তাছাড়া বছর দশেক ধরেই তো ভাবছে বিমল, বুড়ো মেরে খুনের দায়ে পড়ে লাভ কী? নিজে থেকেই তো চেয়ার খালি করে দিয়ে যাবে বুড়ো। কিন্তু কই?
বৌ মরার পরও নির্মল ডাক্তার অনেকদিন বেঁচেছিলেন, চেম্বারেও আসতেন। সত্যভূষণও নিয়মিত সময় এসে নিজস্ব চেয়ারটিতে বসে থাকতেন।
বুড়ো কেষ্ট কোথা থেকে যেন চা নিয়ে আসতো, ধরে দিত দুই বন্ধুর সামনে, আর অনেকক্ষণ পরে খালি পেয়ালা নিয়ে যেতে এসে তাড়া দিয়ে বলতো, কী বাবু, চা খান নি এখনও? পান্তো হয়ে গেল যে?
কতদিন হয়তো সত্যিই এমন পান্তো হয়ে যেত যে আর খাওয়াই হত না।
বিমল তখন নতুন ডাক্তার হয়ে হাউস সার্জেনের কাজ করেছে। দু-একটা সরকারি হাসপাতালে কিছু কিছুদিন চাকরী করেছে, তারপর দেশেই এসে গুছিয়ে বসেছে।
নির্মল প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন তখন, তবু চেম্বারে এসে বসে থাকতেন, সত্যভূষণও।
.
…তা এসবও তো বহুদিনের কথা।
এখন বিমল ডাক্তারেরই মাথার চুল বেশির ভাগই সাদা।..সত্যভূষণের সমসাময়িক আর কেউ নেই গ্রামে, নির্মল তো কবেই গিয়েছেন। কিন্তু সত্যভূষণের নিয়মের নড়চড় নেই।
তিনি যথা নিয়মে যথা সময়ে এসে নিজের চেয়ারটিতে বসে থাকেন, আশি বছরের জীর্ণ দেহটায় প্রায় ততটাই জীর্ণ এক গলাবন্ধ কোট আর একখানা মলিন ধুতি চাপিয়ে। এসে চুপচাপ বসে থাকেন, মাথাটা ঝুঁকিয়ে দু-হাঁটুর মধ্যে তালিমারা ছাতাটা চেপে ধরে।
চেয়ারটা অবশ্য আর আগের জায়গায় নেই, কোণঠাসা হয়ে গেছে, চায়েরও প্রশ্ন নেই এখন আর, তবু সেই সকাল বেলাই চলে আসা চাই।
দেখলেই মাথা জ্বলে ওঠে বিমল ডাক্তারের। কী কুদৃশ্য, কী অরুচিকর!…কত অভিজাত অভিজাত রোগী আসে তার কাছে, কত বড় বড় লোক। তাদের সামনে কিনা ওই একটা অর্থহীন অবাক কুশ্রী দৃশ্য।
ঘাড় ঝুঁকে পড়া ঘোলাটে চোখ, ময়লা নোংরা পোশাক পরা একটা জরাজীর্ণ বুড়ো, প্রতিদিন ডাক্তারের চেম্বারে বসে থাকে কেন? এ প্রশ্ন উঠবে না তাদের মনে?
কেউ কেউ বলাবলি করে পয়মন্ত ফয়মন্তর ব্যাপার নয় তো? কেউ কেউ বলে ওই বুড়োই চেম্বারের মালিক নয়তো? শেকড় গেড়ে বসে থাকে কমিশনের হিসেব ঠিক রাখতে?
যারা জানে তারা জানে লোকটার এটা স্রেফ নেশা। অদ্ভুত এক নেশা। মা এসে থাকতে পারে না। এই দরজা আর ওই চেয়ার ওকে টানে।
কিন্তু ক্রমশই সহ্যের সীমা অতিক্রম করছে বিমল ডাক্তারের। সাদা তালিমারা কালো ছাতাটাকে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে আসতে দেখলেই সর্বাঙ্গে বিষ ছড়ায়, মাথা জ্বালা করে।…একটা লোক অকারণে পৃথিবীতে মৌরুসিপাট্টা নিয়ে বসে আছে এটাইতো অসহ্য, তার উপর সেই লোক যদি ঘাড়ে এসে বসে থাকে, তাহলে?
