অনেক পুরুষেরই পরিচিতসুলভ ব্যবহার মেয়েটির সঙ্গে। কেউ হেসে অভ্যর্থনা জানায়, কেউ বা অভিবাদনে। মেয়েটি হেসে কারো সামনে দু-পাঁচ মিনিট বসে, কারো সামনে দাঁড়িয়ে দু-চারটে কথা বলে। আবার এগোয়। হোটেল কর্তৃপক্ষ যেন এখানকার মাননীয় অতিথিবর্গের সুখ-সুবিধের ভার তার ওপরেই অর্পণ করেছে। কারো হাসিমুখের আমন্ত্রণ দেখলেই হাসে, কাছে এসে খোঁজখবর করে।
দুটো টেবিলের ওধার দিয়ে যেতে যেতে আবারও দৃষ্টি বিনিময়। গৌতম দত্ত হাসল। যেমন করে ওরা হাসে। তার থেকেও ভালো করে। কাছে আসার অনুরোধের মতো হাসি।
মেয়েটি থমকে দাঁড়াল। হাসি মিলিয়ে আসছিল। সেটা খেয়াল হতেই হাসির জবাব দিল। সুন্দর সুচারু হাসি। তারপর টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল।
-বসুন না।
গৌতম দত্ত শশব্যস্তে দাঁড়িয়ে উঠে অভ্যর্থনা জানাল।
বসল। মুখোমুখি গৌতম দত্তও। আবারও মনে হল, মুখখানা চেনা-চেনা।
-আপনাকে কিছু দিতে বলি?
-না না, ধন্যবাদ, আপনি খান। আপনাকে নতুন দেখছি কদিন ধরে, নাকি আগে অন্য সময়ে আসতেন?
-না, এই তিনদিন এলাম।–গৌতম দত্ত থমকালো একটু, তারপর বলে ফেলল –তিনদিনই আপনার জন্যে আসছি।
-খুব ভাগ্য!–মেয়েটি হাসল। কিন্তু মনে হল এ-রকম কথা শুনে সে অভ্যস্ত।
গৌতম দত্ত দ্বিধা জানে না, কাজ বোঝে। হাতে এমন সময়ও নেই যে ভণিতা করে সময় কাটাতে পারে–অনেকের অনেক জোড়া চোখ এই টেবিলে। মেয়েটিও এর মধ্যে ঘড়ি দেখেছে একবার। এই এক হাতের মধ্যে তাকে দেখে গৌতম দত্ত কাজের ফয়সালাটা করে নেবার জন্য ভিতরে ভিতরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বলল, –আমার একটু বিশেষ আলোচনা ছিল আপনার সঙ্গে, একটা দরকারী প্রোপোজাল, কিন্তু এটা ঠিক সিরিয়াস আলোচনার আবহাওয়া নয়, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে, আপনি যদি দয়া করে খানিকক্ষণের জন্যে আমার সঙ্গে আসেন।
এবারে মেয়েটির থমকাবার পালা। টানা টানা চোখ দুটি গৌতম দত্তর চোখের গভীরে। জবাব দিল না চট করে।
গৌতম দত্তর বলার মধ্যে এবারে প্রচ্ছন্ন অনুনয়ের সুর।–আপনি বিশ্বাস করুন, সত্যি খুব দরকারী আলোচনা, আপনার কোনো ভয় নেই, আমি আবার আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যাব।
–না, ভয় আর কি, চলুন।অল্প করে হাসল মেয়েটি।
গৌতম দত্তর মনে হল, এই হাসিটুকুও এঁকে রাখার মতো সুন্দর।
বিয়ারের গ্লাস থাকল পড়ে। গ্লাসে একটা নোট চাপা দিয়ে উৎফুল্ল চাপা আনন্দে সসঙ্গিনী নীচে নেমে এল। মোটরে উঠল। গাড়ি মাঠের ধার দিয়ে একটা নির্জন রাস্তা ধরে চলল। গৌতম দত্ত কি ভাবে কথাটা পাড়বে ভেবে নিচ্ছিল…সঙ্গিনী পাশের গদিতে গা ছেড়ে দিয়েছে।
এবারে একটু ভণিতা করা যেতে পারে। গৌতম দত্ত বলল–আচ্ছা আপনাকে যেন কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।
অস্ফুট হাসির শব্দ।–বিলিতী ক্যালেন্ডারে দেখে থাকবেন।
কিন্তু কোনো ক্যালেন্ডারে গৌতম দত্ত দেখেছে বলে মনে পড়ল না। দেখলে এ-মুখ মনে থাকার কথা।
মেয়েটি হালকা গাম্ভীর্যে বলল–আপনাকে তো এসব দিকে আনাড়ী মনে হয়, অচেনা কাউকে এভাবে গাড়িতে ডেকে তুলবেন না, বিপদ হতে পারে। কত রকম যে থাকে–
-না, ইয়ে–আমার অন্য কথা ছিল—
–সে তো শুনলাম। নমিদি কেমন আছে? কোথায় বিয়ে হল–ছেলেপুলে কী?
