একটা সামান্য চাকরি সংগ্রহ করে শীলাবতী বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন কিন্তু শঙ্কর আচার্য পরিত্যাগ করতে চাননি তাঁকে। স্থির সঙ্কল্প নিয়েই এসেছিলেন। ত্যাজ্যপুত্র হবেন, এতবড় বিষয়-আশয় থেকে বঞ্চিত হবেন—বাপের এই ঘোষণারও পরোয়া করেননি। কিন্তু শীলাবতী রাজি হননি শান্ত, দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন—তোমাকে আমি কোনোদিন চিনতে ভুল করিনি, তবু এখানেই এর শেষ হোক।
তাঁকে বোঝানো সম্ভব হয়নি।
শেষ সেখানেই হল না নিজের দেহের অভ্যন্তরেই নতুন বারতার সূচনা উপলব্ধি করলেন কিছুদিন যেতে না যেতো আগন্তুক আসছে। শীলাবতী এইবার বিচলিত হলেন একটু নতুন করে মনস্থির করতে হল আবার শঙ্কর আচার্যকে ডেকে পাঠালেন।
শুনে শঙ্কর আচার্য আর এক দফা মত বদলাতে চেষ্টা করলেন শীলাবতীরা অনেক অনুরোধ করলেন, অনেক অনুনয় করলেন, রাগ অভিমান পর্যন্ত করলেন। কিন্তু বিয়েতে রাজি করাতে পারলেন না তাঁকে। শীলাবতীর এক কথা, যে আসছে তার ব্যবস্থার ভার শুধু তুমি নাও, নিয়ে আমাকে মুক্তি দাও তোমাকেও আমি তার সঙ্গে জড়াতে বলছি না, তোমার অর্থের জোর আছে, অনেক রকম ব্যবস্থাই তোমার পক্ষে সহজ।
যথাসময়ে সন্তান এসেছে। নির্মম শান্ত চিত্তে শীলাবতী আটদিনের ছেলেকে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন। বলেছেন, তোমাকে আমি শ্রদ্ধা করি, তোমার ওপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। তুমি যে ব্যবস্থা করবে তাই ওর পক্ষে ভালো বলে ধরে নেব।
এর পর অনেকদিন আর শঙ্কর আচার্য তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি। তবু একদিন শীলাবতীর কানে খবর এল একটা শঙ্কর আচার্যের বাবা তাঁকে বিষয়-আশয় থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত করেছেন নাকি তাঁর বিশ্বাস, তাঁর অবর্তমানে ছেলে শীলাবতীকেই ঘরে এনে তুলবো শীলাবতী ভেবেচিন্তে একটা চিঠি লিখলেন শঙ্কর আচার্যকে। লিখলেন, আমাকে যদি ভালোই বেসে থাক কোনোদিন, বোকামি করে এত বড় শাস্তি তুমি আমার মাথায় চাপিয়ে দিও না। আমার কাজের ব্রত পণ্ড কোরো না, কাউকে ঘরে এনে তার প্রতি সুবিচার করলে আমিই সব থেকে খুশি হব!
তারপর শঙ্কর আচার্য বিয়ে করেছেন, খবরটা পাওয়া মাত্র শীলাবতীর বুক থেকে মস্ত একটা বোঝা নেমে গিয়েছিল যেন।
দু বছর চার বছর বাদে এক-একবার দেখা হয়েছে তাঁদের আশ্চর্যরকম সহজ হতে পেরেছেন দুজনেই। গোড়ায় একবার মাত্র ক্ষণিকের জন্য এক শিশুর প্রসঙ্গে ঈষৎ কৌতূহল দেখা দিয়েছিল শীলাবতীরা শঙ্কর আচার্য হাসিমুখে বলেছিলেন, জানতে চেও না। তার পক্ষে যা ভালো তাই করেছি।
দশ বারো বছর বাদে শীলাবতী হঠাৎ আর একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন—সত্যি আছে, না। গেছে?
