সুধারাণী বিশ্বাস করেছে আর সেই সব অদেখা সম্পাদকদের ওপর মনে মনে জ্বলেছে।
এই করেই একে একে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। কিন্তু সুধারাণী এখনও আশা ছাড়ে নি। আর সেই আশার তাগিদে এখনো মাঝে-সাজে নিকুঞ্জবিহারীকে কিছু না কিছু লিখতে হয়।
সুধারাণী যে এখনো আশা ছাড়তে পারে নি, তার একটা বিশেষ কারণ আছে। ইন্দিরার সঙ্গে এখনও মধ্যে মধ্যে দেখা হয়। সেই লেখকের সঙ্গেই তার বিয়ে হয়েছে। তাই দেখা হলে লেখার প্রসঙ্গ ওঠেই। বিয়ের পর অনেকদিন বাদে যখন প্রথম দেখা হয়, সুধারাণী তখনই তাকে ফিসফিস করে বলেছিল–এরও লেখার রোগ আছে রে!
ইন্দিরা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল তাই নাকি, কোন কোন কাগজে লেখেন, নাম-টাম দেখি না
ঢোক গিলে সুধারাণীকে বলতে হয়েছিল-সে-কথা আর বলিস না, আমি ছেড়ে বন্ধুবান্ধবরাও বলে, অত সুন্দর লেখা ছাপাও না কেন? তা ওর এক কথা, লেখার আনন্দের জন্যেই লিখি, ছেপে কি হবে
সুধারাণীর ধারণা, ইন্দিরা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অবিশ্বাস করেছে এবং ঠোঁট বাঁকিয়েছে। অতএব স্বামীকে লেখক বানাবার ঝোঁক সুধারাণীর এখনো কাটে নি।
স্ত্রীর এত আগ্রহ দেখে তলায় তলায় স্বামীরও বাসনা, দুই একটা লেখা অন্তত ছাপা হোক, মান-মর্যাদা বাঁচুক। তাছাড়া একটা লেখা ছাপা হয়ে গেলে স্ত্রীর কাছ থেকে যে উষ্ণ সমাদর লাভ হবে, তাও লোভনীয়।
চেষ্টা-চরিত্র করে একটা খবরের কাগজের রবিবাসরীয় সাহিত্যপত্রে শেষ পর্যন্ত একটা লেখা অনুমোদন করিয়ে ছাড়লেন তিনি। শুক্রবারের কাগজে রবিবারের লেখক সূচীর চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপন বেরোয়। সেই বিজ্ঞাপনে নিকুঞ্জবিহারীর নাম বেরুলো– রবিবারে তার অমুক নামে একটা সারগর্ভ রচনা থাকবে।
সুধারাণীর এতকালের আশা সফল। বাড়িতে সেই রাতে যেন নন্দনকাননের বাতাস বইল।
কিন্তু রবিবার হতেই মুখ একেবারে আমসি সুধারাণীর। লেখাটা বেরোয় নি। সম্পাদক লিখেছেন–যান্ত্রিক গোলযোগ বশতঃ নির্ধারিত সব লেখা এ সপ্তাহে প্রকাশ করা সম্ভব হল না।
স্ত্রীর মুখ দেখেই বেশী রকম আঘাত পেলেন নিকুঞ্জবিহারীবাবু। তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, কিছু একটা কারণে এবারে আটকে গেছে, লেখা মনোনীত হয়েছে। যখন সামনের বারে নিশ্চয় বেরুবে।
কিন্তু শুনে কিছুমাত্র আশ্বস্ত হল না সুধারাণী। তার সমস্ত মুখ বিবর্ণ পাংশু। একসময় সচকিত হয়ে দ্রুত উঠে চলে গেল সে।
সোম মঙ্গল দুটো দিন কাজের চাপে অবকাশ মেলে নি নিকুঞ্জবিহারীর। বুধবার স্ত্রীর এই কদিনের শুকনো মূর্তি স্মরণ করেই উক্ত কাগজের সাহিত্য-সম্পাদকের দপ্তরে হানা দিলেন তিনি, লেখাটা আগামী সপ্তাহে বেরুচ্ছে কি না, সেই খবর নিতে।
গম্ভীর মুখে সম্পাদক বললেন–ভেবেছিলাম বেরুবে। কিন্তু বেরুবে না, আপনার লেখা ফেরত নিয়ে যান।
নিকুঞ্জবিহারী বিমূঢ়।-কেন?
