নির্মল ডাক্তার কোনও কিছুতে তাকিয়ে না দেখলেও এদিকে কখনও চোখ পড়ে গেলে, বলতেন, তুমি দেখছি আমার মান মর্যাদা কিছু রাখলে না! লোকে দেখলে বলবে কি? নির্ঘাৎ ভাববে কিপটে ডাক্তার তোকজনকে মাইনা কড়ি দিতে নারাজ, তাই পরিবারকে দিয়ে ঝি খাটুনি খাটায়
পরিবার সে কথা নস্যাৎ করতো। বলতো, নিজের সংসারের খাটুনি খাটছি বই তো অপরের সংসারের খাটুনি খাটতে যাই নি। লোকের বলায় কান দিতে নেই। উল্টোটা হলে হয়তো বলবে–অমুক ডাক্তার পরিবারকে কাঁচের আলমারিতে সাজিয়ে রেখেছে, হাত পা নাড়াতে দেয় না।
.
বন্ধুপত্নীর এই মনোভাবটি সত্যভূষণের কাছে বিশেষ প্রশংসনীয় ছিল। ওই অগাধ কর্মশক্তি এবং সদা প্রসন্নচিত্ত, সত্যভূষণের চিত্তকে শ্রদ্ধায় সমীহে বিগলিত করে রাখত।
কিন্তু এ সবই তো বন্ধুর সংসারের ব্যাপার, সত্যভূষণের নিজের সংসারের খবরটা কী?… তা, সে খবরটা বড় শাদা মাঠা বর্ণ-বৈচিত্রহীন।
বিধবা মা আর দুই দাদাবৌদি এবং তাদের ছানাপোনা এই নিয়ে সত্যভূষণের সংসার। নিজে, ওদিক দিয়ে যান নি। জ্ঞানোন্মেষ থেকে দেখে এসেছেন, সংসারের কাজ নিয়ে সারাক্ষণই সংসারের বাতাস উত্তাল। মহিলাকুলের মধ্যে কে কম কাজ করল, আর কে বেশি কাজ করল, এই প্রশ্নে সবাই মুখর। আগে দেখেছেন সংঘর্ষ মাতে কাকিমাতে, অতঃপর কাকা কাকিমা ভিন্ন হয়ে গেলে, মাতে বড়বৌদিতে, অতঃপর মা অশক্ত হয়ে যাওয়ায় বড়বৌদি আর ছোট বৌদিতে। ক্রমশ দেখেছেন আবার দাদার বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি এসে পড়া আঠারো বছরের মেয়েটাকেও সেই সম্মুখ সমরে যোগ দিতে।
এই দেখে দেখেই যে বিয়ের বাসনা চলে গিয়েছিল তার, একথা স্পষ্টই ঘোষণা করতেন সত্যভূষণ, বলতেন, রক্ষে করো মধূসুদন, তোমাদের সংসারলীলা দেখে দেখেই সংসার সাধ ঘুচে গেছে আমার।
ডাক্তার বৌয়ের প্রতি অত শ্রদ্ধা প্রীতি সম্মান স্নেহের কারণও হয়তো ওর ওই হাস্যবদনে পাহাড় ভাঙার ক্ষমতা দেখে। সর্বদাই তো তুলনামূলক ভাবে চিন্তা করেছেন, এত খাটে নির্মলের বৌ, কই কখনও তো ব্যাজার দেখি না। আর মন্তব্য করছেন, মানুষের মত মানুষ একটা।
.
