ছেলেকে যেন ছিঁড়েই ফেলবে সদানন্দ, গর্জে উঠে ছেলের দিকে ঝুঁকতে চেষ্টা করল সে।–চোপ! পাজী বদমাস অভদ্র ইতর কোথাকার, আজ তোকে আমি খুন করব! সরে আয় বলছি এদিকে, লোকের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে পর্যন্ত শেখো নি উল্লুক কোথাকার, সরে যা ওদিকে! নইলে আজ তোকে–
তারপর খদ্দেরের ঘাড়ে পড়ার ভয়েই হয়ত উদ্যত ঘুসিটা নামিয়ে নিল। হতভম্ব ছেলেটাও কুঁকড়ে গিয়ে নিজের অগোচরে কোণের দিক ঘেঁষে বাপের নাগালের বাইরে সরে দাঁড়াল। চুপসে গেলেও তার বিস্ময়ের ঘোর কাটে নি।
দুহাত জুড়ে সদানন্দ কাকুতি মিনতি করে বলল–অপরাধ নেবেন না মা-লক্ষ্মী, ছেলের বাপের দিকে চেয়ে ওকে ক্ষমা করুন। এই পাঁচ টাকার নোটটা আপনিই দিয়েছিলেন তো… দিয়ে আপনি অন্য জিনিস দেখছিলেন দেখে আমি একটু এদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, ওই পাজীটা না দেখেই…ইয়ে, তাহলে পার্সটার দাম হল গিয়ে দুটাকা বারো আনা, আপনি ফেরত পাবেন গিয়ে দুটাকা চার আনা…
বলতে বলতে তাড়াতাড়ি কাঠের বাক্সটা খুলে একটা দুটাকার নোট আর খুচরো চার আন্ম–পয়সা মেয়েটির হাতে দিয়ে আবার হাত জোড় করল।–দোষ নেবেন না মা লক্ষ্মী, আপনারও খেয়াল ছিল না, আমিও ওদিকে জিনিস সামলাচ্ছিলাম…পাজী ছেলেটার কাণ্ডজ্ঞান নেই, এবারের মতো ক্ষমা করুন।
মা-লক্ষ্মী ক্ষমা করলেও সমবেত উৎসুক দর্শকরা হয়ত অত সহজে ক্ষমা করত, যদি না প্রসাধনবিলাসিনীটি অমন বিমূঢ় চোখে মলিন অথচ কমনীয়দর্শন প্রৌঢ়টির দিকে ফ্যালফ্যাল করে খানিক চেয়ে থেকে ফেরত টাকা ও খুচরো পয়সা ভ্যানিটি ব্যাগে পুরতে পুরতে দ্রুত প্রস্থান করত সেখান থেকে। আর, যদি না ছেলের অপরাধের দরুন অতটাই আন্তরিকতা ফুটে উঠত প্রৌঢ় সদানন্দর মুখে। উৎসুক দর্শকদের মধ্যে দুই-একজন মন্তব্য করতে ছাড়ল না তবু। ছেলেটার দিকে চেয়ে বলল-খদ্দেরের সঙ্গে বিশেষ করে মহিলার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করলে মারের চোটে হাড় গোড় গুড়োবে কোন দিন, দোকান করাও বেরিয়ে যাবে।….
