আজ আবার সেই মেয়ে যখন মেয়েদের শৌখিন পার্সগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করছিল –বিষ্ণু তখন থেকেই মনে মনে প্রস্তুত। সে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাবা পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে অন্য কাজ করতে লাগল বলে বিষ্ণুর মনোযোগ অত প্রখর। কিন্তু চেয়ে ছিল আর একদিকে, এই শ্যেন প্রতীক্ষা বুঝতে দিতে সে রাজী নয়। তারপর মেয়েটা পা বাড়াবার উপক্রম করতেই এক লাফে উঠে এসে সরাসরি হাত চেপে ধরেছিল। তার।
-দাম না দিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছেন যে? দুটাকা বারো আনা দাম ওটার, অমনি নেবার জন্যে নয়–
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার পুরু প্রসাধন-খচিত মুখও বিবর্ণ। বিড়ম্বনার ভাব কাটাতে চেষ্টা করে শুকনো ব্যস্ততায় বলল–দাম দিই নি বুঝি, ভুল হয়ে গেছে।
তাড়াতাড়ি ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে দাম দেবার জন্যে তার মধ্যে হাত পুরে দিল। কিন্তু শূন্য হাতটাই উঠে এল আবার। এবারের বিস্ময় আরো শুকনো, আরো শঙ্কামিশ্রিত। এই যাঃ, নোটটা…আশ্চর্য, নোটটা তো
-নোটটা হাওয়া হয়ে উড়ে গেছে। সেদিন আমাদের চার টাকা দামের কলমটাও অমনি খোয়া গেছে আপনার হাতে, ওসব চালাকি রেখে দামটা গুনে দিয়ে। যান–
অন্যান্য খদ্দেররা উৎসুক হয়ে উঠেছিল। আর দু-পাঁচজন দাঁড়িয়েও গিয়েছিল। এরই মধ্যে বাবার ওই আচমকা গর্জন, আর ওই মূর্তি
.
রাত হয়েছে, আর একটু বাদে দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরবে তারা। সদানন্দ এতক্ষণ। বাদে ছেলের দিকে তাকালো হঠাৎ। মোলায়েম করে জিজ্ঞাসা করল–কি রে রাগ। হয়েছে খুব?
বাবাকে আজ বেশ কিছুদিন ধরেই বিমর্ষ, চিন্তাচ্ছন্ন দেখছে সে। ঘণ্টা আড়াই আগে আজ ওই ব্যাপার ঘটে না গেলে তার মুখের নিবিড় বেদনার ছায়াটাই হয়ত বিষ্ণু আগে লক্ষ্য করত। ওধারের টুল থেকে সে বাবার দিকে থমকে চেয়ে রইল একটু, তারপর ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করল–মেয়েটা টাকা দিয়েছিল?
সদানন্দ মাথা নাড়ল।…দেয় নি।
কিন্তু এই উত্তরটুকুই যে সব নয়, খেয়াল করল না। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল একটু। খানিক বাদে সচকিত হল। ছেলে তেমনি স্থির চোখে দেখছে তাকে। তার মনে পাঁচ রকমের প্রশ্ন উদয় হতে পারে, সেটা খেয়াল হল। এ-রকম একটা মেয়ের জন্য এই দরদ স্বাভাবিক নয়।
একটু থেমে আস্তে আস্তে বলল তোর একটা বোন ছিল তোর থেকে পাঁচ বছরের বড়। তোর মনে নেই, তোর মাত্র দু বছর বয়েস তখন।…এই মেয়েটাকে দেখার পর থেকে আমার কেবলই মনে হয়, মেয়েটা থাকলে এ রকমটাই হয়ত দেখতে হত…