অবোধ পুরুষ একথা চিন্তা করে দেখবার বুদ্ধি হয়নি, এই বিড়ালই বনে গেলে বনবিড়াল হত কিনা। জা শাশুড়ীর এক্তারে ভাগের কারবারে খাটতে হলে, আমার এত কী দায় বলে পা ছড়িয়ে বসে থাকত কিনা, সত্যভূষণের ছোট বৌদির মত। ভেবে দেখেন নি কোনদিন।
নির্মল ডাক্তার বসতবাড়ির ভাগ না নিয়ে সবটা ভাইদের দিয়ে দিয়ে মা ভাইয়ের কাছ থেকে সরে এসে আলাদা বাড়ি বানিয়ে পরিবারকে একছত্র সাম্রাজ্য দিয়ে মহারাণীর মত রেখে দিয়েছিলেন, অতএব তারও মনটা মহারাণীর মত হয়ে গিয়েছিল।
একথা কোনদিন বলতে শোনা যায় নি নির্মলের বৌকে, আমি শ্বশুরের ভিটের ভাগ পেলাম না। অথবা আমি শাশুড়ীর সংসারের বাসনকোসনের কিছু পেলাম না।
এমন কি তারই বাপের দেওয়া দান সামগ্রী, ঘরবসতের জিনিস, সব ও বাড়িতে খাটছে, সেদিকে তাকিয়ে দেখেনি।…নির্মল ডাক্তার বন্ধুকে সব কথাই বলতো, সব গল্পই করতো, শুধু এই গল্পটা করে নি কোনদিন, এইশর্তে যে বৌয়ের জন্যে আলাদা একখানা সংসার পাতিয়ে দিয়েছিল। ভাগভেন্নর কুশ্রীতা বড় বিশ্রী লাগত তার! অতএব নির্মলের বৌয়ের ওই উদারতাটিই সকলের চোখে পড়েছে, আর বৌ সুখ্যাতি কুড়িয়েছে পাড়ায়।
সুখ্যাতির মানুষও যে ছিল না তা নয়, ভাল ভাল রান্না করে ও বাড়িতে দিয়ে আসতে তো তাকে কেউ হুকুম করে নি? দ্বাদশীর দিন ভোরবেলায় উঠে চান করে শাশুড়ীর জন্যে থরে থরে জল খাবার গুছিয়ে দিয়ে আসতে বলে নি।
এসব তো সে নিজে থেকেই করতো। আর ধন্যি ধন্যি কুড়তো। সে ধন্যি ধন্যি নির্মলের কানে যত না আসুক, সত্যভূষণের কানে এসে ঢুকে পড়তো। কারণ নির্মল ডাক্তারদের ভিটেবাড়িটা সত্যভূষণদের বাড়ির প্রায় সংলগ্ন।
.
ডাক্তারের বৌয়ের ওই প্রশংসা লাভের পরিপ্রেক্ষিতে এবাড়ি ওবাড়ির বৌদের কী প্রতিক্রিয়া হত, অথবা নিজেদের আসরে কী আলোচনা চলতো তা সত্যভূষণের জানা ছিল না, ওঁর শুধু বন্ধুপত্নীর নামে ধন্যি ধন্যি শুনেই বুকটা দশহাত হয়ে উঠতো।
.
কিন্তু এ সব তো সেই কোন জন্মের কথা, যখন নির্মল ডাক্তারের পূর্ণ যৌবন, পূর্ণ জোয়ার। …কলকাতার নিতান্ত নিকটবর্তী এই গ্রামটার তখন উত্তরোত্তর উন্নতির কাল, ডাক্তারী শাস্ত্রেরও উন্নতি ঘটছে, ধূলোমুঠো ধরলে সোনামুঠো হচ্ছে নির্মল ডাক্তারের।
সকলেরই ধারণা এ সমস্তই ওই কালো কোলো লক্ষ্মীমন্ত চেহারার বৌটির পয়। নইলে অন্য ভায়েরা তো নির্মলের নেহাৎ ধুকে ধুকে বেঁচে আছে, নির্মল সাহায্য করে তাই চলে। বৌও শুধু পয়মন্তই নয়, মহানুভবও বলতে হয়। ওই সাহায্যদানে তো রাগ করতোই না, বরং বরকেও না জানিয়ে চুপি চুপি নিজের ভাড়ার থেকে চালটা ডালটা, নিজের প্যাটরা থেকে কোরা কাপড়ের জোড়াটা, নিয়ে গিয়ে ওবাড়ি দিয়ে আসতো।
এর সাক্ষী অবশ্য একজন ছিল, সে সত্যভূষণ। সত্যভূষণ যেন বাতাসে সব খবর পেতেন। আর পেয়ে মনে মনে সেলাম ঠুকতেন।
কিন্তু কোনও কিছুই চিরদিন একই চেহারায় থাকে না, একা চন্দ্র সূর্যেরই নয়, সমস্ত কিছুরই উদয় অস্ত আছে! জগৎ সংসারের তাবৎ বস্তুর। মানুষের জীবনেরও, তার গড়া সংসারেরও। কাজেই নির্মল ডাক্তারের সংসারের গড়ন চেহারা যে ক্রমশই পালটাতে থাকল এটা আশ্চর্যের নয়। উদয় হল, মধ্যাহ্ন সূর্য হল, অস্তও গেল।