বিষ্ণুচরণ আস্তে আস্তে ফিরল তার দিকে। চোখ দুটো অস্বাভাবিক চকচক করছে। বলল–তোর মা। আর, ওই তুই-মায়ের দুধ খাচ্ছিস।
দুজনেই নির্বাক। ছেলের থেকে বাপ অনেক লম্বা। মুখ তুলে মুখ দেখতে হয়। আজ এই বাপের মাথাটাই হঠাৎ এত উঁচুতে মনে হল শম্ভুচরণের যে ঘাড় উঁচিয়েও ভালো করে দেখা যায় না।
সম্পাদক
কলকাতা থেকে ট্রেনে উনিশ মাইল মাত্র পথ। শহরের এত কাছে এমন অজপাড়াগাঁও আছে জানতাম না। অবশ্য তখনো পর্যন্ত এসে পৌঁছুই নি আমরা। ট্রেনে বসে গাঁয়ের কথা শুনছিলাম। বক্তা শ্রীবিলাসবাবু। ট্রেনের ঝকানিতে ঝিমুনি আসছিল। তাই দেখে আমাদের চলনদার শ্রীবিলাসবাবু পান্সিক্ত ঠোঁটে একটু সঙ্কোচের হাসি মিশিয়ে বলল, আপনাদের কষ্ট হবে, এখনো দেড় ঘণ্টার পথ।
আমাদের কষ্ট হবে, এই কথাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানাভাবে অনেকবার বলেছে শ্রীবিলাসবাবু। অথচ তারই অনেক দিনের কর-জোড়ের আকুতিতে আমাদের পা বাড়ানো। কিন্তু আরো দেড় ঘণ্টার পথ শুনে অবাক হলাম। আধ ঘণ্টা হল ট্রেন ছেড়েছে, কিছুটা পথ এসেছিও। উনিশ মাইলের বাকিটুকু যেতে আরো দেড় ঘণ্টা লাগবে কেন!
জিজ্ঞাসা করলাম, কেন, দেড় ঘন্টা লাগবে কেন আরো?
জবাবে শ্রীবিলাসবাবু ভয়ে ভয়ে একবার কোণের জানালার দিকে তাকালো। ওই কোণে ঠেস দিয়ে স্থলবপু ভবনাথবাবু বসে। আজকের অনুষ্ঠানের তিনিই সভাপতি। তাকে নিয়ে যাবার জন্যেই শ্রীবিলাসবাবুর এতদিনের এত তোড়জোড়, এত কাকুতিমিনতি।
জানালা-ঘেঁষা কোণটায় পিঠ আর মাথা ঠেকিয়ে ভবনাথবাবু চোখ বুজে বসে আছেন। খুব সম্ভব ঘুমুচ্ছেন।
তবু গলার স্বর আর একটু খাটো করে শ্রীবিলাসবাবু অপরাধীর মতো টোক গিলে বলল, ইয়ে, আপনার গিয়ে তাই তো প্রায় লাগবে, ধামুয়া থেকে দেড় ক্রোশটাক তো আবার গরুর গাড়িতে যেতে হবে-তা আজ্ঞে আমি আপনাদের জন্যে খুব তেজি বলদের গরুর গাড়ি ঠিক করে এয়েছি, কিছু কমও লাগতে পারে।
এইবার আমি বেশ ভয়ে ভয়ে ওই কোণের দিকে তাকালাম। ভবনাথবাবু ঘুমিয়েই পড়েছেন, আপাতত কিছু কানে যায় নি হয়ত। কিন্তু ট্রেন থেকে নেমে তাঁর মুখের দিকে তাকানো শক্ত হবে। আমারই বিশেষ সুপারিশে তার আসা। একটু দমে গিয়ে। বললাম, গরুর গাড়ির কথা আগে বলেন নি তো?
