞানবর্জিত রমণীর কবিতা শোনানো বা কবিতা ছাপার সুপারিশের নামে গায়ে জ্বর আসবে না তো কি?
গাঁয়ে নতুন পাঠাগার উদ্বোধন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য ভবনাথবাবুর আগমন। কোথাও আসেন না বড়। শ্রীবিলাসবাবুর ধড়-পাকড়ে পড়ে আমি বিশেষভাবে আবেদন। জানাতে তবে রাজী হয়েছেন। পাঁচখানা গ্রামের উদ্যোক্তারা অনেক জল্পনা-পরিকল্পনার। পরে এই সাধারণ পাঠাগার স্থাপন করতে চলেছে। সমস্ত এলাকায় আর দ্বিতীয় লাইব্রেরি নেই। এর জন্যে ঘরে ঘরে চাদা তোলা হয়েছে, একজন জমি দিয়েছেন, আর পাঁচজন অবস্থাপন্ন ভদ্রলোক মিলে ঘর তুলে দিয়েছেন। বেশ কিছু টাকার বইও কেনা হয়েছে। এতবড় ব্যাপারটা অনুষ্ঠানশূন্যভাবে শুরু করতে কারো মন ওঠে না। গ্রামবাসীদের এত উৎসাহের কথা শুনেই ভবনাথবাবু শেষপর্যন্ত আসতে আপত্তি করেন নি।
শ্রীবিলাসবাবু গায়ের ওই উদ্যোক্তাদের একজন। অনেক মাথা ঘামিয়ে আমার সঙ্গে একটা আত্মীয়তার যোগ আবিষ্কার করেছে সে। অবশ্য তার সঙ্গে জানাশুনা অনেক দিনের। কিন্তু সম্প্রতি তার আত্মীয়তা বজায় রাখার নিষ্ঠা দেখলে সম্পর্কটা দূরের কেউ বলবে না। গায়ে লাইব্রেরি করার উৎসাহ এবং উদ্দীপনার পিছনে তার ছোটখাটো রকমের একটু স্বার্থও আছে। ওই গায়ে তার বইয়ের দোকান। এতদিন শুধু ইস্কুল-বই বিক্রির ওপর নির্ভর করতে হত্ন। লাইব্রেরি হলে গল্প-উপন্যাস মাসিকপত্র। সাপ্তাহিকপত্রও তার মারফতই কেনা হবে জানা কথাই।
এখন প্রস্তাব শুনে আমার চক্ষুস্থির।
যথাসময়ে ট্রেন ধামুয়া স্টেশনে পৌঁছুলো। আরো জনাকতক লোক আমাদের নিতে এসেছে। সকলেরই ব্যস্তসমস্ত ভাব, সশ্রদ্ধ চাউনি। এদের সামনে শ্রীবিলাসবাবুকে দেখে মনে হল, সে যেন দিগ্বিজয় করে ফিরেছে।
প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরুবার সময় ভবনাথবাবুর উদ্দেশে মুখ কাচুমাচু করে বললাম –এখন আবার গরুর গাড়িতে উঠতে হবে শুনছি!