—আছে। ভালোই আছে। কিন্তু আজ তোমার দুর্বলতা দেখলে আমি রাগ করব।
শীলাবতী তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংযত করেছেন। কঠিন তাড়নায় নিজেকে কর্তব্যের পথে টেনে নিয়ে গেছেন। অবকাশ কখনো চাননি। অবকাশ শত্রু।
বছর তিনেক আগের কথা মহাবিহারে এসেছিলেন সঙ্গে শঙ্কর আচার্য ছিলেন। এই বয়সে নির্লিপ্ত সহজ মেলামেশাটা আরো সহজ হয়েছে।
এত গাইডের মধ্যে শঙ্কর আচার্য খুঁজে পেতে ওই রাহুলকে বার করলেন। ছেলেটা তাঁকে খুব ভালো করে চেনে আর ভক্তিশ্রদ্ধাও করে মনে হল হঠাৎ কি মনে হতে হৃৎপিণ্ডের রক্তচলাচল থেমে আসার উপক্রম শীলাবতীর ছেলেটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে অন্তস্তলে এমন একটা আলোড়ন উঠল কেন তাঁর! এই ঈষৎ চঞ্চল মিষ্টি কচিমুখখানা বড়ো কাছের, বড়ো আকাঙ্ক্ষার এক স্বপ্নের চেনা বলে মনে হল কেন তাঁর! শঙ্কর আচার্যের মুখের অভিব্যক্তি যেন অন্যরকম।
সম্ভাবনাটা সমূলে বাতিল করতে চেষ্টা করলেন শীলাবতী। অসম্ভবই ভাবলেন। কিন্তু ছেলেটাকে ভারি ভালো লাগল তাঁর। চটপটে, ফটফটো মুখে হাসি লেগেই আছে—আর অনর্গল। কথা
সাহস করে গাইড প্রসঙ্গে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করলেন না শীলাবতী যা ভাবছেন, সত্যি ততা নয়ই, উল্টে যে দুর্বলতা প্রকাশ পাবে, তা হয়ত আর গোপন করা সম্ভব হবে না।
কিন্তু বাড়ি ফিরে একটা অস্বস্তিই বড়ো হয়ে উঠতে লাগল আবার। শঙ্কর আচার্য বেছে বেছে ওকেই ডাকলেন কেন? সকৌতুকে বার বার তাঁকেই দেখছিলেন কেন? কিছুকাল বাদে আর এক ছুটিতে শীলাবতী একাই এলেন মহাবিহারে। খুঁজে খুঁজে ওই গাইডকেই বার করলেন। দিব্বি আলাপ জমে উঠল সেবারে।
এরপর মাঝে মাঝেই আসতে লাগলেন তিনি। কয়েকদিনের ছুটি পেলেই আসেন। কি এক অদৃশ্য আকর্ষণ তাঁকে টেনে টেনে আনো ছেলেটা মাদার মাদার’ বলে হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ায়। শীলাবতী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সে ইংরেজি বলে কেন, মাতৃভাষা জানে না?
ছেলেটা হেসে বলেছিল, জানো তবে ছেলেবেলা থেকে মিশনে মানুষ বলে ইংরেজি বলতেই সুবিধে হয় আরো হেসে মন্তব্য করেছিল, তোমাদের মতো শিক্ষিত দর্শকদের কাছে তার কদরও বেশি হয় মাদার।
ধারণাটা ক্রমশ বদ্ধমূল হয়ে আসছিল শীলাবতীর। তাঁর ঘরে ওর ছবি দেখেও তো অনেকে জিজ্ঞাসা করছে, কে হয়? তারা তো কিছু কল্পনা করে নি, তারা মিল দেখে কি করে?
আর সহ্য করতে না পেরে শেষে শঙ্কর আচার্যকে চিঠি লিখলেন সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন, তাঁর ধারণা সত্যি কি না।
দিনকয়েক বাদে জবাব এল, সত্যি।
এই কটা দিন অধীর আগ্রহে উন্মুখ হয়ে ছিলেন শীলাবতী। জবাব পাওয়ামাত্র দেহের সমস্ত রক্ত যেন মুখের দিকে ছোটাছুটি করতে লাগল। আত্মস্থ হওয়ার পর প্রথমেই ভয়ানক রাগ হল শঙ্কর আচার্যর ওপর অন্যের কাছে হাত পেতে জীবিকা অর্জনের পথে ঠেলে দিয়েছেন বলে জীবনে আর যেন ক্ষমা করতে পারবেন না তাঁকে। অথচ মন বলছে, ওই পথে এসেছে বলেই ছেলেটার অমন সুন্দর অমলিন মুখ আজওা দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।