বিমলেন্দুবাবুকে কথাবার্তা বলার জন্য বাড়িতে আসতে বলা হল। মস্ত আশা নিয়ে তিনি গেলেন। কিন্তু তারপর মুখ অন্ধকার। আলোচনার ছলে মোটামুটি একটা ফর্দ পেশ করলেন নমির বাবা। সেই ফর্দ বিমলেন্দুবাবু তার নিজের দুটো মেয়ের বিয়েতেও মেটাতে পারতেন কিনা সন্দেহ। তার ওপর নগদ তিন হাজার এক টাকা পণ। দায়দায়িত্ব সবই জ্যাঠার যখন, ছেলেটা কোনোদিন না ভাবে জ্যাঠা তার পাওয়া থোয়ার ব্যাপারে উদাসীন ছিল।
বিমলেন্দুবাবুর মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। লো-প্রেসার কি হাই-প্রেসার বুঝছিলেন না। একটু সুস্থির হয়ে প্রথমে মেয়ের বাপের বাড়ির, পরে নিজের বাড়ির সংসারের চিত্রটা তার চোখের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন–আপনাদের দয়ার ওপর নির্ভর
নমির বাবা নিরাসক্ত মুখে জবাব দিয়েছেন–তাহলে আর কি হবে।
তবু একটু অনুনয় করতে যাচ্ছিলেন বিমলেন্দুবাবু, কিন্তু ভদ্রলোক সেটা পছন্দ করেন নি। বলেছেন–এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি
না, কথা আর বাড়ে নি। তারপর মামীর তাড়নায় পড়ে এই শেষ চেষ্টাটা করেছিলেন বিমলেন্দু। ছেলেকে একবার এনে দেখানোর চেষ্টা। তারও এই ফল।
জানালা থেকে উঠে বাইরের বারান্দার রেলিংয়ে এসে দাঁড়াল মালা। এদিকে পাজামা-পরা লোকটা আর ওদিকের গায়ক গুটি-গুটি এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে টের পেল। দুদিকের দুজোড়া চোখ তাকে গিলছে, তাও উপলব্ধি করল। কিন্তু মালা ভাজ এই প্রথম দাঁড়িয়েই রইল। নির্লিপ্ত, উদাসীন। জগৎটাই যেন মৃত মূৰ্ছাতুর হয়ে পড়ে আছে তার সামনে।
এর মাস সাতেক বাদে এ-সংসারের সব থেকে অভিনব বিয়োগান্ত নাটকটা সুসম্পন্ন হয়ে গেল। মামা চোখ বুজলেন। লো-প্রেসারের স্ট্রোক। তিন দিন অজ্ঞান হয়ে ছিলেন। জ্ঞান আর হয়ই নি। মামী ডাক ছেড়ে কেঁদেছিলেন। মালা কাঁদতে পারে নি। কাঁদবে কেমন করে, কান্না শোনার কান কি ওই বিশাল বিস্তৃত মহাকাশে কোথাও আছে?
.
