মেয়েটার দুই চোখে শুকনো মুখে আগ্রহের আলো জ্বলে উঠল যেন। গালের ক্ষতচিহ্নটার দিকে চেয়ে কি এক বিস্মৃতির পরদা আকুল আগ্রহে ছিঁড়েখুঁড়ে সরাতে চেষ্টা করছে সে। জিজ্ঞাসা করল–মেয়েটা কোথায়? হারিয়ে গেছে?
সদানন্দর না জানলেই নয়, সংশয় না, ঘুচলেই নয়। মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, তাই।
–কোথায় ছিল সে? কোথা থেকে হারিয়েছে?
সদানন্দর মনে হল, এমন মর্মছেঁড়া আকুতি সে আর দেখে নি। মনে হল, জীবনের সব সম্বল, সব আশা খুইয়ে এক মুমূর্য নারী যেন শেষ আশায় দুহাত বাড়িয়ে তাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে। সদানন্দ-নীরব। দেখছে।
–কি নাম ছিল তার? তার নাম কি…তার নাম কি…
আবার কি যেন স্মরণ করার প্রাণান্তকর চেষ্টায় চোখমুখ কুঁচকে গেল তার। তারপরেই উদ্ভাসিত হঠাৎ–তার নাম কি ঝুমুর?
একটা ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সদানন্দ। আত্মস্থ হল। দিশা ফিরল। কঠিন বাস্তবের ওপর দুই পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঠাণ্ডা নির্লিপ্ত মুখে মাথা নাড়ল। নাম ঝুমুর ছিল না। ঈষৎ রুক্ষ কণ্ঠে বলল–তুমি এ-রকম করছ কেন? আমার মেয়ে তো মরে গেছে–অনেক কাল আগেই মরে গেছে, বুঝলে?
মুহূর্তের মধ্যে সব আশা আর সব আগ্রহের অবসান হয়ে গেল। নিঃসাড় বিবর্ণ পাণ্ডুর মুখে মেয়েটা চেয়ে আছে তার দিকে। সদানন্দ আর অপেক্ষা করল না। কোথায় যাচ্ছিল ভুলে গেছে। দোকানেই ফিরে এল আবার।
তারপরেও মেয়েটা বার কয়েক এখান দিয়ে যাতায়াত করেছে। খুব সচেতন ভাবে নয়। চেয়ে চেয়ে দেখেছে। তাও আত্মবিস্মৃতের মতোই। তার যেন এখনো কিছু বুঝতে বাকি, জানতে বাকি।
.
রাত্রি।
আর একটু বাদেই দোকান গুটোবে তারা। বিষ্ণু সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল, কারণ দোকান বলতে গেলে আজ একাই চালাতে হয়েছে তাকে। এই ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকেও বাবার মুখের দিকে চেয়ে কেমন শঙ্কা বোধ করেছে। বাবার এমন অন্যমনস্ক গাম্ভীর্য আর যেন দেখে নি সে।
হঠাৎ রাস্তার ওধারে অদূরের পুকুরটার দিকে একটা গণ্ডগোল উঠল। লোকজন দৌড়োদৌড়ি ছুটোছুটি করতে লাগল। বড় রকমের উত্তেজনার কিছু একটা ব্যাপার ঘটেছে ওইখানটায়। ভিড় বাড়ছে, পুলিশও দৌড়চ্ছে দেখা গেল।
বিষ্ণুও ছুটল কি ব্যাপার দেখতে। বিশ পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে ফিরে এল আবার। দুচোখ কপালে তুলে বলল–বাবা, সেই বদমায়েস ইয়ে, সেই মেয়েটা জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে, তার লাশ তোলা হয়েছে দেখে এলাম–
– আরো কি বলতে গিয়ে বিষ্ণু বাপের মুখের দিকে চেয়ে থমকে গেল হঠাৎ।
সদানন্দ অন্যদিকে চোখ রেখে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে।
মন পবনের নাও
