নিশা জনের সমস্যাও বেড়েছে অনেক। আগে তারা যে সমস্ত জঙ্গলে আস্তানা গাড়ত এখন আর সেইরকম ছোট জঙ্গলে তাদের কুলোয় না। তাদের ‘জন-দম’ (যৌথবাসগৃহ) গুলিই যে তিনগুণ বাড়াতে হয়েছে শুধু তাই নয়, মৃগয়াক্ষেত্রের পরিধিও দরকার তিনগুণ। বর্তমানে তারা যে মৃগয়ায়ভূমির কাছে আস্তানা নিয়েছে, তার ওপারে ঊষা-জনের মৃগয়াক্ষেত্র। উভয়ের সীমানার মাঝখানে ছিল একটি অনধিকৃত ভূমি। নিশা-গোষ্ঠীর লোকেরা সময়ে সময়ে শুধু যে অনধিকৃত ভূমিতে শিকার করত তা নয়—পরন্তু তারা ঊষা-গোষ্ঠীর মৃগয়াভূমিতে কয়েকবার শিকার করতে গিয়েছে। জন-সমিতি (গোষ্ঠীর মন্ত্রনা পরিষদ) দেখল যে এতে করে ঊষা-গোষ্ঠীর সঙ্গে নিশা পরিবারের সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে, কিন্তু এর প্রতিকারের কোনো উপায় ছিল না। একদিন তো দিবা স্পষ্টভাবে ‘জন-সমিতিকে বলল, ‘‘ভগবান যখন আমাদের এতগুলি জীব দিয়েছেন তখন এইসব বন-জঙ্গলে তাদের খাদ্যও নিশ্চয় পূর্ণ থাকবে। এইসব মৃগয়াক্ষেত্র ছাড়া এতগুলো মুখে আহার যোগানো সম্ভব নয়। এইসব জঙ্গলে যে সমস্ত ভাল্লুক, গরু, ভেড়া আছে তা কিছুই ছাড়া যায় না—যেমন ছেড়ে দিতে পারি না এই ভোল্গার মাছ।’’
ঊষা-গোষ্ঠী দেখল যে নিশা-জন অন্যায়ের পর অন্যায় করে চলেছে। একবার দু‘বার ঊষা-জনের জন সমিতি নিশা-গোষ্ঠীর জন-সমিতির সঙ্গে আলাপ আলোচনা করল, স্মরণ করিয়ে দিল, এই দুই জনের মধ্যে আবহমান কাল ধরে কোন সংঘর্ষ হয়নি; এ কথাও বলল যে প্রতিকার শীতের তারাই এখানে এসে থাকে। কিন্তু অনাহারে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে যদি নিশা-গোষ্ঠীকে ন্যায়ের শপথ নিতে হয়—তা কি করে সম্ভব! সকল আইন যখন বিফল তখন জঙ্গল আইনের আশ্রয় নিতে হয়। উভয় গোষ্ঠীই ভেতরে ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি চালাতে লাগল। একের খবর অপরের পাবার উপায় ছিল না। কারণ এই সময়ে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ আপন-আপন গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। নিশা-জনের একটি দল একদিন পাশের বনে ঊষা-জনের মৃগয়াভূমিতে শিকার করতে গেল। ঊষা-গোষ্ঠীর লোকেরা লুকিয়ে বসেছিল, তারা আক্রমণ করল। নিশা-গোষ্ঠীর লোকেরা বীরত্বের সঙ্গে লড়ল কিন্তু তারা আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে বেশী সংখ্যায় আসেনি। আপন দলের বহু মৃতকে ফেলে আহতদের সঙ্গে নিয়ে শিকারীর দল পালিয়ে এল। জন-মাতা সমস্ত শুনল, জন-সমিতি আলোচনা করল, তারপর সাধারণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হল। সমস্ত ঘটনা তাদের সামনে উপস্থিত করা হল। মৃত ও আহতদের ভাই ছেলেরা, মা-মেয়ে-বোনেরা রক্তাক্ত প্রতিহিংসার জন্য উত্তেজিত করতে লাগল। রক্তের প্রতিশোধ নিতে না পারা এবং জন-ধর্মের বিরোধিতা করা—কেউ বর্জন করতে পারত না। সমগ্র গোষ্ঠী সমবেতভাবে সিদ্ধান্ত নিল, মৃতের রক্তের প্রতিশোধ নিতে হবে।
