‘‘কুকুরটা সত্যিই অনেক সুন্দর।’’
‘‘সারা গোষ্ঠীর মাছে থাকলেও আমার ডাক শুনতে পেলে ছুটে আসে।’’
‘‘তার নাম?’’
‘‘শম্ভু!’’
‘‘তোমার নাম, বন্ধুবর?’’
‘‘ঋক্ষশ্রবা, রোচনা পুত্র!’’
‘‘রোচনা পুত্র? আমার মা’র নামও রোচনা ছিল। ঋক্ষ, খুব তাড়া না থাকলে একটু বস।’’
ধনুক ও পরিধান বরফের ওপর রেখে সুন্দরীর পায়ের কাছে বসতে বসতে ঋক্ষ বলল, ‘‘তোমার মা বেঁচে নেই?’’
‘‘না! নিশা-গোষ্ঠীর যুদ্ধে মারা গেছে। আমাকে খুব ভালবাসত।’’ বলতে বলতে তরুণীর চক্ষু আর্দ্র হয়ে এল।
ঋক্ষ নিজের হাতে তরুণীর অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘কি বিচ্ছিরি এই যুদ্ধ!’’
‘‘হ্যাঁ, কত প্রিয়জনের বিচ্ছেদ সইতে হয়।’’
‘‘কিন্তু, এখনো তো যুদ্ধ মিটছে না!’’
‘‘একের উচ্ছেদ ছাড়া কি করে থামবে?’’ তরুণী বলল, ‘‘শুনেছি নিশা-পুত্রেরা আবার আক্রমণ করবে। আমি ভাবছি ঋক্ষ তোমার মতোই ওরাও তো তরুণ!’’
‘‘তোমার মতো সুন্দরী মেয়েও তো কুরু-গোষ্ঠীতে আছে।’’
‘‘তবু আমাদের একে অন্যকে মারতে হবে ঋক্ষ, এ কোন ধারা?’’
ঋক্ষের মনে পড়ল তিন দিন পর তাদের গোষ্ঠী কুরুগণের ওপর আক্রমণ করবে। ঋক্ষ কিছু বলার আগেই তরুণী বলল, ‘‘কিন্তু আমরা আর যুদ্ধ করব না।’’
‘‘লড়বে না? কুরুরা আর যুদ্ধ করবে না!’’
‘‘ঠিকই। আর লড়বে না। আমাদের লোক এত কমে গেছে যে, আমাদের জেতবার আর কোন আশাই নেই।’’
‘‘কুরুরা তবে কি করবে?’’
‘‘এই ভোল্গা তট ছেড়ে চলে যাবে। ভোল্গা মায়ের ধারা আমাদের কত প্রিয়। একে আর দেখতে পাব না—তাই আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এখানে বসে বসে এর সুপ্ত ধারাকে দেখছি।’’
‘‘তুমি তা‘হলে আর ভোল্গাকে দেখবে না?’’
‘‘সাঁতারও কাটতে পাব না। এই শান্ত জলস্রোতে সাঁতার কেটে কি আনন্দই না পেতাম’’—সুন্দরীর কপোলে চোখের জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল।
‘‘কত ক্রুর, কত নিষ্ঠুর এই যুদ্ধ!’’ উদাস স্বরে ঋক্ষ বলল।
‘‘কিন্তু এই ‘‘জন’’-এর ধর্ম!’’ রোচনা বলল।
‘‘আর এই বর্বর ধর্মও বটে!’’ ঋক্ষ জবাব দিল।
০৩. অমৃতাশ্ব (স্থান : মধ্য এশিয়া, পামীর (উত্তর কুরু) ।। কাল-৩০০০খৃষ্টপূর্ব)
করগনার সবুজ শ্যামল পাহাড়, স্থানে স্থানে প্রবাহিত নদী বা ঝরনাধারা, তা যে কত সুন্দর সে শুধু তারাই জানে যারা দেখেছে কাশ্মীরের সুষমা। শীতের অবসানে বসন্ত এসেছে, আর বসন্তের অপরুপ সৌন্দর্য এই পার্বত্য উপত্যকাকে করে তুলেছে মর্তের স্বর্গ, পশুর পাল গিরিগুহার শীতের আবাস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বিস্তৃত গোচারণ ভূমিতে। দূরে দেখা যাচ্ছে ঘোড়ার লোমের তৈরী তাঁবু—তার মধ্যে যেগুলি খুব লাল সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে। একটি তাঁবু খেকে জল-ভরার চামড়ার মশক কাঁধে করে একটি তরুণী বেরিয়ে এল, সে পাথরের ওপর দিয়ে নদীর তীরের দিকে এগুতে লাগল। তাঁবু থেকে বেশী দূরে সে যায়নি এমন সময় একটি পুরুষ তার সামনে এসে দাঁড়াল। তরুণীর মতোই তার শরীর একটি পাতলা সাদা পশমের কম্বলে ঢাকা। কম্বলের দুইটি প্রান্ত এমনভাবে ডান কাঁধের ওপরে গেরো দিয়ে বাঁধা যে শুধু ডান হাত, কাঁধ আর বুকের অধর্র্ধাংশ অনাবৃত। পুরুষটির চুলগুলি পিঙ্গল, গোঁফটি সুন্দরভাবে পাকানো। পুরুষটিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েটি। মুচকি হেসে পুরুষটি বলল, ‘‘সোমা আজ দেরী করে জল ভরতে যাচ্ছ?’’
