কিন্তু সে সব অনেক পরের কথা। তার অনেক আগে ভবিতব্যের কথা। মেয়ে সুশ্রী, চৌদ্দ বছরে বিয়ে দিয়েছিলেন। এক বছর না ঘুরতে ঝড়জলে নৌকাডুবি হয়ে তরতাজা জামাই খোয়ালেন তিনি। পনের বছরের মেয়ের বৈধব্য দেখলেন। তাও সহ্য করলেন।
গঙ্গার গর্ভে যাঁকে হারালেন, তাঁকে ভালো করে চেনা হয়নি শীলাবতীর। কিন্তু প্রায় পনের বছর বাদে এক বিচিত্র গোধূলিতে সেই গঙ্গার বুকেই যে একজনকে পেলেন, তাঁকে একেবারে হেঁটে দিতে কেনোদিনই পারেননি শীলাবতী। আগেও না, পরেও না।
তিনি শঙ্কর আচার্য।
অবস্থাপন্ন, রক্ষণশীল উত্তরপ্রদেশীয় পরিবারের ছেলে। বাড়িতে বারো মাসে তেরো পার্বনের প্রচলন।
দূর সম্পর্কের আত্মীয় শীলাবতীদের। শীলাবতীর বাবা তাঁদেরই অনুগৃহীত ছিলেন। একই বাড়িতে এক বিচ্ছিন্ন অংশে থাকতেনা শীলাবতী বিধবা হবার পর সেই বাড়ির কৃতি সন্তান শঙ্কর আচার্যই একটা অবলম্বনের পথ দেখালেন শঙ্কর আচার্য তখন বাইশ তেইশ বছরের তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন বিশেষ। তাঁর আগ্রহে উৎসাহে উদ্দীপনায় হতাশার মধ্যে একটুকরো আলো দেখলেন দুঃখী পরিবারটি শীলাবতীর পড়াশুনা চলতে লাগল।
আচার্য-গৃহে একটা চাপা সংশয় দেখা গেল আরো সাত-আট বছর পরে কুলের গৌরব অমন হীরের টুকরো ছেলে বিয়ে করতে চায় না কেন? শঙ্কর আচার্য তখন অধ্যাপনা করেন। ছোট এক ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল, কিন্তু তিনি বিয়ের কথা কানেও তোলেন না। আরো তিন চার বছর বাদে বাড়ির লোকের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হল বত্রিশ তেত্রিশ বছর বয়সেও ছেলেকে বিয়েতে রাজি করানো গেল না।
চেষ্টা শীলাবতীও করেছেনা বলেছেন—ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না। পাঁচজনে পাঁচ রকম ভাবছেন তাঁর বিয়ে করা উচিত। তাঁর জীবনে শঙ্কর আচার্য বিধাতার পরম আশীর্বাদের মতোই এসেছেন, কেউ তাঁকে হেয় চোখে দেখলে তাঁর পরিতাপের সীমা থাকবে না।
শঙ্কর আচার্য এ-কথাও কানে তোলেন নি। প্রথমে বলেছেন, ও-সব ঝামেলা পোয়ানোর সময় নেই তাঁর। পরে সরাসরি বলেছেন, তিনি পৈতৃক সম্পত্তির প্রত্যাশা রাখেন না, বিধবা বিবাহ করলে আপত্তি কি?
শুনে শীলাবতী কানে আঙুল দিয়েছেন। পরে তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কথা তুললে শঙ্কর আচার্য ওই এক কথাই বলেন। শীলাবতীকে বেশি বিরূপ হতে দেখলে বলেন, একটা সমস্যাকে বড় করে তুলে লাভ কি, তার থেকে আমি যেমন আছি থাকতে দাও—বিয়ে না করলেও মানুষের দিন কাটো
তা-ই কাটতে লাগল। এরও তিন বছর বাদে শীলাবতীর শেষ পরীক্ষা হয়ে গেল। আশাতীত ফলের ঘোষণা যেদিন কানে এল, কৃতজ্ঞতায় শীলাবতীর দুচোখ ছলছল করে উঠেছিল। এই সাফল্যের ষোল আনাইকার প্রাপ্য, এ তাঁর থেকে ভালো আর কে জানে?
