– অর্থাৎ যোগাযোগটা মালার দিক থেকেও সৌভাগ্যসূচক। মালাও সেটা বুঝল যেন, বলল–লোত হচ্ছে। আচ্ছা, এবারে গাড়ি ফেরান, যেতে যেতে, কথা বলি।
গৌতম দত্ত গাড়ি ফেরাল। অন্তর তুষ্টিতে ভরপুর। লোভের আরো একটু ইন্ধন যোগাল। বলল, এক আধ বছরের মধ্যে হয়ত-বাইরেও যাব আমরা
মালা চুপচাপ ভাবল একটু। বলল–আপনার মডেল মানে তো–ক্যালেন্ডার ট্যালেন্ডারে যে রকম সিটিং দিই, সে রকম নয় বোধহয়?
গৌতম দত্ত মাথা নাড়ল।-না সে রকম নয়। রিয়েল মডেল বলতে যা বোঝায়, মানে–
বলাটা সহজ হচ্ছিল না। মালা হেসে থামিয়ে দিল।–থাক, বুঝেছি। আচ্ছা, কি রকম কি ব্যবস্থা হবে বলুন
-তুমি বললেই ভালো হয়, কি রকম দরকার–
দরকার তো কম নয়।-হাসি-হাসি মুখখানা হিসেবে মগ্ন একটু।–তা দিনে কাজ, না রাত্রিতে?
দিনের বেলায়ও দরকার হতে পারে, তবে রাত্রিতেই কাজ করি
হিসেব ভুলে মালা সকৌতুকে ঘাড় ফেরাল তার দিকে।
–রিয়েল মডেল নিয়ে রাত্রিতে কাজ করলে আপনার স্ত্রী রাগ করেন না? বিয়ে করেছেন তো?
কাজের প্রসঙ্গে এই মেয়েলী কথা ভালো লাগল না গৌতম দত্তর। এককথায় দুটো জবাব সারল।–তিনি জানেন এটা পেশা আমার।
মালা মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, সেটা ঠিক কথা। জিজ্ঞাসা করল–কতদিনের কাজ আপনার?
–কাজ অনেকদিনের, এক বছরের না হয় তিন বছরেরই কন্ট্রাক্ট করে নিতে রাজী আছি আমি। তারপরেও কাজ শেষ হবে না, কন্ট্রাক্ট আবার রিনিউ হবে।
মালা খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল যেন। মনে মনে আবার একটু হিসেব করে নিয়ে বলল–দিনে কম হলেও দেড়শ টাকা–মাসে ধরুন সাড়ে চার হাজার টাকা রোজগার আমার, বেশীও হয়–
গৌতম দত্ত আঁতকে উঠল একেবারে। গাড়িটা সুষ্ঠু নড়েচড়ে গেল একটু। মনের মতো মডেল পেলে সে মোটা টাকা খরচ করতে প্রস্তুত-সেই মোটা টাকার অঙ্কটা খুব বেশী হলে হাজার টাকা মাসে। এই একটা অঙ্ক শুনে, রাজ্যের হতাশা যেন গ্রাস করতে এল তাকে। নিজেকে খানিকটা বঞ্চিত করে আর পৈতৃক সম্পত্তির জোরে টেনেটুনে বড় জোর দেড় হাজারে উঠতে পারে। সেও এই ঝোঁকে, এই মডেলের জন্যে।– শুকনো মুখে বলল–আমি অত পেরে উঠব,কেন, এতবড় কাজের দিকটা ভেবে আর শিল্পীর দিকটা ভেবেই তুমি যদি অনুগ্রহ করে রাজী হও।
চরম হতাশার মুহূর্তেও একটুখানি আশার আলো দেখছিল কি গৌতম দত্ত? সামনের দিকে নজর রাখা ভুলে পার্শ্ববর্তিনীর দিকেই চাইছে ফিরে ফিরে। আবেদনের ফলে একটু ভাবছেই মনে হল।
মালা বলল–মুশকিলে ফেললেন। আচ্ছা, মোটামুটি ওই চার হাজার পর্যন্ত পারি, তার নীচে আর পারি না।
গৌতম দত্তর সময় লাগল আত্মস্থ হতে। গাড়ি হোটেলের কাছাকাছি এসে গেছে। অস্ফুট স্বরে বলল–না, সেও আমার সাধ্যের বাইরে।