এই অসুবিধের কথাটাও বলে ফেলার পর শ্রীবিলাসবাবুর সঙ্কোচ গেছে। এই রকমই রীতি তার। একবার ব্যক্ত করে ফেলার পর, ওটুকু অসুবিধে কিছুই না, বলে নিজেই আবার উড়িয়ে দেয়। বলল–তা আজ্ঞে ও তো প্রায় সবাই জানে–কিন্তু আপনাদের একটুও খারাপ লাগবে না, শহুরে মানুষ গরুর গাড়িটাড়িতে তো চড়েন না–ভালোই লাগবে।
অতএব সেই ভালো লাগার জন্যও মনে মনে প্রস্তুত হতে চেষ্টা করলাম।
গাঁয়ের প্রসঙ্গ ছেড়ে শ্রীবিলাসবাবু হঠাৎ একসময় সবিনয়ে নিবেদন করল, এবারে আপনারা সেই মহিলাটিকে একটু দেখবেন কিন্তু, আপনারা বিদ্বান পণ্ডিত লোক কি ব্যাপার ভালো বুঝবেন–
আমি অবাক–কোন মহিলা?
এ-রকম বিস্মৃতি শ্রীবিলাসবাবুর ভালো লাগল না বোধ হয়, ঈষৎ আহত বিস্ময়ে সে-ও ফিরে তাকালো আমার দিকে। তারপর স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করল–সেই যে কনকদেবীর কথা বলেছিলাম আপনাদের, কবিতা বলেন—
মনে পড়ল। সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে এক গ্রাম্য মহিলার প্রসঙ্গ শ্রীবিলাসবাবু দুই-একবার উত্থাপন করেছিল বটে। কিন্তু তার বলার আগ্রহের সঙ্গে আমাদের শোনার আগ্রহের। তেমন যোগ ঘটে নি বলে সবিস্তারে কিছু জানা হয় নি। শুধু এইটুকু মনে আছে, মহিলা লিখতে পড়তে জানেন না; অক্ষরপরিচয়ও নেই, অথচ তার মুখে অনর্গল কাব্য-ঝরে। শোনার মতোই কাব্য, গঁয়ের লোকেরা শুনে অবাক হয়।
বললাম–তা তাকে কি দেখব?
শ্রীবিলাসবাবু জবাব দিল–আমাদের শুনতে ভালো লাগে, এই পর্যন্ত আমরা কতটুকু আর বুঝি বলুন। আপনারা হলেন গিয়ে জহুরী, একনজর দেখলে বা দুলাইন শুনলেই কোন দরের জিনিস, ঠিক বুঝে নেবেন।
অক্ষরজ্ঞানবর্জিত মহিলার কবিতার পাল্লায়ও পড়তে হবে জেনে বিরক্তির বদলে অসহায় বোধ করতে লাগলাম। ট্রেনে যখন উঠে বসেছি, নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছুবার আগে নামার প্রশ্ন নেই। কিন্তু ফেরার সময়, আর ফেরার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত আমার ওপর দিয়ে দস্তুরমত একটা ধকল যাবে। অদূরের জানালায় তন্দ্রামগ্ন ভদ্রলোককে যেমন নিরীহ দেখাচ্ছে, আদৌ তেমনটি নন তিনি। তার রসনার পাল্লায় পড়লে অনেক হোমরাচোমরা ব্যক্তিও চুপসে যান। একটু আগে ভাবছিলাম, পরের দুর্ভোগ যা হয় হোক, আজকের সভাস্থলে মান বাঁচলে বাঁচোয়া। কিন্তু নিরক্ষরা রমণীর কাব্যাঘাতের সম্ভাবনায় সেই আশাও দূরে সরতে লাগল। মুখের ওপর সেখানে কি যে বলে বসবেন। ভবনাথবাবু, ঠিক নেই। যাদের এ অভিজ্ঞতা আছে, ভাবতে গেলে তাদের অন্তত গায়ে জ্বর আসার কথা।
