- বইয়ের নামঃ একজন মিসেস নন্দী
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অভিরতি
অভিরতি
গাঁয়ের নামে নাম বউটির।
পাহাড়ঘেঁষা রুম্ফ গ্রামটার নাম ভবানী। আর মহেশকরের ঘরের বউয়ের নাম ভবানীবাঈ।
তা বিয়ের আগে নামের মুখরক্ষা করেছিল বটে মেয়েটা। মারাঠী রাজপুত দলবী। ঘরের মেয়ে। পোষ মানাতে গেলে ফোঁস করে ওঠা স্বভাব। তার ওপর ছেলেবেলা থেকে মাথার ওপর কড়া অভিভাবক না থাকার ফলে অপরিণত বয়সের স্বাধীন ইচ্ছায় বাধা-বিঘ্ন তেমন পড়ে নি। ভাই ফৌজে চাকরি করে। বছরে দু-বছরে কখনো-সখনো। এসে দু-দশদিনের জন্য ঘুরে যায়। বাপ অন্ধ। বসন্ত হয়ে প্রথমে একটা চোখ গিয়েছিল, পরে দ্বিতীয়টারও দৃষ্টি গেছে। দারিদ্র্যের সংসার সামাল দিতে দিতেই মায়ের হিমসিম অবস্থা, মেয়েকে আগলাবে কখন?
ফলে সময়ে বিয়েও হয় নি মেয়েটার। ওদের ঘরে ছোট বয়সে বিয়ে হয়। তার ওপর চোখে পড়ার মতো চোখা রূপ নেই যে কেউ সেধে এসে ঘরে নিয়ে যাবে। মোটামুটি সুশ্রী হলেও দুরন্তপনা আর বেয়াড়াপনার ফলে চেহারায় একটা পুরুষালি কাঠিন্য দিনকে দিন বেশি প্রাধান্য লাভ করছিল। তার জ্বালায় অস্থির পড়শিনীদের অনেক সময় মন্তব্য করতে শোনা গেছে, ওটা মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে অন্ধ বাপের কাজে লাগত, ও-মেয়ে নির্ঘাত হাত-পা ভেঙে বাপের বোঝা হবে একদিন।
পারলে এমন মেয়ের হাত-পা হয়ত ভেঙেই দিত কেউ। হাত-পা, অল্প-স্বল্প ভেঙে একটু শিক্ষা হোক এমন আশাও যে কেউ করে না এ-কথাও হলপ করে বলা যায় না। ভোর হতে না হতে ছেলেমেয়ের দঙ্গল নিয়ে ভবানী হুড়মুড় করে একেবারে ওই পাহাড়ের ডগায় গিয়ে উঠবে। পাহাড়টার আড়াল থেকে সূর্যোদয় হয় বলেই ওটার নাম সূর্য পাহাড়। সূর্যোদয় দেখে তারা আবার দৌড়ঝাঁপ করে নেমে আসে। এই ওঠা-নামার রেষারেষিতে ছেলেরাও পেরে ওঠে না তার সঙ্গে। আর ওই মেয়ে জখম হওয়ার বদলে একটু আধটু জখম অন্যের ছেলেমেয়েরাই হয়।
পাহাড়ের অনতিদূরে ছাতলি নদী। নামেই নদী, বারো মাস শুকনো নুড়িপাথরের হাড়-পাঁজর বার করেই আছে। ওই শুকনো নদীতেই হুটোপুটি করে সকলে, আর দৈবাৎ কখনো বেশি বর্ষা হলে বা বান ডাকলে আশেপাশের বাসিন্দারা প্রমাদ গোনে। ওই দস্যি মেয়েকে তখন রুখবে কে, সকাল-সন্ধ্যায় চারবার করে সেই খরজলে। ঝাপাঝাপি করবেই। করুক, তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে ঘরের ছেলেমেয়েদেরও যে ঠেকানো-যায় না। একবার তো একজনের মেয়ে ডুবতে ডুবতে বেঁচেছে, আর একবার একটা ছেলে পাথরে চোট খেয়ে পুরো একদিন অজ্ঞান হয়ে ছিল।
এটা মৌজা গ্রাম, অর্থাৎ দোকান-পাট, হাট-বাজার নেই। ভবানী রোজ কসবায় যায় হাট-বাজার সওদাপত্র করতে। যেখানে ওসব আছে তার নাম কসবা। তা সেখানেও নিত্য ঝগড়া করে আসে। যে দামে যে জিনিস পাওয়ার অভিলাষ তা আদায় না করে নড়বে না। দোকানীকে কটু কথা বলবে, সুবিধে বুঝে ভয়ও দেখাবে।
সকলেই তিক্ত বিরক্ত তার ওপর।
এরপর আরো কিছু বয়েস হতে মেয়েটার দুরন্তপনা অতটা প্রত্যক্ষগোচর না হোক, তার বেয়াড়াপনার আঁচ সকলেরই গায়ে লাগে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে ওর বাপ-মাকে দুকথা শোনাতে গেলে, এমন কি দুটো সৎ পরামর্শ দিতে গেলেও ওই মেয়ের রসনার ঘায়ে পালাবার পথ মেলে না! অথচ, এ ব্যাপারেও তাদের তৎপর না হয়ে উপায় কি? উঠতি বয়েসের ঘরের ছেলেগুলো যে ওর আশেপাশেই ছোঁক ছোঁক করে বেড়ায়!