খাচ্ছে না পরছে না কিছুই করছে না ঠিকই, কিন্তু দৃষ্টিশূল হয়ে বসেই বা থাকবে কেন?
আগে আগে তা কখনও সখনও সৌজন্য করে বলেছে বিমল, কী জেঠু, আছেন কেমন?
কিন্তু তার উত্তরে যদি বুড়ো বিগলিত মুখে এক গঙ্গা কথা বলতে শুরু করে, কার আর পুনর্বার সেই সৌজন্য করতে ইচ্ছে করে?
তবু ভাগ্যি বাল্যকালের জের টেনে তুই টুই বলতে আসে না। তুমিই বলে।
সব থেকে খারাপ লাগে, যখন কেউ জিগ্যেস করে, ভদ্রলোককে তো রোজই দেখি, ওনার অসুখটা কী?
রোগীই ভাবে তারা সত্যভূষণকে।
বিমল ডাক্তার বলে, অসুখ আর কিছুই নয়, বয়েস! ওর আর কী সারাবো বলুন?
বয়েস তো অনেক হয়েছে মনে হয়।
আমি তো জ্ঞানাবধিই এই রকম দেখছি। বলে, অবলীলায় বলে।
যেন জ্ঞানোন্মেষের সঙ্গে সে ডাকতে আসতো না, জেতু, মা ডাকতে, দলকাল আতে।
যেন সত্যভূষণকে সেই অদম্য শক্তি নিয়ে চরকি পাক খেয়ে বেড়াতে দেখে নি বিমল। যেন, আইনের এক ফুঁয়ে জমিদারের কাছারি বাড়ি উপে গিয়ে শক্ত সামর্থ মানুষটাকে বেকার করে দেওয়ার দৃশ্য দেখে নি সে।..
কিন্তু অত কথা কে বলতে যায়?
আচ্ছা, বুড়ো হয়ে কি এতই অবোধ হয়ে গেছেন সত্যভূষণ যে, বিমলের এই জ্বলন্ত বিরক্তিটা বুঝতে পারেন না, এটা তো তার গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দেবার মত!
.
এসে বসে থেকে নিঃশব্দে একসময় উঠে যাওয়া, এরমধ্যে কী সুখই বা পান? কতদিন আগে যেন বলতেন, কী বিমল কাজকর্ম কেমন চলছে?..বলতেন, ডাক্তারী একটা মহৎ প্রফেশন বিমল। তোমার বাবা বলতো, ডাক্তারীটা পেশা বটে, কিন্তু ব্যবসা নয়,–এর মূল মন্ত্র মানুষের সেবা।
তখন হয়তো সুখ ছিল, কিন্তু এখন? এখন তো আর বিমল বলে ডেকে কথা বলা যায় না ওই বিরক্ত বেজার আর দাম্ভিক লোকটাকে!
আর এখন এ প্রত্যাশাও তো নেই, ওই কর্মব্যস্ত গম্ভীর মানুষটা আর কোনদিনও চোখের কোণে একটু তাকিয়ে বা না তাকিয়ে যান্ত্রিক গলাতেও একবার বলবে, জেঠু যে! আছেন কেমন? অথবা আঃ আবার এভোটা রাস্তা হেঁটে এসেছেন? এত হাঁটাহাঁটির কী দরকার?
কিংবা ভুলেও একবার অনেকদিন আগের মত বলে ফেলছে না, চা খেতেন নাকি? হচ্ছিল।
তবে?
তবে কেন আসেন? এখন তো চোখের উপর জালচাপা, এখন তো আর বিমল ডাক্তারের চলন বলন, কথার ধরণ, দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে মিলিয়ে দেখতে বসতে পারেন না ওর ভঙ্গিটা বাপের মত, না মায়ের মত।
এখন তো শুধু নিশ্বাস ফেলে ভাবেন, ছেলেটা মা বাপ কারুর মত হল না কেন?
তবু আসা ছাড়া উপায় নেই।
রাত পোহাতে না পোহাতে কে যেন লক্ষ্যবাহু দিয়ে এই দিকে টানে। যেন এই জন্যেই এখনও পৃথিবীতে টিকে থাকা।