এ-কাহিনীর শেষ অধ্যায়ের সূচনা দশ বছর বাদে।
শহরের অভিজাত অঞ্চলে হয়ত সব থেকেই অভিজাত আদব-কায়দার হোটেল ওটা। এখানে পকেটের রসদের হিসেব কষে কেউ ঢোকে না। হিসেব জিনিসটাই অচল এখানে। এখানকার রাতের অঢেল যৌবন। এখানকার আলোর কণায় কণায় যৌবনের নেশা। বাঙালী মাদ্রাজী পার্শী শিখ নেটিভ-সাহেব খাস-সাহেব–সকল জাতের সকল বর্ণের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষদের অবসর-বিনোদনের বা শ্রান্তি-ক্লান্তি মোচনের জায়গা এটি। অর্থকৌলীন্যে যিনি যত বেশী মেজাজী কুলীন, তার তত সহজ আনাগেনা এখানে।
আইন? কানুন? সে-সবের কড়াকড়ি ছোট জায়গার জন্যে। বড় জায়গার স্পেশ্যাল পরোয়ানা। প্রয়োজন দেখাও, টাকা ঢালো–পরোয়ানা মিলবে। হোটেল কর্তৃপক্ষ রাতের মিয়াদ ভোরের দিকে টেনে নেবার জন্যে পরোয়ানা সংগ্রহে পিছ পা নয়, টাকা ঢালতে গররাজী নয়। কারণ তারা ঘরের টাকা ঢালছে না।
গৌতম দত্তর ছোট গাড়িটা হোটেলের সামনের ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়াল যখন, রাত তখন দশটার ওধারে। নিজেই ড্রাইভ করে। না, সে নিয়মিত আগন্তুক নয়। এখানকার। যা সে খুঁজছে, একজন বন্ধু তার হদিস দিয়েছিল। বলেছিল, দেখ গে, পছন্দ হবে হয়ত, যদি রাজী করাতে পার—
আজ নিয়ে পর পর এই তিন দিন আসছে সে। দুদিনই দেখা পেয়েছে, আজও পাবে হয়ত। পছন্দ হয়েছে। যতটা চেয়েছিল তার থেকেও বেশী পছন্দ। কিন্তু আলাপ করা হয়নি। প্রস্তাব করা হয়নি। চেয়ে চেয়ে দেখেছে শুধু।
এখানকার ক্ষণ-সহচরীদের একজন। বাঙালী মেয়ে। বাঙালী মেয়ে বোধহয় এই একজনই আসে এখানে। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান আছে, পার্শী আছে–সুন্দরীও বটে। সুন্দরী না হলে এখানে ঠাই মেলে না। শুধু রূপ থাকলে হবে না, বেশবাস, আচার-আচরণ, কথাবার্তায় সূক্ষ্ম মার্জিত রুচিবোধ থাকা চাই। তা-ই আছে সকলের। কিন্তু আর কারো দিকে চোখ পড়ে নি গৌতম দত্তর। ওই একটি মেয়ে ছাড়া। আশ্চর্য, এমন মেয়েও আসে এখানে!
গৌতম দত্ত নামজাদা শিল্পী। তার ছবি, তার মডেলিংয়ের আলাদা মর্যাদা। কিন্তু সম্প্রতি মডেলই খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। মনের মতো মডেল। যে মডেল পেলে আন্তর্জাতিক সমঝদারদেরও টনক নড়বে। অনেকবার অনেক মডেল নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু তেমন মন ওঠে না। শিল্পী নিজে মুগ্ধ না হলে, মুগ্ধ করবে কাকে? মন না ভরলে, গড়ার চেষ্টা বিড়ম্বনা। এজন্যে টাকা খরচ করতেও প্রস্তুত সে।
আগের দুদিন যেখানে বসেছিল আজও সেই কোণটাই বেছে নিয়ে বসল। বিয়ারের অর্ডার দিল। এখান থেকেই মেয়েটিকে দেখেছে দুদিন। আজও দেখছে। মুখখানা গত দুদিনের মতোই চেনা-চেনা লাগছে। একজন ফিটফাট শিখ তরুণের সঙ্গে হাসিমুখে কথা কইছে মেয়েটি। আর এক-আধবার ঘাড় ফিরিয়ে ওকেও দেখছে। আগের দিনও দেখেছিল।
গৌতম দত্ত অল্প অল্প বিয়ারে চুমুক দিচ্ছে, চোখ দুটো তার অদূরের নারীতনুতে আটকে আছে। গত দুদিনের মতোই বিশ্লেষণ করে দেখছেনাক, মুখ, চোখ, ঠোঁটের বক্রাভাস, চিবুক, গলা। তারপর বক্ষাভাস-মার্জিত চোখে যতটুকু সয় ততটুকুই স্পষ্ট, ততটুকুই সুন্দর। তারপর কটিদেশ। তারপর আরো নীচে, আরো নীচে–একেবারে পা পর্যন্ত।
আজই প্রস্তাব করবে গৌতম দত্ত।
শিখ তরুণটির পানাহারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হাসিমুখে উঠল মেয়েটি। আগের দুদিনও প্রত্যেককে প্রত্যাখ্যান করতে দেখেছে। চাহিদা বজায় রাখার এটাই বোধহয় রীতি।