শেষে ওদের একঘরে করারই মতলব কেঁদেছিল পাড়াপড়শীরা। এত বয়েস। পর্যন্ত অমন মেয়ে ঘরে পুষে রাখাটা অপরাধেরই সামিল। কত বুড়ো-হাবড়া। অন্ধ-খঞ্জ আছে, একজনের হাতে গছিয়ে দিলেই তো হয়।
বয়স্ক মাতব্বরেরা কথাটা তুলল গাঁয়ের পাটিল ও মোড়ল কেশরকরের কাছে। কেশরকর প্রায় বৃদ্ধ, কিন্তু বেশ সবল পুরুষ। মস্ত যোদ্ধাবংশের সন্তান, তাকেও বীরপুরুষ জ্ঞানে মান্যগণ্য করে সকলে। তাদের বীর-বংশের অনেক কথা আজও উপকথা হয়ে আছে। এই গুণেই গাঁয়ের পাটিল সে। গ্রামের বিপরীত প্রান্তে থাকে। দূরে থাকলেও সূর্য পাহাড়ের ধারের এক দুর্বিনীত দুরন্ত মেয়ের খবর তার কানে। আগেই এসেছিল।
এর বিহিত করতে গিয়েই এক তাজ্জব ব্যাপার ঘটল। শুনে গ্রামবাসীরা অন্তত তাজ্জব বনে গেল। পাটিল কেশরকর নিজে এলো ভবানীর অন্ধ বাপের সঙ্গে দেখা করতে, সেই সঙ্গে তার দৃপ্ত মেয়েটাকেও দেখল। ডাকতে হয় নি, বাপের বিচার হবে কথাটা কানে আসতে কোমরে হাত দিয়ে নিজেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
তারপর বৃদ্ধ মোড়লকে আরো দুই-একদিন এসে মেয়ের বাপের সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে দেখা গেল। অন্ধ বাপ তার দু-হাত ধরে আনন্দে গদগদ।
পাটিল একটা বিহিতের মতোই বিহিত করল বটে। শুনে প্রথমে হাঁ হয়ে গেল সবাই। কেশরকর নিজের ছেলে মহেশকরের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে ভবানীর।
প্রথম বিস্ময় কাটতে সকলের হাড়ে হাতাস লাগল। মেয়েটা মোক্ষম জব্দ হবে এইবার।
ঈর্ষার বদলে তাদের এই আনন্দেরও বিশেষ একটা কারণ আছে। মহেশকর বিপত্নীক। বছর দেড়েক হল, ওর বউ রাণীবাঈ আত্মহত্যা করেছে। রাণীবাঈয়ের রূপ ছিল। সেই রূপের জোরেই বোধহয় দুর্দান্ত একরোখা মহেশকরকে সে বশ করতে পেরেছিল। দুজনে দুজনকে ভালোবাসতও খুব। সেই রাণীবাঈ আত্মঘাতিনী হল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ তার নিন্দা করে নি, বরং তাকে মহীয়সী বলেছে। আত্মঘাতিনী হবার কারণ, ছেলেমানুষি কৌতূহল নিয়ে সে কার্তিক পুজো দেখে ফেলেছিল। সংস্কার, সধবা স্ত্রীলোক কার্তিক পূজো দেখলে তার অবশ্যম্ভাবী ফল বৈধব্য। রাণীবাঈ অতশত জানত না, পরে জানল। জেনে নিজের হাতে বৈধব্যযোগ খণ্ডন করে দিয়ে গেল।