-হ্যালো।
যোগীন সিং। মুখ লাল, কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসির আভাসও একটু। যে লোকের খপ্পরে পড়ে প্রাণ যেতে বসেছিল, তাকে দেখেই আবার অন্য আশা জাগল। যোগীন সিংয়ের ছোট গাড়ি আছে একটা। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট
সাউথে, না এদিকেই?
–সাউথে। কেন?
–আমাকে যতটা সম্ভব এগিয়ে দাও না, যাব কি করে?
ঘড়ি দেখল। তারপর পিঠ চাপড়ে বলল–কাম অন–
একটি কেবিনের দিকে এগোল সে। কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে আমিও তার সঙ্গে কেবিনে গিয়ে ঢুকলাম। যোগীন সিং দুজনের খাবারের অর্ডার দিল। খাবার না আসা পর্যন্ত চুপচাপ বসে রইল। কিছু ভাবছে মনে হল।
খাবার আসতে পরদা টেনে দিয়ে কিট থেকে মদের বোতল বার করল। আমি অবাক। প্রেয়সী সন্নিধানে যাবার আগেও এ বস্তু গলাধঃকরণ করতে পারে ভাবি নি।
খেতে খেতে ঈষৎ ব্যঙ্গস্বরে বলল, দুর্যোগে ওখানকার নিষেধ সত্ত্বেও প্লেন ছেড়েছি বলে আমার বিরুদ্ধে স্টেপ নেওয়া হবে শুনছি। ইডিয়েটস্!
ঈষৎ রক্তিম দেখালো মুখ। যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিলাম তা আর স্মরণ করতে ইচ্ছে করে না। তবু বললাম–এভাবে প্লেন না ছেড়ে আর একটু দেখে নিলেও তো পারতে।
–দেখতে গেলে আর প্লেন নিয়ে ওঠাই যেত না, সে আমি আকাশের অবস্থা। দেখেই বুঝেছিলাম। সে জন্যে পাঁচ মিনিট আগেই প্লেন স্টার্ট দিয়েছিলাম।
অর্থাৎ সব জেনেশুনেই সে প্লেন ছেড়েছে। এ রকম লোককে কিই বা বলি।
যোগীন সিং নিবিষ্ট মনে আহার করছে। আর মদ খাচ্ছে। যেভাবে খাচ্ছে, মনে হল ধীরে সুস্থে গোটা বোতলটাই শেষ করবে।
বললাম– এসে যখন এই বিপদ দেখলে তখনই বা প্লেন ফেরালে না কেন? সাঘাতিক কাণ্ড হতে পারত
বিরক্তির সুরে পাল্টা প্রশ্ন করল, ফিরব বলে প্লেন ছেড়েছিলাম? তোমাকে তো বলেছি আজ না এলেই নয়।
অর্থাৎ তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। এক রমণী তার জন্য অপেক্ষা করছে, বা করবে। এদিকে নিশ্চিন্ত মনে সে পানাহারে মগ্ন। আমি হতভম্ভ। এই দুর্যোগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না রাখতে পারলে এক পাগল ভিন্ন আর কেউ রাগ করে না। বিশেষ করে যে লোককে আকাশ-পথে উড়ে আসতে হবে।
কিছু শোনার জন্যেই টিপ্পনীর সুরে বলতে ছাড়লাম না, এইদিনে না যেতে পারলেও কি তিনি বুঝতেন না?
মাথা নাড়ল। বুঝত না। বলল, বড় অবুঝ মেয়ে, বোঝাবুঝির মধ্যে নেই। একবার এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করে যে দুর্ভোগ হয়েছে, সে যদি জানতে পড়বি তো পড়, আজ আবার সেই দিন, সেই তারিখ।
ভিতরে ভিতরে উৎসুক হয়ে উঠেছি। কুচবিহারেও একবার বলেছিল, অ্যাপয়েন্টমেন্ট না রাখতে পারলে রক্ষা নেই, মেয়ের যেমন মেজাজ তেমনি অভিমান–একবার সময়মতো যেতে না পারার ফলে কি কাণ্ডই না হয়েছিল। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে সেই আসাই এলো বটে। কিন্তু এসে এখানে বসে মদ গিলছে। সত্যি কথা বলতে কি, যে মেয়ে যোগান সিংয়ের মতো বেপরোয়া লোককে এভাবে নাকে দড়ি বেঁধে টেনে আনতে পারে, তাকে একটিবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল
জিজ্ঞাসা করলাম, তা এসেও তুমি এখানে দেরি করছ কেন?
সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, সাড়ে আটটায় যাবার কথা।
এমনভাবে বলল, কেন ওই সময়ের দু-দশ মিনিট আগেও যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এমনও হতে পারে, নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট কোনো সময়ে ওদের সাক্ষাৎ হওয়ার কথা। হয়ত ঠিক সময়ে রমণীটি অভিসারে আসবেন।
ঘড়ি দেখলাম। সাতটা বাজতে তখনো পাঁচ মিনিট বাকি। জিজ্ঞাসা করলাম কথা না রাখতে পেরে একবার খুব মুশকিলে পড়েছিলে বুঝি?
-খুব। আজকের এই দিনেই
মদ খাচ্ছে বলেই হয়ত ওর চোখের পাতা ভারি ঠেকছিল। আর মদ খাচ্ছিল। বলেই হয়ত সেই মুশকিলের কথা সহজে জানা গেছে। কিন্তু মোটামুটি শোনার পরেও সেই মুশকিলটা এমন প্রাণ তুচ্ছ করে ছুটে আসার মতো মনে হয় নি আমার। যোগীন সিংয়ের মতে যশোধরার ব্যবসায়ী বাবা লোকটা আদৌ সুবিধের নয়। মেয়েকে টোপ করে মস্ত পয়সাঅলা জামাই গাঁথবার মতলব ছিল তার। ওই করে শেয়ারবাজারের ঘা সারাবে ভেবেছিল। কিন্তু মেয়ের জন্যেই তা হচ্ছিল না। মেয়ে ওদিকে বাপের কাছে একজন মস্ত মানুষ বানিয়ে রেখেছে যোগীন সিংকে। মস্ত টাকার মানুষ। নয় মানুষের মতো মস্ত মানুষ। তার এক গোঁ তাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না।
নিরুপায় হয়ে বাপ তখন সামনাসামনি যোগীন সিংয়ের সঙ্গে একবার কথাবার্তা কয়ে বুঝে শুনে নিতে রাজি হয়েছিল। সেও অনেক দিন অনেক চেষ্টার পর মেয়ে বাপকে এই সাক্ষাৎকারে রাজি করাতে পেরেছিল। দিনক্ষণ ঠিক হল। কিন্তু এমন কাণ্ড, বলতে গেলে একরকম অকারণেই যোগীন সিং আসতে দেরী করল। এমন কিছু দেরী নয়, মিনিট বারো-চোদ্দ। ঘোড়েল বাপ ঘড়ি ধরে ঠিক দশটি মিনিট অপেক্ষা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেল। যোগীন সিং গিয়ে দেখে যশোধরাও নেই। ব্যাপারটা শুনল তার মায়ের কাছে। বাপ বেরিয়ে যাওয়ার পর রাগে জ্বলতে জ্বলতে মেয়েও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে।
সম্ভব অসম্ভব অনেক জায়গায় যোগীন সিং খুঁজে বেড়াল তাকে। আর বাপটাকে মনে মনে ধরে আছড়ালো বারকতক। ঘণ্টাখানেক বাদে নিজের বাড়িতে এলো দেখতে, যশোধরা সেখানে অপেক্ষা করছে কি না। এসে শুনল, টেলিফোনে খবর এসেছে। যশোধরা হাসপাতালে আছে। রাগে আর অভিমানে মেয়ে এমন গাড়ি চালিয়েছে যে সরাসরি অ্যাকসিডেন্ট।