মা-বাবার মনে কিছু একটা দুর্ঘটনার চাপা ব্যথা আছে, তার আভাস চিৎ কখনো ছেলে পায়। তবে জীবন ধারণের সতেরো ঝাটে থাকে বলে খেয়াল করে না। রাগ বা অভিমান ভুলে বিষ্ণু উদগ্রীব মুখে জিজ্ঞাসা করল–সে কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাব বদলালো সদানন্দর। সংক্ষিপ্ত জবাব দিল-মরে গেছে।
একটু বাদে আবার অন্যমনস্কর মতো বলল–তোর মাকে এ সব বলিস না কিছু, বড় ভালোবাসত, মনে পড়লে খুব মন খারাপ হবে।
বাপের কথা শুনে বিষ্ণু মনে মনে নিশ্চিন্ত হল। বোন ছিল শুনে সে-ই কিনা ভেবে ঘাবড়ে গিয়েছিল। মরা মেয়েকে মনে পড়ার দরুন কতবড় বিপদে ফেলার ব্যবস্থা করছিল ওকে, সে-কথা ভেবে ভিতরে ভিতরে উষ্ণও হয়ে উঠল একটু। তবু এই নিয়ে আর আঘাত দিতে মন সরল না। বিষ্ণুর সব আক্রোশ গিয়ে পড়ল ওই মেয়েটার ওপর, যে মেয়েটা দু-দুবার ঠকিয়ে গেল তাদের। সব-জায়গায় এ-ই করে বেড়ায় নিশ্চয়। বাপের অসাক্ষাতে কোনোদিন বাগে পেলে দেখে নেবে। বয়েস হলে। লোকের, জ্ঞানগম্যিও কমে যায় বোধ হয়, চুরি করতে দেখেও কবেকার কোন মরা মেয়ের শোক উথলে ওঠে।
বাপ ছেলে দুজনে ঘরের উদ্দেশে পা বাড়িয়েছে। সামনের রাস্তাটা পার হবার মুখে এক সঙ্গে দুজনারই পা যেন মাটির সঙ্গে আটকে গেল হঠাৎ।
রাস্তার এক আড়ালে একটা দেয়ালের ধার ঘেঁষে সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। একা। তাদের দেখে দুপ এগিয়েও থমকে দাঁড়াল। বিষ্ণুর মনে হল তাকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেল। মনে হল, বাবার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে একা পেলে কাছে আসত, বলত কিছু।
তার জামাটা ধরে একটা টান দিয়ে রুক্ষস্বরে সদানন্দ বলল–দাঁড়ালি কেন, চল–
হন হন করে রাস্তাটা পার হয়ে গেল সে। দ্রুত পা চালিয়ে তবে বিষ্ণু বাপের নাগাল পেল।
ছেলেকে গোটাগুটি সত্য বলে নি সদানন্দ। মেয়ে সত্যিই মরে গেছে কিনা জানে না। সকলের অগোচরে স্ত্রী অনেক সময় গজগজ করেছে, কতকাল আর ওই পোড়ারমুখির জ্বালা বুকে চেপে বসে থাকবে, আর কতকাল ভাববে?
সদানন্দ কখনো চুপ, কখনো বলেছে–ও মরে গেছে শুনলে আর ভাবতাম না, জ্বালাও জুড়তে….
একটানা ষোলটা বছরের ঘাত-প্রতিঘাত গেছে এই জীবনের ওপর দিয়ে, তবু ক্ষতটা মনে হয় সেদিনের। একেবারে তাজা। সংসারের দুঃখে-দারিদে বরং অনেকটা ভুলেছে, কিন্তু সদানন্দ ভুলতে পারে নি। ছেলের কাছে যাই বল, সাত বছরের সেই দুরন্ত সুশ্রী মেয়েটা আসলে চোখের মণি ছিল তারই।
ওই মেয়েরও আগে ছেলে ছিল আর একটা। তারপর মেয়ে। মেয়ে হওয়ার পর স্ত্রীর স্বাস্থ্য ভেঙেছিল। পাঁচ বছর বাদে বিষ্ণু এসেছে। আর তার দুবছর যেতে কোলে। আর এক ছেলে এসেছে। এই তিন ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সেই সচ্ছলতার দিনেও হিমসিম অবস্থা। মোটামুটি লেখাপড়া শিখেছিল সদানন্দ, পদ্মা-পারের একটা ছোট ব্যাঙ্কে কেরানীর চাকরি করত। বেতন সামান্য। তবু ভদ্রঘরের ছেলে সদানন্দ, ভদ্রবংশের সন্তান।