দিবা খুবই উল্লসিত হয়ে উঠল। তিন তিনটি মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে আনা শিশুকে পাথরে আছড়ে মেরেছে। আজ পানাহারের পর শুরু হল নৃত্য। আগুনের সামনেই দিবা তার তরুণ ছেলে বাসুকে নিয়ে নাচতে শুরু করে দিল। নাচের তালে তালে দুই উলঙ্গ নরনারী পরস্পরকে আলিঙ্গন আর চুম্বন করতে লাগল—কখনও বা ছাড়াছাড়ি হয়ে নিজেদের নিজস্ব নাচের ভঙ্গিমা দেখাতে লাগল। সকলেই বুঝল আজ রাতে বাসুই হবে নেত্রী দিবার ক্রীড়া ও শয্যাসঙ্গী। বাসু তার জয়োন্মাত্তা মায়ের কামনাকে অবহেলা করতে চাইল না।
নিশা গোষ্ঠীর মৃগয়াভূমি এখন চারগুণ বেড়ে গেল আর শীতকালে তারা কোথায় থাকবে সে চিন্তাও দূর হল। তবু একটা দুশ্চিন্তা তাদের রয়ে গেল—ঊষা গোষ্ঠী জীবিত অবস্থায় যে ক্ষতি করতে পারেনি এখন মৃত্যুর পর প্রেতযোনি পেয়ে তাদের প্রতিশোধ নেবে। যে ঘরে জীবিতদের পোড়ানো হয়েছেল সেই ঘরটা ভূতের আড্ডা হল। নিশা-গোষ্টীর কেউ একা সেখান দিয়ে যেতে সাহস পায় না। বহুবার শিকারীরা না-কি দেখেছে শত শত উলঙ্গ নরনারী জ্বলন্ত আগুনের সামনে নাচছে। বাসভূমি পরিবর্তনের প্রয়োজনে যেদিন ওই পোড়াঘরের সামনে দিয়ে যেতে হয়েছে—সংখ্যায় তারা বেশী ছিল আর দিনের আলো ছিল বলে রক্ষে। দিবা তো কয়েকবারেই দেখেছে যে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে দুগ্ধপোষ্য শিশু মাটি থেকে এসে তার হাত ধরে ঝুলছে—ভয়ে সে চিৎকার করে উঠেছে।
৪
দিবার বয়স এখন সত্তরের ওপর। এখন সে আর নিশা-জনের কর্ত্রী নয়—তবু গোষ্ঠী সকলেই তাকে সম্মান করে। তার বিশ বছরের নেতৃত্বে সে বংশের বৃদ্ধি এবং কল্যাণের জন্য অনেক কিছু করেছে। এই বিশ বছরে জনকে অপর গোষ্ঠীর সঙ্গে অনেকবার যুদ্ধ করতে হয়েছে, তাতে ক্ষয়-ক্ষতি ও জনহানি হয়েছে। এখন তাদের দখলে পর্যাপ্ত মৃগয়াভূমি—তাতে কয়েক মাস স্বচ্ছন্দে চলে যায়। দিবার কাছে এ সবই ভগবানের কৃপা বলে মনে হয়। দিবার মনে ভয় এখনো কাটেনি—হাত ঝোলা মৃত স্তন্যপায়ী শিশুরা এখনো মাঝে মাঝে তার রাতের ঘুম ঘুচিয়ে দেয়।
শীতকাল এসে পড়েছে। ভোল্গার স্রোত জমাট হয়ে গেছে—তার ওপর কয়েক মাসের সঞ্চিত তুষার স্তুপের দিকে দূর থেকে তাকালে মনে হয় রৌপ্যচূর্ণের অথবা পেঁজা তুলোর আঁকাবাঁকা রেখা চলে গেছে। অপর দিকে বনভূমিতে হিমশীতল নির্জীবতা ও স্তব্ধতা বিরাজ করছে। নিশা-গোষ্ঠীর লোকসংখ্যা আরও বেড়েছে। তাই তাদের খাদ্যের প্রয়োজন বেড়েছে। এই সময়ের মধ্যে কাজ করার লোকও অনেক বেড়েছে—কাজের দিন তাদের খাদ্যভান্ডারে প্রভুত পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। এমন কি শীতকালেও পোষা কুকুর নিয়ে নিশা পরিবারের ছেলেমেয়েরা শিকারে বেরুলে কিছু না কিছু পেয়েই থাকে।