গৌতম দত্ত হতভম্ব।–আপনি নমিকে চেনেন?
-ওমা, চিনব না কেন? কতদিন পাশাপাশি কাটালাম, দিনরাত ঘরে বসে আপনার কত ছবি-আঁকা দেখতাম।
গৌতম দত্তর প্রায় মনে পড়ল বুঝি এবার, বিয়ের কথাও উঠেছিল পাশের বাড়ির কার সঙ্গে যেন–এই নাকি! কি কাণ্ড! হলে তো হয়েছিল আর কি! কিন্তু তার আশাও বাড়ল। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল–তোমার–আই মিন্ আপনার নামটি কী?
–নাম মালা–অস্ফুট মিষ্টি হাসি তেমনি–নামে কি চিনবেন, দিনরাত চোখ-কান বন্ধ করে কাজ করতেন আপনি।
প্রশংসার কথাই। গৌতম দত্ত মনে মনে খুশী হল। স্তুতি অনেক জোটে, কিন্তু যার কাছে স্বার্থ তার স্তুতিটা বেশী কাম্য। স্টিয়ারিং হাতে থাকায় ঘাড় ফিরিয়ে ভালো করে দেখার সুবিধে হচ্ছিল না। বলল–তখন নিজের খেয়ালে আঁকতুম, শিল্পী হিসেবে এখন একটু-আধটু চেনে অনেকেই
মালা সায় দিল।–চিনবে জানতুম।–তা দরকারী আলোচনাটা কি আপনার, মডেল চাই?
গৌতম দত্ত অবাকই হচ্ছে মনে মনে। এই চেহারার এমন এক মেয়ে তার বাড়ির গায়ে থাকত, অথচ ভালো করে সে লক্ষ্যও করে নি কোনোদিন।…বছর দশেক হয়ে গেল বোধহয়, বয়েস তো তাহলে আটাশ-উনত্রিশের কম নয়–অথচ এত কাছ থেকেও সে বাইশ-তেইশের বেশি ভাবে নি। কারণ থাক আর না থাক, গৌতম দত্ত এই জন্যেও বোধহয় আরো খুশী মনে মনে। কিন্তু পেশাগত আলোচনার মুখে আগ্রহটা খুব বেশী দেখানো উচিত নয়।
মাথা নাড়ল। বলল–হ্যাঁ, একের পর এক দেখে যাচ্ছি, তুমি–মানে আপনি রাজী হলে
–তুমি আপনিতে বড় গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। একটা ঠিক করুন। তুমিও বলতে পারেন, আপত্তি করব না–
আপত্তি করবে না। সুতরাং তার আসা সার্থক, সেটা গৌতম দত্ত ধরেই নিয়েছে। বলল–তুমি রাজী হলে সেট করে ফেলি।
মালা ভাবনায় পড়ল যেন একটু।–আমার কি সময় হবে
লাগোয়া বাড়ির পড়শিনী ছিল একদিন, সেই কারণে গৌতম দত্তর যেন দাবিই আছে। জোর দিয়ে বলল–এ একটা মস্ত কাজ। আমার অনেক নতুন আইডিয়া আছে, অনেক প্ল্যানও আছে–আমার বিশ্বাস বিদেশেও কম কদর হবে না, আর মডেল হিসেবে তোমারও নাম ছড়াবে–এ রকম যোগাযোগ সব সময় ঠিক হয় না।