এই হলঘরটা রহস্যের মতো লাগে মালার। দুবছর ধরেই তাই লাগছে। সেখানে ঘরের মালিক যখন কর্মনিবিষ্ট, মালার এই কোণের জানালাটা তখন অল্প ফাঁক থাকে। ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে অবাক বিস্ময়ে দেখে মালা। অত নিবিষ্টচিত্তেও কাজ করতে পারে কেউ! সমস্ত দুনিয়াটা যেন অনুপস্থিত লোকটার কাছে। উপস্থিত শুধু ওই মস্ত ফ্রেমটা, আর তাতে আঁটা ক্যানভাসটা, আর পাশের রঙ-তুলি আর জলের বাটি। কখন নতুন ক্যানভাসে রঙ ছোঁয়ানো হল, আর কবে সেটা শেষ হল, মালা তার পুঙ্খানুপুঙ্খ জানে। কিন্তু কি শেষ হল, সেটা জানার উপায় নেই। জানার জন্যে ছটফটানিরও শেষ নেই। ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে দেখে আসে। লোকটার মুখের তৃপ্তি দেখে বা বিরক্তি দেখে শুধু বুঝতে পারে, কোনটা মনের মতো হল, আর কোনটা হল না।
ইচ্ছে করলেই মালা ওই ঘরে ঢুকতে পারে, ইচ্ছে করলেই দেখতে পারে। নমিদি তো কতদিন তাকে যাবার কথা বলেছে। এই বয়সেই এত লজ্জা দেখে রাগ পর্যন্ত করেছে। কিন্তু রাজ্যের সংকোচ মালার। আর ওই ঘরে ঢোকা! বাবা রে বাবা! নমিদি। বলেছে, যখন তখন গৌতমদার ঘরে ঢুকলে তাকে সুষ্ঠু নাকি রাগ করে ঘর থেকে বার করে দেয়। আঁকা-টাকার গল্প উঠলে তার গৌতমদার প্রশংসায় নমিদি পঞ্চমুখ। তার মতে অমন শিল্পী আর আছে কিনা সন্দেহ! নমিদির থেকে মাত্র তিন বছরের। বড় খুড়তুতো দাদাটি। ওই বাড়িটার অর্ধেক মালিক। নমিদি এম. এ. পড়ে। তার এই দাদা বি. এস-সি. ডিস্টিংশনে পাস করে আঁকার কলেজে ঢুকেছিল। সেখানেও আগাগোড়া ফার্স্ট। এই বয়সেই এখন সেই আঁকার কলেজে মাস্টারি করে। অবসর সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের কাজ করে।
মামীর সঙ্গে খুব ভাব নমিদির। প্রায়ই গল্প করতে আসে। মালা যায় না বলে মামীকে অনুযোগ করাতে মামী অনেক দিন ঠেলে পাঠাতে চেষ্টা করেছেন তাকে। সে-চেষ্টার পিছনে মামীর একটু আশাও ছিল। মালা শেষে নমিদিকে বলেছিল–পরীক্ষাটা হয়ে গেলে যাবে।…নমিদি হেসে ফেলেছিল–এখান থেকে লাফালে আমাদের ঘরে। গিয়ে পড়বে-পরীক্ষার জন্য যেতে পারছ না?
পরীক্ষা, অর্থাৎ স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা। মামাই তোড়জোড় করে ওর পড়াশুনার ব্যবস্থা করেছিলেন আর অন্য ভাইবোনগুলোকে স্কুলে ভরতি করে দিয়েছিলেন। ওর পরীক্ষার পর নমিদিরাই দু-তিন মাসের জন্য কোথায় যেন গিয়েছিল। কিন্তু মালা তারপর যাবে কি, লজ্জায় মুখ লুকোতে পারলে বাঁচে–সে থার্ড ডিভিশনে পাস করেছে।
পাস করার পরেও তাকে কলেজে ভর্তি করানো যায় নি। তার লজ্জাই বেশী। মামা আবারও বাড়িতে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু পড়াশোনা মালার কমই হয়। সামনে বই খোলা থাকে, এই পর্যন্ত। চোখ থাকে আধ-পাটখোলা জানালার ভিতর দিয়ে গলির ওধারের ওই বড় ঘরটার দিকে। খুব ক্লান্ত লাগলে লোকটা তুলি-টুলি ফেলে হাত-পা ছড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকে। আর সিগারেট একবার ধরল তো একেবারে দুটো তিনটে খাবে। মালা শুনেছিল বেশী সিগারেট খেলে গলায় ও বুকে অনেক সময় ব্যামো হয়। মালা ভুরু কোঁচকায়, কেন, কি দরকার অত সিগারেট খাবার!
