রাতের ঘুম গেছে শীলাবতীরা আগের দিনের চেয়ে পরের দিন শরীর বেশি খারাপ মনে হয়েছে। কাজে মন দেওয়া শক্ত হয়েছে। জানার পর আর মহাবিহারে যাননি। সব বোঝাবুঝির
অবসান হয়েছে, সব পিছুটান গেছে। এইবার যাবেনা।
মহাবিহারে পৌঁছুলেন যখন, প্রায় বিকেল দুপুরে সামান্য বিশ্রামের সময় বলে ইচ্ছে করেই দেরিতে এলেন একটু
খুঁজতে হল না। হাসিখুশি মুখে সাগ্রহে সে নিজেই এগিয়ে এল। বলল, এবারে তুমি অনেক দিন পরে এলে মাদার।
শীলাবতীও হাসলেন।–হ্যাঁ, তুমি ভালো ছিলে?
—পার-ফেকটলি। বাট অয়্যার ইউ অল রাইট মাদার?—তার দৃষ্টিতে ঈষৎ সংশয়।
শীলাবতীর ইচ্ছে হল দুহাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টেনে আনেন। হাসিমুখে জবাব দিলেন— ভালোই তো ছিলাম—কেন, তুমি খারাপ দেখছ?
এ-প্রসঙ্গ বাতিল করে দিয়ে ছেলেটা তড়বড় করে বলল—এস, তোমাকে শোনাব বলেই এবারে অনেক নতুন কিছু স্টাডি করে রেখেছি।
দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে শীলাবতী বললেন—কিন্তু আজ তোমার সঙ্গে আমার অন্য কিছু কথা ছিল রাহুল।
ছেলেটা হাসিমাখা কৌতুকে দুই-এক মুহূর্ত দেখল তাঁকে। তারপর চিরাচরিত চঞ্চল ব্যস্ততায় বলল কথা পরে শুনব, ওদিকে আলো কমে আসছে, আগে তোমাকে দেখিয়ে শুনিয়ে দিই, নইলে টাকা আদায় করব কোন মুখে দিস টাইম অলসো আই এক্সপেক্ট এ টেন-রূপি নোটা
শীলাবতী সতৃষ্ণ চোখে চেয়ে আছেন তার দিকে। বললেন—তার থেকে অনেক বেশিই দেব।
রিয়েলি? হাউ লাকি!—খুশির আতিশয্যে মাথা ঝাঁকিয়ে পা বাড়াল, এসো শিগগির, এরপর কিছু দেখতে পাবে না, আরও আগে আসা উচিত ছিল—
অগত্যা নিরুপায় শীলাবতী অনুসরণ করলেন তাকে। সে পাথর দেখাচ্ছে, মূর্তি দেখাচ্ছে, স্থূপ দেখাচ্ছে, আর মন্তব্য জুড়ছে। কিন্তু শীলাবতীর কানে কিছুই যাচ্ছে না। তিনি শুধু দেখছেন তাকে। খেয়াল হলে মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছেন, অর্থাৎ মনোযোগ দিয়েই শুনছেন যেন তিনি। একবার শুধু তার কথা শুনে বুকের তলায় মোচড় পড়েছিল একটা। একদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে রাহুল বলছিল, ওটা অজ্ঞাতকৌণ্ডিল্যের স্থূপ—একেবারে অজ্ঞাতকুলশীল একজন তপস্যার জোরে তথাগতকে পরিতুষ্ট করেছিলেন—ওটা তাঁর স্মৃতি
ঈষৎ অসহিষ্ণু মুখে শীলাবতী বলেছিলেন—তা তো হল, আমার কথা শুনবে কখন?
হাসিমুখেই ছেলেটা নিশ্চিন্ত করেছিল তাঁকে—আমার সঙ্গে থাকলে কেউ তোমাকে যেতে বলবে না, ছটা বাজুক—এই দেখো, মৃগদাব তপোবন। এবারে কত বাড়ানো হয়েছে, আর এত হরিণও তুমি গেলবারে দেখনি মৃগদাবের গল্প জানো তো?
