স্ত্রীর এক নিঃসন্তান বড় ভাই থাকত লাহোরে। তাদের তুলনায় বেশ অবস্থাপন্ন। দেশে কিছু হল না দেখে বিদেশে গিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল। খুব ছোট থেকে বড় হয়েছে। সে একবার পদ্মা পেরিয়ে এসে মাস খানেকের জন্য বোনের অতিথি। হল। মামার সঙ্গে ওই সাত বছরের মেয়ের ভারি ভাব হয়ে গেল। মিষ্টিমুখ মেয়েটা সকলেরই চোখে পড়ত। মামারও মন টানলো। বোনের অবস্থা দেখে নিজেই প্রস্তাব দিল, মেয়েটাকে সে নিয়ে যেতে পারে, মামীর কাছে মানুষ হবে, লেখাপড়া শিখবে। বছরে একবার করে না-হয় বাবা-মায়ের কাছে আসবে। আর তাহলে ভালো বিয়ে-থাও হবে মেয়ের।
স্ত্রী তক্ষুণি মেয়ে দেবার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠল। নিজেদের তো এমনিতেই দিন চলে না। মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লোভ সে কিছুতেই সামলাতে পারল না। তাছাড়া নিঃসন্তান অবস্থাপন্ন বড় ভাইয়ের সঙ্গে এ-রকম একটা যোগাযোগ স্থাপিত হলে আখেরে অনেক দিকে সুবিধে হতে পারে।
কিন্তু সদানন্দ খুঁতখুঁত করেছিল। বড় ছেলেটাকে এমনকি দুবছরের ছেলেটাকে নিতে চাইলেও হয়ত তাতে অত মন খারাপ হত না। কিন্তু স্ত্রীর ভয়েই শেষ পর্যন্ত বাধ সাধতে পারল না সে।
ওরা রওনা হবার দিন সকালেই বাড়ি থেকে পালাল। ফিরে আ তে স্ত্রীও মন খারাপ করে জানালো, যাবার আগে মেয়েটা নাকি হাপুস নয়নে কেঁদেছে আর বাবাকে খুঁজেছে।
এর তিন মাসের মধ্যে মাত্র কয়েকদিনের জ্বরে বড় ছেলেটা চোখ বুজল। আর ছমাসের মধ্যে সমস্ত দেশের শান্তি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। দেশ বিভাগের ফলে দেশের অগণিত মানুষের হৃৎপিণ্ড টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সমস্ত পরিবারটিকে টেনে হিঁচড়ে সদানন্দ যখন কলকাতায় এনে ফেলল, তখনো যেন বিকারের ঘোর কাটে নি। তখনো মনে হয়েছে কিছু একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে, এই নাড়ীছেঁড়া দুর্বিপাকের সবটাই সত্যি নয়।
স্নায়ুগুলো বশে আনতে অনেক সময় লেগেছে। এর ওপর জীবনধারণের রসদের চিন্তা করতে হয়েছে। আর, এরই মধ্যে এক একটা খবর কানে এসেছে। শুধু পূর্ববঙ্গে নয় অনেক জায়গাতেই মরণযজ্ঞের নরকোৎসব হয়ে গেছে। পাঞ্জাবে-লাহোরেও হয়েছে।
সম্বন্ধীর কাছে একে একে অনেকগুলো চিঠি লিখেছে সে, অনেক ভাবে খবর নিতেও চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা যেন দুনিয়া থেকেই মুছে গেছে। একটানা সোল বছরে তাদের একটা খবরও পায় নি।
.
দোকানের ওই অভিজাত এলাকায় মেয়েটাকে সে বিষ্ণুর আগেই দেখেছিল। মেয়ের সাত বছর বয়েসের সঙ্গে আরো ষোলটা বছর যোগ করে তাকে চেনার কথা নয়। সদানন্দ চেনে নি। এমন কি প্রথম দর্শনে বাঙালী মেয়ে বলেই মনে হয় নি তার। তাছাড়া, অবাঙালী সঙ্গীর সঙ্গেই ঘোরাফেরা করতে দেখছে তাকে। কিন্তু ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সদানন্দ চমকে উঠেছিল কেন? পদ্মাপারের সাত বছরের একটা মেয়ের। স্মৃতি বুকের তলায় আকুলি-বিকুলি করে উঠেছিল কেন?