শিকারের একটি নতুন উপায় তারা বার করেছে—হরিণ, গরু, বুনোঘোড়া নিজেদের খাবারের খোঁজে এ-বন ও বন-ঘুরে বেড়ায়। বনে থাকতে শিকারীরা লক্ষ্য করেছে যে মাটিতে বীজ পড়লে তাতে অঙ্কুর জন্মায়। তাই তারা ভিজে মাটির ওপরে ঘাসের বীজ ছড়াতে শুরু করল। ফলে সেখানে ঘাস জন্মাল, তৃনভোজী পশুরাও আসতে আরম্ভ করল—ক্রমে তারা একই অঞ্চলে বেশীদিন থাকতে লাগল।
একদিন ঋক্ষশ্রবার শিকারী কুকুরটা একটা খরগোশের পেছনে তাড়া করল—ঋক্ষশ্রবাও ছুটল তার পেছন পেছন। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল, তাই সে আপন চামড়ার আবরণটি খুলে কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে নিল। ইতিমধ্যে কুকুরটা কখন দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। তুষারের ওপর পায়ের ছাপ পড়েছে—তাই পদচিহ্ন দেখা গেল। ঋক্ষ হাঁপাতে হাঁপাতে একটা গাছের গুড়িঁতে বিশ্রামের আশায় বসে পড়ল। পূর্ণ বিশ্রামের আগেই কুকুরটার ডাক শুনতে পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে আবার দৌড়াতে লাগল। ক্রমেই সে শব্দটার কাছে এসে পড়ল; আরও কাছে এসে দেখতে পেল যে পাইন গাছে হেলান দিয়ে একটি অপূর্ব সুন্দরী তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। সাদা চামড়ার একটি পোষাক তার পরনে—সাদা শিরস্ত্রানের নীচে আলুলায়িত কেশগুচ্ছগুলি দেখা যাচ্ছে। আর তার পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা খরগোশ। ঋক্ষ এসে পৌছালে কুকুরটআ জোড়ে ডাক ছাড়তে ছাড়তে তার কাছে এল। ঋক্ষ মেয়েটির মুখের দিকে চাইল। মেয়েটি একটু হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘বন্ধু’’ এ কুকুরটি কি তোমার?’’
‘‘হ্যাঁ আমার! কিন্তু তোমাকে তো এর আগে কখনও দেখিনি!’’
‘‘আমি কুরু বংশের মেয়ে। এ এলাকাটা আমাদেরই।’’
‘‘কুরুবংশ!’’
কুরু-গোষ্ঠী শুনে ঋক্ষর মনে কিছুটা বিদ্বেষ জন্মাল। কুরুরা তাদের প্রতিবেশী এবং কয়েক বছর ধরে বিরোধ চলছে। বিরোধ কয়েকবার যুদ্ধের পর্যায়ে উঠেছে। কুরুরা অবশ্য ঊষা-গোষ্ঠীর চেয়ে বেশী বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। তারা বুঝেছিল যে, যুদ্ধে জেতবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই পালানোই শ্রেয় ও কার্যকরী বলে স্থির করেছে। অস্ত্রের জোরে রক্ষা না পেলেও—পালিয়ে বেঁচেছে। নিশা বংশের যোদ্ধারা প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল, তারা কুরুবংশ ধ্বংশ করবে—কিন্তু এখনো সে প্রতিজ্ঞা পালিত হয়নি।
তরুণী বলল, ‘‘তোমার কুকুরটি এই খরগোশটি মেরেছে—এটা তুমি নিয়ে যাও।’’
‘‘কিন্তু কুরদের মৃগয়াক্ষেত্রে মেরেছে।’’
‘‘হ্যাঁ তা মেরেছে। কিন্তু আমি কুকুরের মালিকের প্রতিক্ষায় ছিলাম।’’
‘‘প্রতীক্ষায়!’’
‘‘হ্যাঁ, মালিকের হাতে খরগোশটি দেব বলে।’’
কুরু-কুলের নাম শুনে ঋক্ষর মনে যে বিদ্বেষের সঞ্চার হয়েছিল তা সুন্দরীর নম্র আলাপে বিদুরিত হল। প্রত্যুপকারের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বলল, ‘‘শুধু শিকার নয়, তুমি আমার কুকুরকে ফিরিয়ে দিয়েছ। এই কুকুর আমার খুব প্রিয়।’’