মামা তবু আশা ছাড়তে পারে নি, তবু চলে আসতে পারে নি। বলেছে–তার কাছেই তো যাব বাবা, তবু তুমি মেয়েটিকে একবার দেখো না।
মামার শেষ আশা, তাকে ডেকে এনে সামনাসামনি একবার দেখাতে পারলে আর তারপর ঘরের অবস্থাটা খোলাখুলি ব্যক্ত করতে পারলে হয়ত শুভ সম্ভাবনাটা একেবারে ভেস্তে নাও যেতে পারে।
ছেলে কিন্তু সাফ জবাব দিয়েছে, তার দরকার নেই। সে স্পষ্টই বিরক্ত হয়েছে। ঘর থেকে চলে যেতে বলতে পারে নি। গম্ভীর মুখে নিজের কাজ নিয়ে বসেছে। সেটুকুই যথেষ্ট ইঙ্গিত। মামা চলে এসেছে।
মামা অপমানিত বোধ করেছে। যেটুকু করেছে, দায় উদ্ধারের আশাতেই করেছে। আর মামীর তাড়ায় করেছে। এতদিন এই চেষ্টা করছিল না বলে মনে মনে মালাই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল মামার ওপর। তার স্থির বিশ্বাস ছিল আসল লোকটার কাছে গিয়ে পড়লে তার জ্যাঠামশাইয়ের হিসেবনিকেশ সব শূন্যে মিলিয়ে যাবে। টাকা চাইলেই আকাশ থেকে টাকা পড়ে না, সেটা সে অন্তত বুঝবে। আজ সকালেও মনে মনে মামা-মামীর বুদ্ধির তারিফ করছিল সে। তারা যে ওই জ্যাঠামশাইটির অনুপস্থিতির প্রতীক্ষায় ছিল, আগে বোঝে নি। কাল রাতে নমিদি কথায় কথায় বলে গেছে, বাবা মক্কেলের কাজে চার-পাঁচদিনের জন্যে বাইরে গেছেন। ..মামা একদিনও সময় নষ্ট না করে আজই। গেছে।
রাগে দুঃখে চোখে জল আসার উপক্রম মালার। দাঁতের চাপে নীচের ঠোঁটটা কেটে বসার উপক্রম। হতাশার প্রথম ধাক্কায় আগে মামার অপমানটাই বুকে বিঁধেছে। এভাবে চেষ্টা করার ফলে মামাকে প্যাচালো লোক ভেবেছে ওরা। কিন্তু মামার মতো লোক যে হয় না, সেটা তার থেকে আর কে বেশী জানে।
বে-সরকারী কলেজের অধ্যাপক বিমলেন্দুবাবু।…বিমলেন্দু বসু। বয়েস হয়েছে। দীর্ঘকাল যাবৎ লো-প্রেসারে ভুগছেন। খাটুনি বেশী বলেই হয়ত। কলেজের পুরনো মাস্টার, মাইনে মন্দ নয় একেবারে। কিন্তু এ-বাজারে কিছুই নয়। তার নিজের সংসারটিও ছোট নয় একেবারে। তার ওপর দুবছর হল চারটে ভাগ্নে-ভাগ্নী আশ্রিত। কলেজের খাটুনি, বাড়িতেও দুবেলা ছেলেরা আলাদা মাইনে দিয়ে পড়তে আসে। তার ওপর ফাঁক পেলেই নিজের পড়াশোনা। মালা এক-একসময় অবাক হয়ে ভাবে, মামার রক্তচাপ তো বাড়ার কথা, মাথায় সর্বক্ষণ রক্ত উঠে থাকার কথা!