শীলাবতী মাথা নাড়লেন, জানেনা ছেলে আবার মহা-উৎসাহে স্তম্ভ আর মূর্তি আর সংগ্রহ বিশ্লেষণে মেতে গেল।
ছটা বাজল। ছটা পর্যন্তই নির্দিষ্ট মেয়াদ এখানকার বড় করে একটা দম ফেলল ছেলেটা। ঈষৎ শ্রান্ত মিষ্টি করে হাসল তাঁর দিকে চেয়ে বলল—আচ্ছা, এবারে এস গল্প করা যাক।
একটা বড় হলের ভেতর দিয়ে কোথায় নিয়ে চলল তাঁকে জানেন না লোকজন চলে যাওয়ায় ফাঁকা পরিবেশস্তব্ধ লাগছে।
তাঁকে নিয়ে গোটা হল পেরিয়ে আর একটা বড় হল-ঘরে এল সে। সেই ঘরে প্রায় ছাদ-ছোঁয়া বুদ্ধের এক প্রকাণ্ড মূর্তিা ছেলেটা সোজা সেই মূর্তির পায়ের কাছে বসে পড়ে সেই পায়েই বেশ আরাম করে ঠেস দিল। নরম করে একটু হেসে বলল—কাজ না থাকলে আমি এখানে বসে বিশ্রাম করি ভালো লাগে তুমি এই শিলার ওপর বোস মাদার, তারপর বল কি কথা আছে—
শীলাবতী বসলেন। কি এক অস্বস্তি যেন তাঁকে পেয়ে বসছে। তবু সঙ্কোচ করলে চলবে না। মৃদু শান্ত মুখেই বললেন তোমাকে আমি নিতে এসেছি, আমার সঙ্গে চল, আমার কাছেই থাকবে তুমি।
এটুকু মাত্র বলে নিজেই বিস্মিত তিনি। শোনামাত্র বিষম অবাক হবে ভেবেছিলেন, হতভম্ব হবে ভেবেছিলেন কিন্তু তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রাহুল হাসছে মিটিমিটিা তার মুখে চোখে অপ্রত্যাশিত কিছু শোনার চিহ্নমাত্র নেই এমন সুন্দর হাসিও শীলাবতী আর যেন দেখেননি।
একটু অপেক্ষা করে খুব সহজ মুখে রাহুল বলল—মাদার, তুমি কে আমি জানি। গেল বারে মিস্টার আচার্য বলেছেন। আমার বাবা কে বলেননি, কিন্তু তোমাকে তিনি চিনিয়ে দিয়ে গেছেন। তুমি একদিন এই ইচ্ছে নিয়ে আসবে জেনেই হয়ত তিনি জানিয়ে রাখা দরকার মনে করেছিলেন–
আশায় আশঙ্কায় শীলাবতীর সর্বাঙ্গের স্নায়ুগুলি কাঁপছে থরথর করে জীবনের চরম কথা অথবা পরম কথা—যা হোক একটা কিছু যেন তিনি শুনবেন এক্ষুনি।
বুদ্ধের মসৃণ পায়ের দিকটায় হাত বুলোতে বুলোতে খুব মিষ্টি করেই রাহুল আবার বলে গেল —দেখো মাদার, জন্মের পর থেকে এত বড় বঞ্চনারও এতটুকু দাগ লাগেনি যাঁর দয়ায়, এই বয়সে তাঁর পায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে আজ আর কতটুকু আশ্রয় তুমি আমাকে দিতে পারো বলো। তুমি কষ্ট পেও না, আমি খুব ভালো আছি। আমাকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে তুমি নিরাশ্রয় করতে চেও না মাদার।
উঠল। শান্ত মুখে আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল সে।
শূন্য ঘর। …সমুন্নত বিশাল-বক্ষ প্রসন্ননেত্র শিলাময় অমিতাভ মূর্তি।
সামনে চিত্রার্পিতা শীলাবতী।