কিন্তু ভাববার সময় নেই, ইন্দিরা জবাবের প্রতীক্ষা করছে। সুধারাণী সমঝদারের মতো তক্ষুণি মুচকি হেসে মাথা নেড়েছিল।
–কার সঙ্গে রে? কার সঙ্গে? বল না! আমি কাউকে বলব না।-ইন্দিরার উৎসুক চাপা আগ্রহ দেখে ভিতরে ভিতরে সুধারাণী ফাঁপরে পড়েছিল। কাউকে বলবে কি বলবে না এই সংশয়ের ফাঁকে সে একটু ভেবে নেবার সুযোগ পেয়েছিল। প্রেমে পড়তে হলে দ্বিতীয় একজন লোক দরকার, আর যতদূর মনে হয় পুরুষমানুষই হওয়া দরকার। আর, সেই পুরুষমানুষ খুব বড় কেউ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
-মাস্টার মশাইয়ের
শোনামাত্র ইন্দিরা একেবারে হাঁ। সুধারাণীর মাস্টার মশাইকে ইন্দিরাও জানে। ওদের বয়েস বারো, আর তিনি বাষট্টি।
সুধারাণীর কল্পনায় ভগবানের পরেই মাস্টার মশাই বড়। কিন্তু ইন্দিরার চোখমুখ দেখেই মনে হল তার জবাবটা বেখাপ্পা গোছের হয়েছে। তাই আরো জোর দিয়ে বলল–মাস্টার মশাই যে কত বড়, তুই ভালো করে জানিস না
–সে কী রে! একটা বুড়ে-হাবড়া, তুই ফাজলামো কচ্ছিস
ইন্দিরার কি মনে পড়ে গিয়েছিল। আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো করে বলেছিল –কেন শিব ঠাকুরও তো বুড়ো-হাবড়া, নামেরও মিল আছে–শিবশঙ্কর। ৬২৬
ইন্দিরা পেটে হাত চেপে হাসার উপক্রম করতেই সুধারাণী বুঝেছিল কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি ইন্দিরার একটু আগের সংশয়োক্তি, আঁকড়ে ধরল।
-আচ্ছা বোকা তুই, ঠাট্টাও বুঝিস না!
সেই ইন্দিরা কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়তে কলেজের থার্ড ইয়ার ফোর্থ ইয়ারের ছেলেগুলোরও মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সুধারাণী তখন নিঃসন্দেহ, রূপ ইন্দিরার থেকে তার কম নয়। কিন্তু ইন্দিরার চটকের কাছে কলেজের সব মেয়েই। প্রায় নিষ্প্রভ।
ওই সময়েই সুধারাণীকে একটা রোগে ধরল। ইন্দিরা তখন এক উঠতি তরুণ লেখকের প্রেমে পড়েছে। যার গল্প-উপন্যাস তারা ছাপার অক্ষরে পড়েছে। অনেক বড় বড় কাগজ যার লেখার সমালোচনা করছে, টাকা-টিপ্পনী কাটছে। যে তরুণ লেখককে একবার চোখের দেখা দেখতে পেলেও চক্ষু সার্থক হত, রক্ত-মাংসের সেই মানুষটারই কিনা প্রেমে পড়েছে ইন্দিরা! তার সঙ্গে বেড়ায়, সিনেমা দেখে, তার লেখা চিঠি ওদের দেখায়। সেই সব চিঠিও এক একটা জীবন্ত কাব্যের মতো। ভাগ্য আর কাকে বলে!
