এখন যে সামান্য একটু জমি আছে, শ্রীবিলাসবাবুদের চেষ্টায় তারই চাষের সামান্য আয়ে কায়ক্লেশে কোনোরকমে দিন চলে কনকদেবীর। কিন্তু এই কষ্টের জন্য এতটুকু তাপ-উত্তাপ বা খেদ নেই তার। দিনান্তে কাউকে ধরে দু-চার লাইন কবিতা লেখাতে পারলেই খুশী তিনি, আর কিছু চান না।
–আপনারা, বিশেষ করে ভবনাথবাবুর মতো এমন একজন নামজাদা ব্যক্তি গাঁয়ে আসছেন শোনার পর থেকে ভেতরে ভেতরে খুব একটা উত্তেজনা চলছে ভদ্রমহিলার।
উত্তেজনার কারণ সভয়ে অনুমান করতে পারছি। তবু জিজ্ঞাসা করলাম–কেন?
-আপনারা আসছেন শুনেই উনি খাতাটা আপনাদের একবার দেখাবার জন্যে ধরেছেন যে।–শ্রীবিলাসবাবু মাথা চুলকে বলল–আমি কথা দিয়েছি চেষ্টা করব। সেই থেকেই তাঁর কখনো আনন্দ, কখনো ভয়। যখন ভাবেন আপনারা ভালো বলবেন, তখন খুশীতে ভরপুর, আবার যখন মনে হয় আপনাদের ভালো নাও লাগতে পারে, তখন ভয়ানক মুষড়ে পড়েন। শ্রীবিলাসবাবু নিজের মন্তব্য যোগ করল, আমরা অবশ্য তেমন বুঝি নে, তবু মনে হয় আপনাদের ভালোই লাগবে, আর সত্যি ভালো লাগলে কিছু সুবিধেও হতে পারে।
ভদ্রমহিলা অর্থাৎ কনকদেবীর প্রতি সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও মনে মনে। শ্রীবিলাসবাবুর মুণ্ডপাত করলাম। তার দিকে তাকিয়েই বোঝা গেছে, আমাদের যে ভালো লাগবেই এ-আশ্বাস সে মহিলাটিকে দিয়েছে, আর ভালো লাগলে যে দু-একটা কবিতা ছাপার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে সে কথাও নিঃসন্দেহে বলেছে।
নির্লিপ্ত গম্ভীর মুখে প্রস্তাবটা গোড়াতেই হেঁটে দিতে চেষ্টা করলাম।
-একদিনে এ-সব হবে-টবে না, অন্য একদিন দেখা যাবে, আজই এ-সব নিয়ে ওঁকে বলতে গেলে উনি অসন্তুষ্ট হবেন।
উনি অর্থাৎ ভবনাথবাবু। শ্রীবিলাসবাবু ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখল একবার। জানালার কোণে ঠেস দিয়ে তেমনি তন্দ্রামগ্ন। আবার আমার দিকে ফিরে মুখখানা করুণ করে ফেলল শ্রীবিলাসবাবু, যেন তারই কবি-মূল্য যাচাইয়ের প্রস্তাবটা নাকচ করা হল। সানুনয়ে বলল, ভদ্রমহিলা বড় আশা নিয়ে বসে আছেন স্যর, আপনারা এটুকু অনুগ্রহ না করলে ভারি হতাশ হবেন।
বিরক্তি গোপন করার জন্যেই বাইরের দিকে চোখ ফেরালাম। আমার বিরক্তি এবং অস্বস্তির কারণ শ্রীবিলাসবাবুর সঠিক বোঝার কথা নয়। এক নামী সাপ্তাহিক পত্রের ডাকসাইটে সম্পাদক ভবনাথবাবু। নিক্তির ওজনে লেখা বিচার করেন। লেখা ছাপার জন্যে কেউ সুপারিশ করতে এলে সেই লেখা না পড়েই বাতিল করেন। একান্ত পরিচিতজনেরাও এই রসকষশূন্য প্রায়বৃদ্ধ সম্পাদকটিকে রীতিমত সমীহ করে চলে। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে যত না নাম তাঁর, তার থেকেও বেশি সুনাম অথবা দুর্নাম, কঠিন সমালোচক হিসেবে। অনেক নামী সাহিত্যিকের লেখা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দেখেছি। আমরা লেখা না দিলে ঠাস ঠাস কথা শোনান, আবার দিলেও কপালে কি আছে ভেবে শঙ্কায় ভিতরটা ভরে ওঠে।