হৃষ্ট মুখে ভবনাথবাবু জবাব দিলেন, এখানে তুমি ট্রাম-বাস পাবে ভেবে এসেছিলে নাকি! এককালে কত গরুর গাড়িতে চড়েছি।
কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ছেলেরা আর শ্রীবিলাসবাবু টেনে-টুনে ভবনাথবাবুকে গাড়িতে তুলল। মোটা শরীর ভরনাথবাবুর, এটুকু ধকলেই অল্প অল্প হাঁপ ধরেছে। –কিন্তু তাঁকে এত খুশী আর বোধহয় দেখি নি। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে গরুর গাড়ি চলেছে, দুদিকে ধানী-জমি, মাঠ, গাছ-গাছড়া, ঝোঁপঝাড়। ভবনাথবাবু আমাকে গাছপালা চেনাচ্ছেন, আর শহুরে মানুষ বলে টিকা-টিপ্পনী কাটছেন।
–ওগুলো কিসের ঝোঁপ বলো তো? বনতুলসী–নাম শুনেছ, না তাও শোন নি? আর ওগুলো? শহুরে সাহিত্যিক জানবে কি করে–ওগুলো আটিশ্বরী।–শেষে আকন্দের জঙ্গল চিনতে পারলুম না দেখে প্রায় রেগেই গেলেন তিনি, বললেন তোমাদের শহুরে সাহিত্যিকদের ধরে ধরে কিছুকালের জন্য বনবাসের মতো গ্রামবাসে পাঠানো উচিত।
মোটকথা আমাকে জব্দ করতে করতে বেশ আনন্দের মধ্যেই তিনি গন্তব্যস্থানে এসে পৌঁছলেন। আমিও হাসছিলাম বটে কিন্তু বিকেলের কথা ভেবে শঙ্কার ছায়াটাকে মন থেকে সরানো যাচ্ছিল না।
গ্রামবাসীদের সরল অনাড়ম্বর প্রীতি-অভ্যর্থনা মনে লেগে থাকার মতো। দুপুরে খানিক বিশ্রামের পর সভার কাজ শুরু হল। শীতকাল, অসুবিধে কিছু নেই। ভবনাথবাবু বক্তৃতা করলেন। তার সাদা-মাটা আন্তরিক বক্তৃতা শুনে এই সাধারণ লোকেরা ভারি খুশী।
অনুষ্ঠান শেষ হল।
আমাদের ফেরার গাড়ি সেই রাত আটটায়। তার ওপর শোনা গেল, তিন চার ক্রোশ দূরের কোনো এক ভদ্রলোকের দুটো সাইকেল-রিকশ সংগ্রহ করা গেছে-তাই ফেরার সময় গরুর গাড়ির মতো অত সময়ও লাগবে না। এখান থেকে সাতটায়– বেরুলেও আমরা হেসে-খেলে পৌঁছুবো।
অতএব আপাতত ঘণ্টা দুই-আড়াইয়ের অখণ্ড অবকাশ।
কিন্তু এ অবকাশ আমি চাই নি। ভবনাথবাবুর বক্তৃতার ফাঁকেও আমার দুচোখ নিজের অজ্ঞাতে অক্ষরজ্ঞান-শূন্য সেই কবি-মহিলাকে খুঁজেছে৷ কিন্তু ভবনাথবাবুর পাশে মঞ্চে বসে ঠিক ঠাওর করতে পারি নি।
সভা শেষে লাইব্রেরি-ঘরে এসে আবার বসলাম আমরা। শীতের বিকেল শেষ হতে না হতে সন্ধ্যে। শুধু শ্রীবিলাসবাবু নয়, অন্যান্য মাতব্বররাও সাগ্রহে কনকদেবীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করল। মহিলার মুখে মুখে কবিতা বানানো তাদের কাছে মস্ত বিস্ময়! প্রশংসার ছলে সেই বিস্ময় জ্ঞাপন করল তারা, কবিতাগুলো একবার দেখার জন্য। সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালো।
ভবনাথবাবু বললেন–বেশ তো নিয়ে আসুন না, মহিলাটিকেও আসতে বলুন, দুই-একটা কবিতা শোনা যাবে।
তক্ষুনি লোক ছুটল।
আমার অস্বস্তি বাড়ছে। কবিতা প্রসঙ্গে অত স্তুতির বদলে এরা যদি মহিলাটির বেদনাকরুণ জীবনের আখ্যানটুকু শোনাতো, তাতে বরং কাজ হত। স্বভাবকঠোর সম্পাদকের মনটা হয়ত বা নরম থাকত। কিন্তু এরা জনে জনে শুধু মহিলার আশ্চর্য ক্ষমতার কথাই পঞ্চমুখে বলে গেল।
দশ মিনিটের মধ্যেই কনকদেবী এলেন। না, এঁকে সভায় দেখি নি বটে। সাধারণ আটপৌরে বিধবার বেশবাস। তামাটে গায়ের রঙ, এককালে বেশ ফরসা ছিলেন মনে হয়। বয়স পঞ্চাশের ওধারে, চাপা উদ্দীপনায় মুখখানি ঈষৎ আরক্ত। হাতে একখানি কালো মোটা বাঁধানো খাতা।