সুধারাণীর তখন মনে হত, প্রেমিক লেখক না হলে জীবনই বৃথা। যে দু-চারজন ছেলে অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠার আগ্রহে তার আশে-পাশে ঘুরঘুর করত, সুধারাণী তাদের। প্রতি কঠিন হয়ে উঠল। ওদের একটাও না লেখক, না কবি। রেস্টুরেন্টে বসে শুধু চপ-কাটলেট সাবড়াতে ওস্তাদ সব! তখন থেকেই এক তরুণ লিপি-যাদুকরের মূর্তি। মনের তলায় লালন করতে লাগল সে।
কিন্তু ইতিমধ্যে বাড়ির লোকেরা যেন ষড়যন্ত্র করেই একজনের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ। পাকা করে ফেলল তার। মা বাবা খুশী, ভালো জামাই সংগ্রহ করেছেন তারা। বর। কোন এক বড় সাহেবের পি-এ। ভালো মাইনে। কিন্তু ভাবী বরের নাম শুনেই দুই চক্ষু কপালে উঠল সুধারাণীর–নিকুঞ্জবিহারী! কোথায় ইন্দিরার মৃণাল বসু, আর কোথায় তার নিকুঞ্জবিহারী। শুধু এই নামের ধাক্কা সামলাতেই দিন কয়েক সময় লাগল সুধারাণীর। তারপর যুক্তি দিয়ে আশার আলো টানতে চেষ্টা করল সে। বড় বড় স্মরণীয় লেখক বা কবিদের নাম মনে করতে চেষ্টা করল-বঙ্কিমচন্দ্র, কালীপ্রসন্ন, প্যারীচাঁদ, হেমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর–নাম হিসেবে এগুলো এমন কি মিষ্টি নাম! অথচ এখন তো মনে হয় শুধু ওই নামেই মানায় ওঁদের। আসলে নাম কিছু নয়, গুণই সব। পি-এ যখন–সমস্ত দিন লেখালেখিই করতে হয়। লেখার অভ্যাস থাকলে গল্প-কবিতাই বা লিখতে পারবে না কেন?
সুতরাং বিয়ে হয়ে গেল। প্রথম দর্শনে স্বামীটিকে মোটামুটি মন্দ পছন্দ হল না সুধারাণীর। বেশ চোখা সপ্রতিভ চেহারা। বাসরের প্রথম সঙ্কোচ কাটতে সুধারাণী ঈষৎ আগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, তুমি লেখো?
নিকুঞ্জবিহারী অবাক।–না তো, কি লিখব?
-এই গল্প, কবিতা–যা হোক?
নিকুঞ্জবিহারী চালাক মানুষ। বাসরে স্ত্রীকে নিরাশ করতে মন সরল না। বললেন –এক কালে কলেজে থাকতে লিখতাম-টিকতাম, এখন আর অভ্যেস নেই–কেন। তোমার বুঝি ওসব খুব ভালো লাগে?
-খু-উব। অভ্যেস করলেই আবার লিখতে পারবে, তাছাড়া অফিসে তো কত কি লিখতেই হয় তোমাকে। একেবারে অভ্যেস নেই বলতে পারো না। কলেজের ম্যাগাজিনে তোমার লেখা ছাপা হত?
নিরুপায় নিকুঞ্জবিহারীকে মাথা নাড়তে হয়।-হত।
সুধারাণীর মুখে খুশী ধরে না।
পি-এর চাকরির দরুনই হোক, বা যে জন্যেই হোক, লোককে খুশী রাখার চেষ্টাটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে নিকুঞ্জবিহারীর। এরপর দিনে দিনে স্ত্রীর স্বপ্নের দিকটা চিন্তা করেই অফিসে বা রাতের নিরিবিলিতে একটু আধটু লিখতে চেষ্টা করেছেন তিনি। প্রথমে কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন। তারপর গল্প। তারপর প্রবন্ধ। সবই স্ত্রীকে দেখিয়েছেন। আর সুধারাণীর সবই অদ্ভুত ভালো লেগেছে। স্বামীকে না বলেই সেই সব লেখা সে ডাকটিকিট দিয়ে একে একে মাসিকে সাপ্তাহিকে পাঠিয়ে দিয়েছে– দিয়ে দুরু দুরু বক্ষে প্রতীক্ষা করেছে। বলা বাহুল্য সে-সব লেখাই আবার একে একে তার কাছে ফেরত এসেছে।
মান বাঁচাবার জন্য নিকুঞ্জবিহারী বলেছেন–এটা কোটারীর যুগ, দলে না মিশলে বা পেছনে লোক না থাকলে, না পড়েই মাসিক সাপ্তাহিকের সম্পাদকরা তা ফিরিয়ে দিয়ে থাকেন।