মহেশকর ফৌজে চাকরি করে তখন, বিদেশেই থাকে। বীর-বংশের ছেলে বীরপুরুষই হয়–অল্প সময়ের মধ্যেই সে হাবিলদার হয়েছিল। সুযোগ সুবিধে পেলেই এবার বউকে নিয়ে আসবে ভাবছিল। তার মধ্যে এই দুর্ঘটনা। শুনেই দেশে ছুটল সে। তারপর চেষ্টাচরিত্র করে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বসল।
সকলেই প্রায় বউয়ের নামে ধন্য ধন্য করল তার কাছে। এমন কি মহেশকরের বাপ-মাও। কিন্তু দুই-একজন অতি নির্ভরযোগ্য পড়শী-বন্ধু তার কান বিষিয়ে দিয়েছিল। তারা আড়ালে জানালো রাণীবাঈ বৈধব্যযোগ খণ্ডন করার জন্য আত্মত্যাগ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তার আগে কার্তিক পূজো দেখে ফেলার অপরাধে শ্বশুর-শাশুড়ীর গঞ্জনাও বড় কম ভোগ করে নি। একমাত্র ছেলের শঙ্কায় তারা বউয়ের ওপর বিলক্ষণ ক্রুদ্ধ হয়েছিল।
দুনিয়ায় শুধু এই বাপের মুখের দিকে চোখ তুলে কখনও কথা বলে নি মহেশকর। এরপরেও বলল না। কিন্তু বাপের সঙ্গে একটা নীরব বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়ে গেল।
আবার বিয়ের কথা শুনে ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠল মহেশকর। বাধার আভাস পেয়ে কেশরকর জানিয়ে দিল, বিয়ে না করলে বাপের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। অতএব মহেশকর বাধা দিল না। সে চাকরি করে না, বর্ধিষ্ণু বাপের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচে গেলে তার চলবে না। এই সঙ্গে বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত সে আর আপত্তি করল না। কিন্তু বাপের সুনজরে পড়ে রাণীবাঈয়ের জায়গা দখল করতে যে মেয়েটা আসছে–সব রাগ বিদ্বেষ গিয়ে পড়ল তার ওপর।
এদিকে সকলের হাড় জুড়লো, কারণ তারা ভাবল যোগ্যে যোগ্য মিলন হয়েছে। যেমন বেয়াড়া মেয়ে, তেমনি মুগুর জুটেছে। আক্কেল হয়েছে।
মহেশকরকে এখনও ভয়ই করে সকলে। ওই ছেলে ফৌজে চাকরি না করলে, বা এভাবে প্রথম বউ না মরলে, তার দাপটে গাঁয়ে টেকা দায় হত বোধ করি। যেমন রগচটা তেমনি একরোখা! তবে ফৌজী দলে ছিল বলে, আর নিজেকে বীরপুরুষ ভাবে বলে, আগের সেই ছেলেমানুষি অত্যাচারের ঝোঁক গেছে। সমবয়সীরা এখন তাকে তোয়াজ করে চলে–গাঁয়ের খণ্ডোবার সঙ্গে তার তেজস্বিতার তুলনা দেয়। ঘোড়ায় আসীন অসি-হস্তি খণ্ডোবা হলেন দেশক্ষক দেবতা–মহাদেবের অবতার।
মদের গেলাসের ইয়ার-বন্ধুরা ঠাট্টা করল–স্বয়ং ভবানী আসছেন, এবারে কার দাপট বেশি দেখা যাক।…এরও তাৎপর্য আছে, ভবানী হলেন গ্রাম-রক্ষয়িত্রী দেবী –প্রতি গ্রামেই ভবানী-মূর্তি আছে।
আশা সফল হল। বিয়ের মাস না ঘুরতেই দেব-দেবীর খণ্ডযুদ্ধ বেধে গেল। একে তো কার জায়গায় এসে বসেছে নতুন বউ সেই হিসেব করে চলে না, তার ওপর চোখ রাঙাতে গেলে ফিরে যে-ভাবে তাকায়, তা বরদাস্ত করার মানুষ নয়। মহেশকর। তাছাড়া বাপ এনেছে বলে রাগ তো আছেই। ভ্রূকুটি গ্রাহ্য করে না বলে। হাত নিশপিশ অনেকদিন থেকেই করছে, কিন্তু সেদিন মৃতা রাণীবাঈ সম্পর্কে কি একটা উক্তি করে বসতে আর সহ্য হল না। হাতের লোহার মতো পাঁচটা আঙুল ভবানীবাঈয়ের গালের ওপর ফুটে উঠল।