মালার বাবা এক মফঃস্বল ইস্কুলের সহকারী হেডমাস্টার। কড়া নীতিবাগীশ, সাদাসিধে বেশবাস, মাথার চুল কদম-ছাট। তাঁর নীতির দাপটে ইস্কুলের ছেলেরা ভয়ে জড়সড়-বাড়িতে ছেলে-মেয়েরাও। দুই ছেলে দুই মেয়ে। মেয়ে দুটি বড়। মফঃস্বল ইস্কুলের সহকারী হেডমাস্টারের মাইনে সেই রকমই। মাসের শেষে সংসারের প্রায় অচলাবস্থা হত। সেই কারণেও মেজাজ সব সময় চড়া থাকত ভদ্রলোকের। তার স্ত্রী, অর্থাৎ মালার মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিনই তাকে সংসার চালাতে না-জানার খোঁচা খেতে হয়েছে। বছর তিনেক হল ভদ্রমহিলা চোখ বুজেছেন।
আর বছর দেড়েক হল নীতিবাগীশ লোকটি সংসার চালনায় পটু নতুন ঘরনী এনেছেন। নতুন কী এসে অনটনের সংসারে ওই ছেলেমেয়েগুলোকে বাড়তি আপদ ভিন্ন আর কিছু ভাবেন নি। অমন বয়সের একজনের ঘরে আসার ফলে একটু বেশী সুখস্বাচ্ছন্দ্য আর আরাম তার পাওনা বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু চার-চারটে মুখ সামনে হাঁ করে আছে, সুখস্বাচ্ছন্দ্য জুটবে কোথা থেকে? অতএব তারও মেজাজের সমাচার খুব কুশল ছিল না।
ছেলেমেয়েগুলোর দুরবস্থার কথা তাদের মামা বিমলেন্দুবাবু প্রথম শুনেছিলেন। এক বন্ধুর মুখে। ভগ্নীপতির আবার বিয়ে করার খবরটাই মস্ত ধাক্কা তার। বোনটাকে ভালোবাসতেন তিনি–অনেক ছোট তার থেকে। তারপর যে-খবর শুনলেন, যদিও সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয় খুব, কিন্তু তার আংশিক সত্য হলেও স্থির থাকা কঠিন।
বিমলেন্দুবাবুর অস্থিরতা লক্ষ্য করে তার স্ত্রী-ই একদিন জোরজার করে তাকে দেখতে পাঠালেন। সৎমা এলেই পাঁচজনে পাঁচরকম সন্দেহের চোখে দেখে, তিলকে তাল করে।
বিমলেন্দুবাবু গেলেন, আর বেড়াবার নাম করে ভাগ্নে-ভাগ্নীদের একেবারে সঙ্গে করে ফিরলেন। তাঁর স্ত্রী আড়ালে যেটুকু শুনলেন তাতেই তার চোখে জল আসার উপক্রম। শুধু বললেন–নিয়ে এসে ভালো করেছ, এমন নির্লজ্জও মানুষ হয়!
দুবছর হল মালারা এসেছে এখানে। ষোল বছরে এসেছিল, এখন তার বয়েস আঠার। নিরাশ হবার মতো বয়েস নয় একটুও। গলির ওধারে ওই মস্ত দালানের ওই ঘরের লোকটা তাকে বাতিল করে দিলেও না। দুবছর ধরে এই কোণের জানালার। এখানটাই প্রধান আশ্রয় মালার। বারান্দার রেলিংয়ে গিয়ে দাঁড়ালেই বাঁয়ের দালানের পাজামা-পরনে ছেলেটার যেন রাস্তা দেখার দরকার হয়ে পড়ে। আর কোণঘেঁষা ডাইনের বাড়িটার ফেত্তা দিয়ে কাপড়-পরা সঙ্গীতজ্ঞ পুরুষটিও চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মালাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গান ভাঁজতে থাকে। অন্ধকার রাত না হলে মালার বারান্দায় দাঁড়ানো হয় না। আর রাতেও দেখা যাক না যাক, সে দাঁড়িয়ে আছে অনুভব করলেই দুদিক থেকে দুজনের আবির্ভাব ঘটে।
অতএব ঘরের কোণের জানালাটাই ভরসা মালার। সেখানে বসেই পড়ে বা বোনে, বা যা হোক কিছু করে। কখনো কপাট খোলা থাকে জানালা দুটোর, কখনো বা নিজের সুবিধেমতো একটু আধটু। সবটা খোলা থাকে যখন গলির ওধারের ও-ঘরের বাসিন্দাটি অনুপস্থিত। জানালার এই কোণটি থেকে নীচের ওই ঘরটার ভিতরসুদ্ধ দেখা যায়। ওটা ঘর ঠিক নয়, বড় একটা হলঘরের মতো। ঘরের মধ্যে কাজের কত রকম সরঞ্জাম, কত রকমের ছবি। হলঘরের ভিতর দিয়ে যে ঘরটার আভাস, সেটা শোবার ঘর।