সেইদিনই শঙ্কর আচার্য এক সময় তাঁকে জানালেন, কিছু আলোচনা আছে। ব্যবস্থামতো এক জায়গায় সাক্ষাৎ হল দুজনার। তখনো সন্ধ্যা হয়নি। কি ভেবে শঙ্কর আচার্য একটা নৌকো ভাড়া করলেন এই দূরের এলাকায় কেউ তাঁদের চিনবে না। তাছাড়া একটু বাদেই দিনের বিদায়ী আলো নিশ্চিহ্ন হবে।
কিন্তু কথা কিছু হল না। মুখোমুখি দুজনে চুপচাপ বসে রইলেন মাঝি তার ইচ্ছেমতো নৌকা বেয়ে চলল।
অনেকক্ষণ বাদে শীলাবতী জিজ্ঞাসা করলেন, কি বলবে?
শঙ্কর আচার্য হেসে বললেন—অনেক বলব, অনেক বোঝাব ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কিছুই বলার নেই, কিছুই বোঝাবার নেই। যা-ই বলি, ঘুরে ফিরে সেটা এই ভেসে বেড়ানোর কথাই।
সমস্তক্ষণের মধ্যে আর কথা হয়নি। দুজনে মুখোমুখি বসেছিলেন—মাঝে বেশ খানিকটা ব্যবধান দুজনে দুজনকে এক-একবার দেখেছেন শুধু।
কিন্তু সেদিন আকাশে ষড়যন্ত্র ছিল বাতাসে জাদুর মোহ ছিল। ভরা জ্যোৎস্নার থালার মততা। চাঁদের বুকে সব-খোয়ানোর ইশারা ছিল সেই জ্যোৎস্না-ধোয়া জলের কলকাকলিতে সর্বনাশা কানাকানি ছিল।
শঙ্কর আচার্য হাত ধরে নৌকা থেকে নামালেন যখন, শীলাবতী তখনো আত্মবিস্মৃত, বিহুল। হাতের স্পর্শেও সর্বাঙ্গ থর থর কেঁপে উঠল।
তারপর রাত্রি নিঝুম, নীরব রাত্রি। দরজায় মৃদু শব্দ হল শীলাবতী চমকে উঠলেন। দুই কান উৎকর্ণ। তিনি জানতেন কেউ আসবে। তিনি জানতেন বন্ধ দরজা খুলে দিতে হবে।
খুলে দিলেন।
এই রাতের যৌবন-বাস্তবের আগন্তুককে ফেরাবার সাধ্য তাঁর নেই। ফেরাবার ইচ্ছেও নেই। সেই বিহুলতার মধ্যেই একে একে আরো অনেকগুলো রাত কেটে গেল। দিনের অবসানে উন্মুক্ত দুটি হৃদয়ের একটি প্রতীক্ষা। রাতের প্রতীক্ষা।
এর পর শঙ্কর আচার্যই আত্মস্থ হলেন প্রথমে তিনি ঘোষণা করলেন শীলাবতীকে বিবাহ করবেন।
বনেদী রক্ষণশীল সংসারে যেন বাজ পড়ল একটা শঙ্কর আচার্যর বাবা নির্মম হয়ে উঠলেন। এদিকে তেমনি বজ্রাহত হয়ে ছিলেন শীলাবতীর বাবা। তার ওপর বুকে অপমানের শেল বিদ্ধ হল। বৃদ্ধ প্রভু আচার্য বড়ো নির্মম ভাবে তাঁকে শাসালেন, বিশ্বাসঘাতক বেইমান বললেন, সেই মুহূর্তে মেয়ে নিয়ে তাঁকে দূর হয়ে যেতে বললেন।
সেই মুহূর্তে না হোক, দুদিনের মধ্যে শীলাবতীর বাবা বড়ো আঘাত নিয়ে এই জগৎ-সংসার থেকেই দূর হয়ে গেলেন। ব্লাডপ্রেসারের রোগী, কটুক্তি শুনতে শুনতেই এক সময় মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন মৃত্যুর দু ঘণ্টা আগে একখানা হাত তুলে কিছু যেন নিষেধ করতে চেষ্টা করেছিলেন শীলাবতীকে। সেটা আর কেউ না বুঝুক শীলাবতী বুঝেছিলেন।