সম্পাদক তিনখানা পোস্টকার্ড তার চোখের সামনে তুলে ধরলেন। বললেন আপনার লেখা না বেরুতেই সেই লেখা সম্পর্কে পাঠকের কাছ থেকে তিনখানা প্রশংসাপত্র এসেছে-লেখা ছাপা হলে কি কাণ্ড হবে ঠিক কি!
হতভম্ব নিকুঞ্জবিহারী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে এলেন শেষ পর্যন্ত। ট্রামে বাড়ি ফেরার অবকাশে মাথা কিছুটা সাফ হল।
প্রথমেই স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কি করেছ?
সুধারাণী ঢোক গিলে অস্ফুট জবাব দিল।–কেন, আমি তো আবার তাদের চিঠি লিখে বারণ করে দিয়েছি।
তার দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিকুঞ্জবিহারী ঘরে চলে গেলেন।
সুধারাণী বুঝল যে ভয় করেছিল, তাই ঘটে গেছে। শুক্রবারের বিজ্ঞাপন দেখেই খুব অন্তরঙ্গ আত্মীয়-পরিজনদের পাঁচ-ছজনকে টেলিফোন করেছিল সে, আর কলকাতার বাইরে পাঁচ-ছখানা চিঠি লিখেছিল। লিখেছিল, তারা যেন রবিবার পেরুলেই অমুক কাগজে অমুক লেখার বিশেষ প্রশংসা করে সম্পাদককে চিঠি দেয়। বাইরে সেই কাগজ যদি নাও পায়, তাহলেও যেন চিঠি অবশ্যই সম্পাদককে পাঠায়–বিশেষ কারণ আছে পরে জানাবে।
এইভাবেই স্বামীর লেখার প্রতি সম্পাদকের বিশেষ দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে চেয়েছিল সুধারাণী। তাই রবিবারে সেই লেখা না বেরুতে মাথায় বাজ পড়েছিল তার। টেলিফোন যাদের করেছিল তাদের আবার টেলিফোনে নিষেধ করেছে। আর চিঠি যাদের লিখেছিল, মরিয়া হয়ে তাদেরও আবার নিষেধ করে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু বিভ্রাট যা হবার তা হয়েই গেছে।
সুধারাণী যেন আসামী। একটু ঠাণ্ডা মাথায় নিকুঞ্জবিহারী প্রশ্ন করে করে সব বার করে নিলেন। তারপর রাগের মাথায় ওই কথা বললেন। বললেন–তোমার জন্যে হয় আমাকে পাগল হতে হবে, নয়তো জঙ্গলে পালাতে হবে। এতই যদি অযোগ্য ভাবো, তাহলে কোর্টে ডাইভোর্সের জন্য দরখাস্ত করে দাও।
সুধারাণী দাতে করে ঠোঁট কামড়ে চোখের জল সামলাতে চেষ্টা করেছে। তারপর থেকে এই দশ-বারোদিন বাক্যালাপ বন্ধ।
.
কিন্তু নিকুঞ্জবিহারীর মাথা সত্যিই ঠাণ্ডা। এই ঠাণ্ডা মাথায় স্ত্রীর অগোচরে একটা গল্প লিখলেন তিনি। স্ত্রীর স্বপ্ন থেকে শুরু করে লেখা ছাপানোর এই বিভ্রাটের গল্প। লিখে এক নামী সাপ্তাহিকের সম্পাদকের হাতে দিয়ে এলেন।
গল্পটা সম্পাদকের এত পছন্দ হয়ে যাবে নিকুঞ্জবিহারীবাবুও আশা করেন নি। পরের সপ্তাহেই সেটা ছাপা হয়ে গেল এবং ডাকে কাগজ এল।
আড়াল থেকে স্ত্রীকে রুদ্ধশ্বাসে সেই লেখা পড়তে দেখেছেন তিনি। পড়া হতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।