জানালাটা যে সব সময় একেবারে মাপমতো বন্ধ থাকে তা নয়। এক-আধ সময় হয়ত খোলাই থেকে যায় অনেকটা। কাজে মন দিলে কোনোদিকে তো আর তাকাবে না লোকটা তাই সব সময় সতর্ক থাকার প্রয়োজন হয় না মালার। ফলে এক-একদিন দেখা হয়ে যায়, চোখখাচোখি হয়। তখনো খুব যে খেয়াল করে দেখে ওকে, মনে হয় না। মালা অবশ্য জানালাটা ঠেলেই দেয়। নমিদির মুখে নাম শুনেছে, গৌতম। গৌতমই বটে। মালার এক-একদিন ইচ্ছে হয়, স্কুল ফাইন্যালের ইতিহাস বইটা এনে গৌতমের ধ্যান অধ্যায়টা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ে। তারপর উদ্ভট ইচ্ছেটার কথা ভেবে নিজের মনেই হেসে বাঁচে না।
একদিন মালার দুই চক্ষু বিস্ফারিত। জানালা বন্ধ করতেও ভুল হয়ে গেল। একি কাণ্ড! ছোট ছেলের মতো একতাল কাদামাটি ছানাছানি করছে লোকটা। তাই দিয়ে কিছু একটা গড়তে চেষ্টা করছে, আবার তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে কাদার তালটাকে কিছু একটা আদলে আনার চেষ্টায় হাল ছেড়ে শেষে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। মালার তখনো খেয়াল নেই, সে হাঁ করে দাঁড়িয়েই আছে। লোকটার মুখে হাসির আভাস দেখে খেয়াল হয়েছে, হুড়মুড়িয়ে ছুটে পালিয়েছে সেখান থেকে।
মামী একদিন নমিদির কাছে ভাগ্নীর বিয়ের ভাবনাটা প্রকাশ করে ফেললেন। মালা কাছেই ছিল। নমিদির মন্তব্য কানে এল–ওর জন্যে আপনার ভাবনা কি, ওই চেহারার মেয়ে কটা হয়, যে দেখবে সেই লুফে নেবে।–এরপর আর একদিন মনের। বাসনাটা নমিদির কাছে প্রকাশই করে ফেললেন মামী। বললেন, দুরাশা তো বটেই, তবু ভাগ্নীর ওই চেহারাটুকুর জন্যেই ভরসা করে প্রস্তাবটা করা। গৌতম সোনার টুকরো ছেলে, এমন ভাগ্য তাদের হবার নয়, তবু নমি যদি তাদের মুখ চেয়ে একটু চেষ্টাচরিত্র করে, যদি তার বাবাকে একটু বলে কয়ে দেখে।
রূপের যতই প্রশংসা করুক, এই আশা তারা করতে পারে সেটা নমিদি ভাবে নি বোধহয়। দূর থেকে তার মুখ দেখে সেই রকমই মনে হয়েছিল মালার। তবে কথা দিয়েছিল, বলে দেখব।
বলেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ভাইপোর জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখে গেলেন। নমির মা-বাবা। মেয়ে যে তাদের পছন্দ হয়েছে সেটা সেখানেই তারা নির্দ্বিধায় বলে গৈলেন। মেয়ে মোটামুটি তারা নিজেদের ঘরে বসেই অনেকদিন ধরে দেখে আসছেন। সুখের ঘরে রূপের বাসা, কিন্তু এই ঘরে এই রূপ এল কেমন করে, তাই বোধ হয় মনে মনে অবাক হয়ে ভাবতেন তারা।