হাসপাতালেও এই মেয়ে সহজে মুখ ফিরিয়ে তাকায় নি তার দিকে। যোগীন সিং অনেক ক্ষমা চেয়ে, অনেক নাক-কান মলে জীবনে আর কোনোদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করবে না প্রতিজ্ঞা করে তবে তার মুখে হাসি ফোঁটাতে পেরেছিল।
মনে মনে বললাম, যেভাবে এসেছ জানতে পারলে আজও একবার নাক-কান। মলে তোমাকে আবার কিছু প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম, অত মদ যে খাচ্ছে তাই বা ওর প্রেয়সী বরদাস্ত। করবে কি করে। কিন্তু তার আগে ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে সচকিত হলাম, সাতটা পঁয়ত্রিশ। এখন না উঠলে সে সাড়ে আটটায় পৌঁছবে কি করে? ঘড়ির দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে একটুও তাড়া দেখা গেল না। অস্ফুট জবাব দিল, সময় আছে। অন্যমনস্কর মতো আবারও কিছু ভাবছে মনে হল।
আরো ঠিক দশ মিনিট কাটল এইভাবে, আমি উসখুস করছি, অবাকও হচ্ছি। মদের নেশায় সময়ের গণ্ডগোল হয়ে গেল?
পৌনে আটটা।
এসো।
বোতলে আরো খানিকটা আছে, সেখানেই পড়ে থাকল। বড় বড় পা ফেলে। গাড়িতে এসে উঠল। পাশে আমি। পিছনে দেখলাম এক গোছ ফুল রয়েছে। এই দিনে ফুল কোথা থেকে সংগ্রহ হল ভেবে পেলাম না।
গাড়ি ছুটেছে।
হেড লাইটে রাস্তার অবস্থা দেখে আমার দুই চক্ষু স্থির। ঝোড়ো বাতাস আর নেই, বৃষ্টি পড়ছে। ভাঙা ডাল আর গাছের পাতায় সমস্ত রাস্তা ঢেকে গেছে। কোথাও মস্ত মস্ত টিনের চালা পড়ে আছে–তার ওপর দিয়েই মড় মড় শব্দে গাড়ি পার হতে টের পাচ্ছি বস্তুটা কি।
এ-রকম রাস্তায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটে দমদম এরোড্রাম থেকে দক্ষিণ কলকাতায় পৌঁছানোর সংকল্প শুনলেও লোকে পাগল বলবে। কিন্তু গাড়ির স্পীড দেখে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তি বাড়ছে।
এক সময় স্বাভাবিক ভাবেই বলতে চেষ্টা করলাম, যে রাস্তা, তোমার সাড়ে আটটায় পৌঁছনোর প্রশ্নই ওঠে না–
জবাব দিল না। কিন্তু গাড়িতে স্পীড আরো বেড়ে গেল।
রাজ্যের ভয় আমাকে গ্রাস করতে এলো। এবারে মনে হল, আমি যথার্থই এক পাগলের পাল্লায় পড়েছি। একবার প্রাণে বেঁচেছি, এবারে আর রক্ষা নেই। প্রায় এক বোতল মদ গিলে গাড়ি চালাচ্ছে। কি করছে একটুও হুঁশ নেই নিশ্চয়। ক্ষোভে দুঃখে নিজেরই হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল। একবার ওভাবে বেঁচে, আর চোখের সামনে। অত মদ খেতে দেখেও কেন আমি যেচে সঙ্গে এলাম! মৃত্যু না ঘনালে এমন মতি হবে কেন আমার?