শ্রীবিলাসবাবুকে সময়ে সতর্ক করে রাখা উচিত। কিন্তু সে অবকাশ মেলা ভার। সাগ্রহে কর্কদেবী প্রসঙ্গ বিস্তারে মন দিয়েছেন তিনি। যা বলে গেলেন তার সার কথা, গাঁয়ের এক মানী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের কন্যা কনকদেবী। পণ্ডিতের কথকতায় নাম ছিল খুব, শোনার জন্য পাঁচ গাঁয়ের লোক ভিড় করে আসত। ঘটা করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তিন বছরের মধ্যে একটি মাত্র সন্তান কোলে সেই মেয়ে বিধবা হতে পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি কিছুটা ম্লান হয়েছিল। বিধবা হওয়ার পর থেকে ছেলে নিয়ে কন্যাটি বাপের কাছেই থাকতেন। বাপের অবস্থা মোটামুটি সচ্ছলই ছিল, জমি-জমাও মন্দ রেখে যান নি। বাপ চোখ বুজতে পুঁজি ভাঙ্গিয়ে, আর কিছু কিছু জমি বিক্রি করে ছেলেকে মানুষ করে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন কনকদেবী।বড় আশা ছিল ছেলেটা মানুষের মতো মানুষ হবে। কিন্তু তা হল না। ছেলে উল্টে বিপথে পা বাড়ালো। তার মতি ফেরানোর জন্য মায়ের সেই বুক চাপড়ে কান্না, গোঁ ধরে একটানা দু-তিনদিন নিরস্তু উপোস করা–এ-সব শ্রীবিলাসবাবুরাই স্বচক্ষে দেখেছে, শুনেছে। ছেলে এখন উড়িষ্যায় কোন কারখানায় চাকরি করে। বিয়ে-থা করেছে, ছেলে পুলে হয়েছে–কিন্তু ভুলেও একবার মায়ের খোঁজ নেয় না, মাকে দেখতে আসে না। ছেলের ব্যবহার মায়ের বুকে শেলের মতো বিধত, পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতেন দিনরাত। কনকদেবী শ্রীবিলাসবাবুর থেকে বয়সে খুব বেশি বড় হবেন না, তবু শ্রীবিলাসবাবু তাকে মাসী বলে ডাকে। তার ছেলে সত্যবিলাস দিদিমা ডাকে। ছেলেটা খুব ছেলেবেলা থেকেই এই দিদিমার, নেওটা। তাকে ভোলাবার জন্য আর খুব সম্ভব নিজের শোক ভোলবার জন্যেই কনকদেবী অনেক সময় মুখে মুখে ছড়া পাঁচালি বলে যেতেন। ছেলে যত হাঁ করে শুনত, তার মুখে মুখে কাব্য-কাহিনী বানানোর ঝোঁকও তত বাড়ত। ছেলে বড় হতে তার বন্ধুবান্ধবেরাও কাব্যের শ্রোতা হয়ে পড়ল। এইভাবেই ব্যাপারটা রটে গেল। মুখে মুখে অজস্র কাব্যকাহিনী রচনা করেন তিনি, ছেলেমেয়ে বুড়ো-বুড়ীরা দল বেঁধে এসে শুনতে বসে। শোনে আর অবাক হয়। শ্রীবিলাসবাবুর ছেলে এখন ইস্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ে। সে দিদিমার একটা কাব্যের খাতা করেছে। দিদিমা কাব্য বলে, আর সে লেখে। কনকদেবী অক্ষর চেনেন না, কিন্তু কোন পাতায় কোন কবিতা লেখা আছে, একবার চোখ বুলিয়েই তা বলে দিতে পারেন। ওই খাতাখানাই এখন প্রাণ তাঁর। সত্যবিলাস বা লিখতে জানে এমন কেউ তাঁর ঘরে এলেই আদর যত্ন করে জলটল খাইয়ে মহিলা খানিকটা কবিতা লিখিয়ে নেন।