মালা তক্ষুণি সান্ত্বনার সুরে বলল–তাতে কি, কমে কি আর পাওয়া যায় না? আমার সঙ্গেই তো কত সময় কত জনের দেখা হয়, আর তারা সব দেখতেও ভালোই। আপনার স্টুডিও এখনো বাড়িতেই তো? সুবিধেমতো কাউকে পেলে আপনার ঠিকানা দিয়ে দেবখন।
গৌতম দত্ত নিরুত্তর।
গাড়ি হোটেলের সামনে দাঁড়াল। মালা নেমে এসে স্মিতমুখে দুহাত জুড়ে নমস্কার জানাল–বেড়িয়ে বেশ লাগছে, অনেক ধন্যবাদ। চলি।
ফুটপাথ পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।
পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করল গৌতম দত্ত। সিগারেট ধরাল। তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিল।
হোটেলের সিঁড়ি পর্যন্ত টকটকিয়ে এসে মালা দাঁড়িয়ে পড়ল। দোতলার দিকে তাকাল একবার। আজ আর ইচ্ছে করছে না দোতলায় উঠতে।…চল্লিশ-পঞ্চাশটা টাকা লোকসান কম করে। হোকগে। মনটা ভালো লাগছে খুব। শিথিল চরণে আবার বাইরে এসে একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসল সে।
.
এই স্পীডে গৌতম দত্ত গাড়ি চালায় না কখনো। ঘণ্টায় বিশ মাইলও হবে কিনা সন্দেহ। তার জীবনেরই খানিকটা গতি কমে গেছে যেন।
অবসাদগ্রস্তের মতো গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছিল গৌতম দত্ত, মেয়েদের কি হৃদয় বলে কোনো বস্তু নেই?
বীতশোক
চকিত উত্তেজনা ঘোরালো হয়ে উঠতে পারত। সুবেশা, চোখে ঘোর-লাগানোরমণীর। অপমানে পথ-চলতি খদ্দেরের রোষ আরো লোক টেনে আনতে পারত। জনতার মেজাজ চড়লে ছোট দোকানের ছোট্ট আশা নির্মূল হতে পারত। তবু, কোনো পরিণাম না ভেবেই এই কাণ্ড করে বসল সদানন্দ।
পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়িয়ে একাগ্র মনোযোগে শৌখিন বেসাতির সামগ্রী সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছিল সে। আট-দশজন ফুটপাথের খদ্দের জিনিস দেখছে, যাচাই বাছাই করছে জেনেও ফিরে তাকায় নি। যেন দোকান গোছানোটাই আপাতত বড় কাজ। এমন কি তার অস্তিত্ব সম্বন্ধেও এই খদ্দেররা বা উৎসুক দর্শকরা সচেতন ছিল না। হঠাৎ হকচকিয়ে গিয়ে তারা ওই সতেরো আঠারো বছরের জোয়ান ছেলেটার কাণ্ডকারখানা দেখছিল, আর কটুভাষণ শুনছিল। আর উদগ্র বিস্ময়ে অতি আধুনিকাটির শুকনো বিড়ম্বিত মুখখানি পর্যবেক্ষণ করছিল। মেয়েটার আসল চেহারা বুঝে নিতে চেষ্টা করছিল তারা।
ফুটপাথ বিপনীর মালিক সদানন্দর দিকে কারো চোখ ছিল না। মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এই দ্বিতীয় নাটকের জন্যেও কেউ প্রস্তুত ছিল না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সদানন্দ আচমকা গর্জনে ছেলের টুটি কামড়ে ছিঁড়তে এল যেন। কৌতূহলী ক্রেতা আর দর্শকরা আঁতকে উঠল একেবারে। জোয়ান ছেলেটা হতভম্ব। এমন কি, যাকে কেন্দ্র করে এই পরিস্থিতি, সেই সুবেশা প্রসাধনপটিয়সী তন্বী-সদৃশাটিও বিমূঢ় হঠাৎ।