মুখের দিকে চেয়েছিলেন শীলাবতী, হেসেছিলেনও হয়ত একটু আর অল্প ঘাড় নেড়েছিলেন। অর্থাৎ তাতে হবে না।
ছেলেটা বিব্রত হয়েছিল, আবার একটু খুশিও হয়েছিল।
—ওয়েট হিয়ার, লেট মি সি।
একটু বাদে দর্শকদলটিকে অন্যের হাতে গছিয়ে দিয়ে সে ফিরে এসেছিল।
—কাম অন মাদার, আ-অ্যাম ফর ইউ নাও।
সেদিন শীলাবতী ইচ্ছে করেই ছেলেটাকে জ্বালিয়েছিলেন একটু এখানে যত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে এক বছর ধরে তার বিবরণ শুনলেও ফুরাবে না। তাঁর প্রদর্শক যে-গল্পই ফেঁদে বসে, শীলাবতী বাধা দেন, বলেন—সত্যের মধ্যে তুমি গল্প মেশাচ্ছ, আমি তো শুনেছি এটা এই, এটার এই-এই ব্যাপার–
বারকয়েক থমকে গিয়ে ছেলেটা ঈষৎ বিস্ময় মেশানো কৌতুকে নিরীক্ষণ করেছে তাঁকে। — আর ইউ এ হিস্টোরিয়ান মাদার?
ইতিহাসে বিশেষজ্ঞা তিনি, সেটা আগে কখনও প্রকাশ পায়নি। আগে কান পেতে তিনি ছেলেটার কথাগুলো আস্বাদন করেছেন শুধু, তাৎপর্য খোঁজেননি সেদিনও প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে হাসিমুখে বলেছিলেন—কেন, আমার মতো দর্শককে বোঝাতে গিয়ে খুব সুবিধে লাগছে না বুঝি?
অপ্রতিভ না হয়ে ছেলেটা দিব্বি হেসেছিল, বলেছিল—তা কেন, তোমাদের ওই শুকনো ইতিহাস আওড়ালে এখানে লোক আসা ছেড়ে দেবে আর আমাদেরও উপোস করে মরতে হবে
—তা বলে লোককে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলবে, সত্যি বলবে না?
বড় বিচিত্র জবাব দিয়েছিল ওই দুষ্টু ছেলেটা এখনো কানে লেগে আছে। মুখের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসেছিল আর বলেছিল। এই বানানো গল্পই আমরা সত্যি বলে বিশ্বাস করি, আর লোকেরও বিশ্বাস করতে ভালো লাগে মাদার। ভগবানের মহিমা বলার মধ্যে আবার মিথ্যা কি আছে! তাছাড়া, তোমার ওই ইতিহাস যারা লিখেছে, তারা সব নির্জলা সত্যি লিখে গেছে, তাই বা কি করে জানলে?
এরপর শীলাবতী আর একটাও তর্ক তোলেননি।
আবার হাসি পাচ্ছে। বিদায়ের আগে ছেলেটা মুখখানা গম্ভীর করে তুলতে চেষ্টা করে অসঙ্কোচে বলেছিল—তোমার জন্য একটা বড় দল হাতছাড়া করেছি মাদার, দিস টাইম ইউ সুড গিভ মি এ টেন-রুপি নোট।
টাকা আদায়ের বেলায় ছেলে লাজ-লজ্জার ধার ধারে না। ফস ফস করে বলে বসে ছদ্ম বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলেছিলেন শীলাবতী পাঁচ থেকে একেবারে দশ! কেন, অত টাকা দিয়ে কি হবে?