আর একজন বলল–মেয়েটা ভালো তাই, নইলে থাপ্পড়ের চোটে দাঁত নড়ে যেত।
ছেলেটি সভয়ে বোবার মতো দাঁড়িয়েই আছে, সদানন্দর দুই হাত তখনো উত্তেজনাপিপাসু সমবেতদের উদ্দেশে যুক্ত। ফলে আর গণ্ডগোলের আশা ছেড়ে তারা একে একে চলে গেল।
রাত বাড়ছে। সাদাটে আলোর ছটায় মহানগরীর অভিজাত যৌবন বাড়ছে। নতুন খদ্দের আসছে, যাচ্ছে। বাঙালীর থেকে অবাঙালীর আনাগোনা বেশী এদিকটায়। যেতে আসতে তারা থমকে দাঁড়াচ্ছে। শৌখিন সিগারেট কেস দেখছে, পার্স দেখছে, ঘড়ির ব্যাণ্ড দেখছে, গগল্স দেখছে। শো-কেসে আর সামনের খোলা কেসে এ-রকম হরেক সখের সামগ্রী সাজানো আছে। এখানে কেনার থেকে দেখার লোকই বেশি। কিন্তু কিছু বিক্রী হলে অন্য জায়গা থেকে চড়া দামেই বিকোয়। কেউ দাঁড়িয়ে দেখছে, কেউ কিছু হাতে নিয়ে পরখ করছে, আর কেউ বা দাম জিজ্ঞাসা করছে। কিনছেও কেউ কেউ। দোকান আপাতত সদানন্দ একাই চালাচ্ছে। থমথমে মুখ। ছেলের দিকে একবারও তাকায় নি এতক্ষণের মধ্যে।
ছেলে বিষ্ণু ওধারের টুলটায় চুপচাপ বসে আছে সেই থেকে। তার দোকানের দিকে চোখ নেই, কে কি দেখছে বা নিচ্ছে সেদিকে লক্ষ্য নেই, সে শুধু বাপের দিকেই চেয়ে আছে। ঘুরে ফিরে বাপকেই দেখছে।
বাপের সেই আচমকা গর্জনে সে ঘাবড়ে গিয়েছিল, তারপর জনতার রাগের ফলাফল ভেবে সে ভয়ও পেয়েছিল। কিন্তু সব সত্ত্বেও কি যেন ভোজবাজীর ব্যাপার ঘটে গেছে একটা। গোটা ব্যাপারটা তার কাছে দুর্বোধ্য এখনো।
অনেকদিন শিকারীর মতো ওত পেতে থেকে আজ মেয়েটাকে ধরেছিল বিষ্ণু। তার স্থির বিশ্বাস ছিল হাতেনাতেই ধরেছে, গেল বারের মতো এই দিনেও সে দাম না দিয়েই জিনিস ব্যাগে পূরে চলে যাচ্ছে। বাবা অবশ্য বলে, গেল বারেও দাম দিয়েছে। কিন্তু বিষ্ণুর সন্দেহ যায় নি। গেল বারের সেই দিনে খদ্দেরের ভিড় একটু বেশি ছিল। দু-চারটে চলনসই রকমের সুশ্রী মেয়ে এসে দাঁড়ালেই দু-দশজন পুরুষও এসে দাঁড়ায়, সেটা বিষ্ণু লক্ষ্য করেছে। সেদিনও তাই হয়েছিল। ওই মেয়েটা কলম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। একটা কলম মোটামুটি পছন্দ হয়েছিল। একটু বাদে বিষ্ণু দেখে সেই মেয়েটাও নেই, কলমটাও নেই। বিষ্ণু তপ্তমুখে তক্ষুণি বাপকে বলল–ওই মেয়েটা কলমের দাম দিয়ে গেল না?
সাধারণ স্থলে উল্টে বকুনি খাবার কথা বিষ্ণুর। কিন্তু শোনামাত্র বাবা কেমন যেন। হকচকিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল–কোন কলমের দাম?…ও, দিয়েছে বোধ হয়।…হ্যাঁ দিয়েছে।
কিন্তু বিষ্ণুর সংশয় যায় নি। তার ধারণা মেয়েটা অত্যন্ত খারাপ, প্রায়ই তাকে এক একটা লোকের সঙ্গে কেমন ধরনের সাজগোজ করে ঘোরাফেরা করতে দেখে। অত রঙ-করা ঠোঁটের হাসি বিশ্রী দেখায়। দশহাত দূরের ওই যাদুলালের আইসক্রিম সোড়া লিমনেড আর সিগারেটের দোকানে সু-সঙ্গী প্রায়ই রাত নটা দশটার সময়েও দেখা যায় তাকে। দুজনেই সোডা লিমনেড খায়, কিন্তু সঙ্গী কি খায় এক নজর তাকিয়েই বিষ্ণু বুঝতে পারে। যাদুলালের দোকানে শৌখিন অবাঙালী খদ্দেরের ভিড় বেশি কেন, বিষ্ণু তা খুব ভালো করেই জানে। সোডা লিমনেডের বোতলে অন্য মালও রাখে সে। খদ্দের বুঝে বার করে দেয়। ওই রকম লোক যার সঙ্গী, সে আর কেমন মেয়ে হবে? এই বিরূপ ধারণা থেকেই বিষ্ণুর বিশ্বাস, কলমটা খোয়াই গেছে, দাম না দিয়েই মেয়েটা কলম নিয়ে সরে পড়েছে। বাবার খেয়াল নেই, তাই বলছে দাম দিয়ে। গেছে।