নাচের বাজনা যুদ্ধের বাজনায় পরিবর্তিত হল। শিশু ও বৃদ্ধদের রক্ষার জন্য কয়েকজন স্ত্রী-পুরুষকে রেখে বাকি সকলে যুদ্ধযাত্রা করল; ধনুক-পাষাণ-কুঠার, কাঠের বল্লম ও কাঠের মুদগর আর দেহরক্ষার জন্য কঠিন ও দৃঢ় চামড়ার বর্ম আবরণ। সামনে চলল বাদকেরা, প্রধনা হিসেবে সেই যুদ্ধের পরিচালিকা। বাজনার আওয়াজে দিগন্ত ধ্বনিত ও অনুরণিত হল, লোকের কোলাহলে বনভূমি মুখরিত হল, পশুপক্ষীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এদিক সেদিক পালাতে শুরু করল।
একটু পরেই তারা অনধিকৃত বনভূমিতে এসে পৌছাল। কোনো সীমারেখা না থাকা সত্ত্বেও এই সমস্ত গোষ্ঠীর লোকেদের সীমান্ত সম্পর্কে ভালোভাবেই জ্ঞান ছিল এবং এ ব্যাপারে মিথ্যা বলতে পারত না। মিথ্যা তখন মানব-সমাজে অপরিচিত আর সে বিদ্যা আয়ত্ব তাদের পক্ষে কঠিন ছিল। অপর গোষ্ঠীর শিকারীরা আপন গোষ্ঠীতে গিয়ে খবর দিল, এবং ঊষা-জনের যোদ্ধারা হাতিয়ারে সুসজ্জিত হয়ে ময়দানে এল। ঊষা-গোষ্ঠী বস্তুত ন্যায় চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল, আপন মৃগয়াক্ষেত্র রক্ষা করতে। আর আপন ভূমি রক্ষার জন্যই তাদের সংগ্রাম। কিন্তু নিশা-গোষ্ঠী এই ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে প্রস্তুত ছিল না। উষা-গোষ্ঠীর মৃগয়াক্ষেত্রে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হল। উভয় পক্ষ থেকেই পাথরের ফলাযুক্ত বাণ শন-শন করে বর্ষিত হতে লাগল, কুঠারের-কুঠার, বল্লমে-বল্লমে, মুদগরে-মুদগরে যুদ্ধ হতে থাকল, উভয় পক্ষের লোকই আহত হল। হাতিয়ার ভেঙে বা হাত থেকে পড়ে গেলে হাতে হাতে-দাঁতে বা মাটি কুড়িয়ে নেওয়া পাথরের সাহায্যে যুদ্ধ চলতে লাগল।
নিশা-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ঊষা-গোষ্ঠীর দ্বিগুণ, কাজেই ঊষা-গোষ্ঠীর পক্ষে জয়লাভ ছিল অসম্ভব। কিন্তু একটি বালকও জীবিত থাকা পর্যন্ত তাদের যুদ্ধ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এক প্রহর দিন অর্থ্যৎ সূর্য ওঠার তিন ঘণ্টা পর যুদ্ধ শুরু হয়েছিল—ঊষা গোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশ লোক বনের মধ্যেই নিহত হল। গোষ্ঠী-যুদ্ধে আহত শত্রুকে ছেড়ে যাওয়া নিতান্ত অধর্মের কাজ। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ ভোল্গা তটে তাদের শেষ শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করে প্রাণ দিল। কয়েকজন জননী শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে আবাসভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু তখন আর সময় ছিল না, প্রতিহিংসা-পরায়ণ শত্রুরা তাদের অনুসরণ করে ধরে ফেলল—স্তন্যপায়ী শিশুদের ধরে ধরে পাহাড়ের ওপর আছড়ে গুড়িঁয়ে দিল, বৃদ্ধ স্ত্রী-পুরুষদের গলায় পাথর বেঁধে ভোল্গার জলে ডুবিয়ে দিল। তাদের বাসগৃহে রক্ষিত মাংস, ফল, মধু ও সুরা এবং অন্যান্য দ্রব্যসম্ভার বাইরে এনে অবশিষ্ট জীবিত শিশু ও স্ত্রী লোকদের ঘরে বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দিল। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার লেলিহান আভার মধ্যে দাঁড়িয়ে জীবন্ত মানুষের আর্তনাদ বিজয়ঢ নিশা-গোষ্ঠীর লোকদের উল্লসিত করে তুলল। তারা অগ্নি দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানাল, শত্রুর সঞ্চিত মদ ও মাংসে দেবতা ও নিজেদের পরিতৃপ্ত করর।