তক্ষুনি বুঝেছে পাবে। তাই জোর দিয়ে বলেছিল—তোমাদের কাছে আবার অত কি মাদার। কিছু বেশি পেলে একটু ভালো থাকতে পারি, একটু ভালো খেতে পাই, একটু ভালো পরতে পারি—অথচ ও-কটা টাকা তোমাদের কাছে কিছু নয়।
শীলাবতী ওর হাতে একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলেন সেদিন বুকের হাড়-পাঁজর টনটনিয়ে উঠেছিল। আজ হাসছেনা আজ নিজের সঙ্গে সব বোঝাপড়া শেষ বলেই হাসতে পারছেন। অস্ফুটস্বরে নিজের মনেই বলছেন কিছু বলছেন, রক্তে লেগে আছে সুখের স্বাদ, ভালো থাকতে খেতে পরতে চাইবে না কেন? দেখি এবার থেকে কত সুখে থাকতে পারিস তুই, আর তোকে লোকের কাছে হাত পেতে বেড়াতে হবে না।
বাড়ি।
গাম্ভীর্যের বর্ম-আঁটা কত্রীর বদলে এইদিনে একখানা হাসিখুশি মুখ দেখবে, বাড়ির পরিচারক পরিচারিকা কটিও আশা করেনি হয়ত আরো বিস্মিত হল, কত্রী তাদের ঘরে ডেকে এনে ভারি সদয় মুখে দু মাসের করে মাইনে আগাম দিয়ে বিদায় দিলেন যখন। এই রাত পোহালে তারা অন্য কাজ দেখে নেয় যেন, তিনি এখান থেকে চলে যাচ্ছেন।
জিনিস-পত্র একরকম গোছগাছ করাই ছিল। স্যুটকেসটা গুছিয়ে নিলেন আর যা থাকল, সকালেই হয়ে যাবে। স্যুটকেস থেকে শীলাবতী তাঁর তরুণ গাইডের ছবিটা বার করে টেবিলে রাখলেন। হাসছেন মুখ টিপে। গাইডই বটে। বাকি জীবনটা ওই ছেলের সর্দারীতে চলতে হবে। ছেলেটাও যেন তাই বুঝেই হাসছে তাঁর দিকে চেয়ে।
ছবিটা অনেকদিন আগে শীলাবতী নিজের হাতে তুলেছিলেন ওর পরিচয় সম্বন্ধে একেবারে নিঃসংশয় হবারও আগে ওকে দেখে অনেক সম্ভব-অসম্ভব যখন মনের মধ্যে ভিড় করে আসত, তখন ওকে দেখলে কবেকার কোন বিস্মৃত উৎসে যখন বান ডাকত, তখন ওর মুখের দিকে চেয়ে হাসলে বুকের শুকনো হাড়পাঁজরে যখন সুখের প্রলেপ লাগত, তখন।
তিন বছর আগে এই ছবি যে তিনি তুলে এনেছিলেন সেটা শঙ্কর আচার্যও জানতেন না যিনি অনেক প্রত্যাশীকে বাতিল করে এই গাইড তাঁকে ঠিক করে দিয়েছিলেন। আর সে-সময়ে কিছু গোপন করার জন্য যিনি সন্তর্পণে এক ছদ্ম গাম্ভীর্যের বিবরে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করেছিলেন।
ছবিটা তুলে এনে শীলাবতী এই ঘরের এই টেবিলেই রেখেছিলেন। দেখে পরিচিতেরা জিজ্ঞাসা করেছেন, এ কে?…কেউ বা সমনোযোগে দেখে শুধিয়েছেন, ছোট ভাই-টাই কেউ নাকি, অনেকটা আপনার মতোই মুখের আদল—
না, তখনো শঙ্কর আচার্য তাঁকে বলেননি এ কে। কিন্তু মর্মস্থলের অনুভূতি দিয়ে যা বোঝবার শীলাবতী বুঝে নিয়েছিলেন অতিথি অভ্যাগতদের প্রশ্ন এবং মন্তব্য শুনলে আশায় উদ্দীপনায় তাঁর মুখ লাল হত। গাম্ভীর্যের আড়াল নিতে হত তাঁকেও।
শীলাবতীর জীবনে দুটো ঝড় গেছে। একটা ছোট, একটা বড়। যাঁকে কেন্দ্র করে ওই বড় ঝড়, তিনি শঙ্কর আচার্য।
যা হবার কথা নয়, শীলাবতীর জীবনে একে একে তাই হয়েছে। তাই ঘটেছে। ব্লাডপ্রেসারে কাবু দরিদ্র ইস্কুল মাস্টারের পনের বছরের বিধবা মেয়ে সসম্মানে এম. এ. পাশ করে নিজের দু পায়ে ভর করে একদিন সোজা হয়ে দাঁড়াবে—সে আশা সেদিন সুদূর স্বপ্নের মতো ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন সত্য হল যখন, তখন এক মর্মান্তিক আঘাতে বুক ভেঙে গেল তাঁরা সেই ভাঙা বুক আর জোড়া লাগেনি।