আমাদের ধারণা এ-দেশের মেয়েদের লেখার ব্যাপারে ভদ্রলোকের এক ধরনের অ্যালার্জি আছে। মনে হয়, মেয়েরা লিখবে সাহিত্য করবে, এটা বোধ হয় তার পছন্দ নয়। শুধু সংসার আর ঘর-করনা নিয়ে থাকুক তারা, মনে মনে এই চান হয়ত। তার নির্মম বিচারের ফলে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে মেয়েদের লেখাই বেশি জমে। লেখা কেন ছাপা হল না জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেন, লেখা হলে ছাপা হত।
ভদ্রলোক সবথেকে বেশি রেগে যান কোনো মহিলা লেখা নিয়ে নিজে তার দপ্তরে হাজির হলে। স্বল্প দুই-এক কথায় তাকে জানিয়ে দেন, ট্রাম-বাসের পয়সা খরচা করে না এসে, ডাকে পাঠিয়ে দিলেই তো হত।
একবার একজন আমতা আমতা করে বলেছিলেন–ডাকে পাঠালে লেখা অনেক সময় ঠিক জায়গামত পৌঁছয় না।
ভবনাথবাবু জবাব দিয়েছিলেন–নিজে নিয়ে এলেও জায়গামত পৌঁছয় না।
তিন-চারদিন আগেও এমনি একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। উত্তর-তিরিশ এক সুশ্রী মহিলা লেখা নিয়ে এসেছিলেন। তার ইচ্ছে, লেখাটা তখনই পড়ে দেখা হোক। লেখাটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ভবনাথবাবু জবাব দিলেন, পরে খবর পাবেন।
মহিলা চলে যেতে উল্টে-পাল্টে দেখতে গিয়ে লেখাটা পড়েই ফেললাম। সত্যি ভালো লেখা। আমার বিচারে অন্তত ভালো। দিন তিনেক পরে দেখলাম, ভবনাথবাবু সেই লেখাটা পড়ছেন। সব লেখা যেমন খুঁটিয়ে পড়েন এটাও তেমনি পড়লেন, তারপর পাশের আর কতকগুলো লেখার সঙ্গে সেটা রেখে দিলেন।
কিন্তু আরো তিন-চারদিন না যেতেই ভদ্রমহিলা আবার এসে হাজির। প্রত্যাশাভরা হাসি হাসি মুখ, সযত্ন বেশবাস, সুচারু প্রসাধন। ভবনাথবাবুর সামনে বসে ঈষৎ আব্দারের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন–আমার লেখাটা পড়লেন?
জবাবে ভবনাথবাবু মুখ তুলে দুই-এক মুহূর্ত দেখলেন, তারপর পাশের রচনাগুলোর মধ্যে থেকে তাঁর লেখাটা বার করে দিয়ে বললেন, নিয়ে যান।
মহিলার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।মনোনীত হল না বুঝি?
অন্য লেখা পড়তে পড়তে ভবনাথবাবু মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ, হল না।
শুকনো মুখে মহিলা আবেদন জানালেন-ত্রুটিগুলো যদি একটু বলে দিতেন
ভবনাথবাবু আবার মুখ তুললেন। খানিক নিরীক্ষণ করে জবাব দিলেন–সেটা বলা একটু শক্ত।
যে-রকম নির্লিপ্ত গাম্ভীর্যে বললেন কথা কটা, মহিলা হকচকিয়ে গিয়ে লেখাটি তুলে নিয়ে নীরবে প্রস্থান করে বাঁচলেন।
আমার বিশ্বাস লেখাটা ছাপা হবে বলেই ওখানে ছিল। মহিলা আবার তদবির করতে না এলে ওটা ছাপা হত।