নিকুঞ্জবিহারীবাবুর একটা গল্প ছাপা হয়েছে। সেও কোনো হেঁজিপেজি কাগজে নয়। দস্তুরমতো নামজাদা এক সাপ্তাহিক-পত্রে। অদূরে ঘাড় গোঁজ করে তার স্ত্রীটি বসে আছে। নিকুঞ্জবিহারীবাবু সেইদিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। লজ্জায় সঙ্কোচে আনন্দে বিড়ম্বনায় স্ত্রী সুধারাণী মাটির সঙ্গে মিশতে পারলে বাঁচে।
এখন পর্যন্ত সুধারাণীর সঙ্গে নিকুঞ্জবিহারীর একটি কথাও হয় নি। গত দশ-বারো দিন দুজনার কথাবার্তা বন্ধ। তার আগে বড় মর্মান্তিক কথা বলেছিলেন নিকুঞ্জবিহারীবাবু। বলেছিলেন–তোমার জন্য হয় আমাকে পাগল হতে হবে, নয়তো জঙ্গলে পালাতে হবে। আর এতই যদি অযোগ্য ভাবো, তাহলে কোর্টে ডাইভোর্সের জন্য দরখাস্ত করে দাও।
কথাগুলো শেলের মতো বিধেছিল সুধারাণীর। নয় বছরের বিবাহিত জীবনে স্ত্রীকে এরকম শক্ত কথা আর কখনো বলেন নি নিকুঞ্জবিহারীবাবু।
এই কথার পরে কথাবার্তা বন্ধ।
সুধারাণীর বয়েস এখন আঠাশ। ছেলেবেলায় সকলেই তাকে বেশ সুশ্রী বলত। এখনো বলে। একটা মাত্র ছেলে। স্বাস্থ্যের বাঁধুনি এখনও ঢিলে হয় নি। ঢলঢলে কাঁচাভাবটুকু এখনো আছে। এরই দাক্ষিণ্যে একটা লোকের ওপর সুধারাণীর অনেক আধিপত্য খাটে বলেই বিশ্বাস। এবং দিনকে দিন তার এই আধিপত্য বাড়ছিল।
ব্যাপারটা আরো অনেক আগে থেকে বলা দরকার। সুধারাণীর বয়েস যখন এগারো বারো, তখন থেকে। তখন থেকেই পোড়ারমুখি ইন্দিরা তার শত্রু।
খুব সাদামাটা বুদ্ধির মেয়ে ছিল সুধারাণী। কোনো প্যাঁচ-ঘোঁচ বুঝত না। উঠতে বসতে বাড়ির লোক বোকা বলত তাকে। এই খেদে ইস্কুলে তার, চালাক হবার একটু চেষ্টা ছিল। বিশেষ করে ইন্দিরার কাছে। ইন্দিরার রূপ কোনাদিন তার থেকে বেশী ছিল বলে সে মনে করে না। কিন্তু চাল-চলন আচার-আচরণে সবাই সেরা রূপসী ভাবত, তাকে। এমনকি সুধারাণী নিজেও তাই ভাবত। ওই বয়সেই ইন্দিরা অনেক জানত, অনেক বুঝত, অনেক বিচিত্র কথা বলত, আর অনেক রকম ভু ভঙ্গিতে, হাসতে পারত। মোট কথা সুধারাণীর ভিতরে ভিতরে তখন থেকেই একটা ইন্দিরা-কমপ্লেক্স দানা পাকিয়ে উঠেছিল।
ওই বয়সেই কি জব্দই না হয়েছিল একবার ইন্দিরার কাছে। মনে পড়লে এখনো। লজ্জা পায় সুধারাণী। ইন্দিরা তখন থেকেই ছেলেদের আচার-আচরণ কিছুটা বুঝতে শিখেছিল। আভাসে ঠারেঠোরে অনেক কথা বলত সে। এমনি একটা প্রসঙ্গে চুপিচুপি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল–সত্যি করে বল তো, তুই কারো প্রেমে পড়েছিস?
শুনে সুধারাণী বাইরে ইন্দিরার মতোই মুখ টিপে হেসেছিল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটু বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। আসলে প্রেমে-পড়া ব্যাপারটা ঠিক যে কি, ভালো করে জানে না। অথচ প্রশ্নের ধরন-ধারণ কেমন যেন নিগূঢ়। প্রেম বলতে বাড়িতে মাস্টার মশাইয়ের কাছে ভগবানের বিশ্বপ্রেম সম্পর্কে ছোটদের একটা কবিতা। পড়েছিল সে-মাস্টারমশাই বুঝিয়েছিলেন, ভগবান এত বড় যে অতি ছোট অতি ক্ষুদ্রকেও তিনি অবহেলা করেন না।