হতভম্ব ভবানী অতিকষ্টে চোখের জল সামলালো। দাঁতে করে ঠোঁট কামড়ে খরচোখে মুখের দিকে চেয়ে রইল।
মহেশকর শাসালো, এই মুখে ফের ওই নাম আনবি তো মুখ একেবারে ভেঙে দেব।
সেই থেকে শুরু। ভবানী ওই নাম মুখে এনেও মার খেয়েছে, আর স্বামীর দাপটের ওপর দাপট করেও মার খেয়েছে। বউ শাসন করা একটা মনের মতো কাজ হয়েছে। মহেশকরের। আর ওই জেদী দুর্বিনীত মেয়েকে শাসন করার ব্যাপারে একটা সুবিধেও আছে। অত মার খেয়েও জোরে কাঁদে না, কাঁদেই না বলতে গেলে। আর শ্বশুরের কাছে নালিশও করে না। শ্বশুর বাড়ি না থাকলে সমান তালে রুখে ওঠে, ফলে আরো বেশি মার খায়। রাগে বিদ্বেষে ভবানীবাঈ এক-একসময় স্বামীর লোকান্তরিত প্রিয়া অর্থাৎ রাণীবাঈয়ের উদ্দেশেও কটুক্তি করে বসে। ফল কি হবে জেনেও করে। অন্ধ আক্রোশে কিল-চড় পড়তে থাকে তখন। ভবানীরও শক্ত সবল হাত আছে দুটো, যতক্ষণ সম্ভব যোঝে সে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে হয়। অমন অসুর শক্তির সঙ্গে সে পারবে কেন!
কিন্তু হাল ছাড়লেও হার মানে না। ফলে মহেশকরের বউকে শায়েস্তা করার গোঁ আরো বাড়ে।
এই পুরুষের রাতের নিভৃত বাসনার মুহূর্তগুলিও কেমন নির্মম হিংস্র মনে হয়। ভবানীর। মহেশকর জঠরে মদ ঢেলে বাসনার তাপ জুড়তে চেষ্টা করে প্রথম। এক-একসময় বিফল হয় যখন, তখনই শুধু কাছে আসে। আর আসে যখন, ভবানীর ওপর দিয়ে একটা বড় রকমের ধকল যায়। নিষ্ঠুর জড় পেষণের মতো লাগে। মায়ামমতাশূন্য পরপুরুষ কবলিত মনে হয় নিজেকে।
বছর না ঘুরতে কেশরকর হঠাৎ চোখ বুজল। মহেশকরের বউ শাসনের স্বাধীনতা আর একটু বাড়ল। এই করে আরো দুটো বছর কেটে গেল। স্বভাবের ধাত বদলায় নি কারো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে দুজনেই কিছুটা শ্রান্ত।
দোলের দিন সেটা। এখানকার যোদ্ধাবংশীয়রা এই দিনে ঘটা করে বীর-উৎসব। করে। মহেশকরের বাড়িতেও এই বীর-উৎসব বহুকাল ধরে চলে আসছে। এ সবে মহেশকরের উৎসাহ খুব। শিবপূজাতেও সে বীরের মতো শোণিত-সুরার অর্ঘ্য দেয়। মদের পাত্রে নিজের বাহু কেটে অনেকটাই রক্ত দিয়ে ফেলে। প্রথমবার তার রক্ত দেওয়া দেখে ভবানী ভিতরে ভিতরে একটু শঙ্কিত হয়েছিল।
হোলির সন্ধ্যায় অতিথি-অভ্যাগতরা এসেছে মহেশকরের বাড়িতে বীর-পূজায় যোগ দিতে। একটু আগে মদ খেয়ে আগুনের চারদিকে নাচ-গান করেছে সকলে। মেয়ে-পুরুষে আগুনের চারদিক ঘিরে বসেছে। এইবার মৃত বীর ব্যক্তিদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানানো হবে, তাদের যশের কথা, খ্যাতির কথা, বীরত্বের কথা বলে এই উৎসবে আবাহন করা হবে তাদের। বিশ্বাস, তাদের আত্মা আসে, এক-এক সময় কোনো একটি আত্মা এসে ভর করে তার পরিবারের বা অন্য কারো ওপর। ভর হলে মহা আনন্দের ব্যাপার। যার ওপর ভর হয়, সে অজ্ঞান হয়ে যায়। তার মুখ দিয়ে মৃত আত্মা তখন কথা বলে।