আশ্চর্য! সদানন্দ জানে না কেন।
এখনো একটুও নিঃসংশয় নয়, হয়ত একটা উদ্ভট কল্পনা নিয়েই আছে সে। তবু মোহগ্রস্তের মতো নিজের অগোচরে ওই মেয়ের অনুসরণ করেছে, তার পিছু পিছু ঘুরেছে; ওর অসুন্দর জীবনযাত্রার চিত্রটি কল্পনা করে এক অস্বাভাবিক বেদনায় শ্বাস রুদ্ধ হয়েছে। তারপর কতবার সঙ্গীর সঙ্গে ওই মেয়ে পাশের সোডা-লিমনেডের দোকানে এসে দাঁড়িয়েছে, তার এখানেও এসেছে, দাম না দিয়ে কলম নিয়ে চলে গেছে, আর মানিব্যাগ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছে। নিজের সঙ্গে অনেক যুঝেছে সদানন্দ, যুঝেছে আর ভাবতে চেষ্টা করেছে, সবই তার আজগুবী কল্পনা, নিছক মিথ্যে।
দুপুরের মধ্যে মেয়েটা অনেকবার দোকানের পাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করে গেল। আজ আর অত প্রসাধন নেই। মুখে চোখ-তাতানো সাজসজ্জা নেই। কি এক অমোঘ আকর্ষণেই মেয়েটা যেন বার বার এই ফুটপাথ দিয়ে আসা-যাওয়া করছে। আর, প্রতিবারই খুব ভালো করে লক্ষ্য করছে সদানন্দকে। কিন্তু ভরসা করে কাছে আসছে। না, আসতে পারছে না।
সদানন্দ সমস্ত মুখ থমথমে গম্ভীর। তার গালের একটা দিক ওই মেয়েটার দৃষ্টির ঘায়ে কটকট করে উঠছে–যেখানে পুরনো পোড়ার বড় ক্ষতচিহ্ন রয়েছে একটা। সাত বছরের মেয়ে সারি করে বাপের তামাকের জ্বলন্ত কলকেয় ফুঁ দিতে নিয়ে এসেছিল। সদানন্দ শুয়েছিল তখন। গরম সামলাতে না পারার দরুন সেই আগুনসুদ্ধ কলকে বাপের গালের ওপর পড়েছিল। একটা মস্ত অঘটনই ঘটে যেতে পারত। মা মেয়েটাকে মেরে একেবারে আধমরা করেছিল সেদিন।
ছেলে বিষ্ণু সকাল থেকে বারকতক মেয়েটাকে লক্ষ্য করেছে, আর আড়ে আড়ে বাপকে দেখছে। আজও মেয়েটার ওপর মনে মনে জ্বলছে সে।
দুপুরে সদানন্দ উঠে বড় রাস্তার ওধারের পুকুরটার দিকে চলল। রোজই দুপুরে সেখানে গিয়ে গাছের ছায়ায় খানিক বসে জিরোয়। মাছ-ধরা দেখে, কখনো বা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়।
বাধা পড়ল। মেয়েটা আজও যেন তার প্রতীক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। এখনো খায়। নি বোধ হয়। মুখ শুকনো। কিন্তু শুকনো মুখেও কি এক আশার তাড়না স্পষ্ট যেন। সদানন্দ দাঁড়িয়ে গেল, পায়ে পায়ে মেয়েটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
সামনে এসে দ্বিধা কাটিয়ে মেয়েটা বলল–আপনি কাল আমাকে বাঁচালেন কেন? আমি তো সত্যি পার্সটা চুরি করেছিলাম…।
সদানন্দর জানা দরকার, সদানন্দর বোঝা দরকার কতখানি উদ্ভট কল্পনায় ডুবে আছে সে। মেয়েটাকে খুব ভালো করেই দেখল। দেখে আঁতকে উঠল। ঘষা মোছা প্রসাধনের আড়ালে যেন এক আর্তনারী সম্বল খুঁজছে–আশ্বাস চাইছে। মুখে বলল–আমার একটা ছোট মেয়ে ছিল, মনে হয়েছে, বড় হলে সে তোমার মতোই হত–এই জন্যে।