বাধা পেয়ে গাড়ি এক-একবার বিষম লাফিয়ে উঠছে। সামনে মস্ত মস্ত এক-একটা ডাল, বা হয়ত একটা আস্ত গাছই পড়ে আছে। স্পীড না কমিয়ে খেলনার মতোই অপরিসর ফাঁক দিয়ে গাড়িটা পার করে আনছে যোগীন সিং।
শ্যামবাজার পেরিয়ে সার্কুলার রোড ধরে নক্ষত্ৰবেগে গাড়ি ছুটেছে। রাস্তায় জনমানব নেই, পুলিশ নেই, অন্তত আমি কিছুই দেখছি না। আমি শুধু দেখছি, সামনে মৃত্যু। মৃত্যু হাঁ করে আছে।
ডাক ছেড়ে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করছে আমার। দুহাতে তাকে জাপটে ধরে থামাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার দিকে চেয়ে কিছুই করতে পারছি না। পাথরের মূর্তির মতো বসে গাড়ি চালাচ্ছে সে। ওকে বাধা দেওয়ার থেকেও যেন মৃত্যুর গহ্বরে গিয়ে ঢোকা সহজ।
আমি তারই প্রতীক্ষা করছি। চকিতে একবার মনে হলো লোকটা বোধহয় আত্মঘাতী হতে চায়। এই জন্যই অমন দুর্যোগে অনায়াসে প্লেন ছাড়তে পেরেছে, আর এই জন্যেই এই গাড়ি নিয়ে এমন পাগলা ছোটা ছুটেছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত অ্যাকসিডেন্ট হল না। গাড়ির গতি কমল। রাস্তার পাশে হঠাৎ এক জায়গায় ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। ঘড়িতে সাড়ে আটটা।
আমারও হুশ ফিরল যেন। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখি পার্ক স্ট্রীটের এক জায়গায় এসেছি। তারপর হঠাৎ এক ধাক্কা খেয়ে বিমূঢ় আমি। ফুলের গোছা নিয়ে যোগীন সিং এখানে কোথায় নামছে! আমার শরীরের রক্ত এবারে দ্বিগুণ শিরশির করে পা বেয়ে নেমে যাচ্ছে।
এপাশে সাদা দেয়াল-ঘেরা বিস্তৃত সমাধি-ভূমি। দুর্যোগের অন্ধকারেও এখানকার সমাহিত সাদাটে পরিবেশ চোখে পড়ে।
নিজের অগোচরেই মুখ দিয়ে কথা বেরুল, এখানে কোথায় যাচ্ছ?
ফুল হাতে যোগীন সিং থমকে দাঁড়াল একটু। শান্ত গভীর দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকালো। হঠাৎ আমার মনে হল, দুই চোখে কত জল জমাট বেঁধে আছে ঠিক নেই। ঝরছে না, শুধু চকচক করছে
বিড়বিড় করে বলল–এখানেই তো, হাসপাতাল থেকে সোজা নিয়ে এসেছিলাম তাকে, এখানেই আছে। বসো, বেশি দেরি হবে না–
শ্রান্ত পা দুটো টেনে টেনে সমাধিস্থানের দিকে এগিয়ে গেল সে।
আমি নির্বাক, নিস্পন্দ।
নাগরী
জানালার তলার পাট দুটো বন্ধ করে দিয়ে সেখানে বসে বসে মালা ভাবছিল, পুরুষের কি হৃদয় বলে বস্তু নেই?
মামার কথাগুলো মালা শুনেছে। এক মামী ছাড়া আর কারো শোনার কথা নয়। মামীকেই বাইরে দরজার আড়ালে পরদার এধারে দাঁড়িয়ে বলছিল। মালাও শুনছিল। তার শোনার তাগিদ ছিল। তার হাতে মামার জন্যে এক পেয়ালা দুধ ছিল। কেউ দেখে ফেললেও কিছু ভাবত না।
বেশী কিছু কথা নয়। মামা বেশী কথা বলে না। ও-বাড়িতে গিয়েছিল। ছেলের সঙ্গেই কথা হয়েছে। ছেলে দু-চার কথায় তাকে বিদায় করেছে। তার জ্যাঠামশাইয়ের অনুপস্থিতিতে তদবিরে গিয়েছিল বলেও প্রচ্ছন্ন বিরক্তি প্রকাশ করেছে। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, জ্যাঠামশাইয়ের বিবেচনার ওপর আর কারো কোনো কথা নেই। কিছু অনুরোধ করার থাকলে তাকেই বলা দরকার।