‘‘হ্যাঁ। ঋজ্রাশ্ব। কিন্তু পথ ভুলে তুমি এদিকে কোথায়?’’
‘‘ভুলিনি সখি! আমি তোমার কাছেই এসেছি।’’
‘‘আমার কাছে? অনেক দিন পরে।’’
‘‘আজ সোমার কথা মনে পড়ল!’’
‘‘তা বেশ ভালোই, আমাকে জল নিয়ে ফিরতে হবে, অমৃতাশ্ব খেতে বসেছে!‘‘
দু‘জনেই কথা বলতে বলতে নদী তীর পর্যন্ত গিয়ে ঘরে ফিরল!
ঋজ্রাশ্ব বলল, ‘‘অমৃতাশ্ব বেশ বড় হয়ে গেছে।’’
‘‘হ্যাঁ, তুমি তো অনেকদিন দেখনি।’’
‘‘ওর চার বছর বয়স থেকে।’’
‘‘এখন তার বয়স বারো। সত্যিই বলছি ঋজ্রাশ্ব, রুপে সে তোমারই মতো।’’
‘‘কি জানি, সে সময় আমি ছিলাম তোমার কৃপার পাত্র। তা অমৃতাশ্ব এতদিন কোথায় ছিল?’’
‘‘বাহলকে দাদামহাশয়ের কাছে।’’
তরুণী জলভর্তি মশকটি নামিয়ে রেখে নিজের স্বামী কৃচ্ছ্রাশ্বকে ঋজ্রাশ্বের আসার খবর দিল। তারা স্বামী স্ত্রী দু‘জনে এবং পেছনে অমৃতাশ্ব তাঁবু থেকে বাইরে এল। ঋদাশ্ব সসম্মানে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘‘বল বন্ধু কৃচ্ছ্রাশ্ব, কেমন ছিলে তুমি?’’
‘‘অগ্নি দেবতার কৃপায় ভালোই আছি ঋজ্রাশ্ব। এস খাওয়া যাক। এক্ষুনি সিদ্ধি কেটে মধু আর অশ্বিনী-ক্ষীর যোগে এই সোমরস তৈরী হয়েছে।
‘‘মধু সোম? কিন্তু এত সকালে কি করে?’’
‘‘আমি ঘোড়ার চারণভূমিতে যাচ্ছি। বাইরে দেখছ না ঘোড়া তৈরী?’’
‘‘তা‘হলে আজকে সন্ধ্যায় ফিরবার ইচ্ছা নেই?’’
‘‘নাও ফিরতে পারি। তাই এ সোমের মশক আর অশ্ব-মাংস সঙ্গে নেব।’’
‘‘অশ্ব-মাংস!’’
‘‘হ্যাঁ, কৃচ্ছ্রাশ্ব! তোমার নামটা কিন্তু উল্টো।’’
‘‘মা বাবার সময় আমাদের অশ্বের কৃচ্ছ্রতা ছিল, তাই আামার নাম কৃচ্ছ্রাশ্ব।’’
‘‘কিন্তু এখন তো ঋদ্ধাশ্ব হওয়া উচিত।’’
‘‘আচ্ছা, ভেতরে চল।’’
‘‘এই পাইন গাছের নীচে সবুজ ঘাসের ওপরই বসি না কেন, বন্ধু!’’
‘‘ঠিকই। সোমা, তুমি তা‘হলে নিয়ে এস, সোম আর মাংস। এখানেই বসে বন্ধুকে তৃপ্ত করি।’’
‘‘কিন্তু কৃচ্ছ্র, তুমি তো ঘোড়ার পালের দিকে যাচ্ছিলে যে?’’
‘‘আজ না হয় কাল যা্ব। বস ঋজ্রাশ্ব!’’
সোমা ভাঙের মশক এবং চষক নিয়ে এল। দু‘বন্ধুর মাছে অমৃতাশ্বও বসে পড়ল। সোমা ভাঙ ও চষক মাটিতে রেখে বলল, ‘‘একটু অপেক্ষা কর, বিছানা এনে দিচ্ছি।’’