এই কুটিরটাও তাদের অস্থায়ী বাসস্থান। কারণ যখন শিকারযোগ্য জীব এখান থেকে চলে যাবে, ফলমূলের অভাব ঘটবে তখন সারা গোষ্টীর মানুষেরা এ জায়গা ছেড়ে নতুন অঞ্চলে সরে যাবে। বহু যুগের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে,কোথায় কথন শিকার পাওয়া যাবে। এখান থেকে চলে যাবার পর ছাউনি পড়ে যাবে কিন্তু কাঠের দেওয়াল কয়েক বছর পর্যন্ত টিকে থাকবে। নতুন জায়গায় গিয়ে এরা অনুরুপভাবে পরিত্যক্ত দেওয়ালের ওপর খড়ের ছাউনি দিয়ে নতুন ঘর বানাবে আর তারই একাংশে জিনিস –পত্র রাখা ও অপরাংশ রান্নার কাজে ব্যবহার করবে। এরা এখন হাতে-গড়া মাটির বাসন তৈরী করতে শিখেছে। কখনো বা কাঁচা মাংস খায়—আবার তাজা মাংস পুড়িয়েও খায়, তবে শুকনো মাংস সেঁকে খাওয়ার রীতি নেই—তা নিষিদ্ধ। ভোল্গার এই অংশে মধু পাওয়া যায় যথেষ্ট আর তার জন্যে মধুপায়ী ভাল্লুকের সাক্ষাৎও মিলত প্রচুর। নিশাগোষ্ঠী আহার এবং মদ্য পানের জন্য মধু সংগ্রহ করত।
মধুর সংগীতের আওয়াজ আসছে, ঘরে গানের আসর বসেছে। নারী-পুরুষ সকলেই গলা ছেড়ে সজীব কণ্ঠে গান ধরেছে। চামড়া পিটিয়ে যখন গাত্রবস্ত্র তৈরী করত তা হত সেই কর্মরত মানুষের সংগীত। তখনকার দিনে সমস্ত গোষ্ঠীরন লোক কোনো কাজ শুধু যে সম্মিলিতভাবেই করত তা নয়, পরন্তু তা সম্পাদন করত মনোরঞ্জক ভঙ্গিমা সহকারে । তা ছিল সম্মিলিত কাজের একটি অঙ্গ। সংগীতের মূর্ছনা কর্মের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়, কিন্তু এই গান কর্মকালীন গান নয়। এখন বিশ্রামকালীন আনন্দের গান হচ্ছে। একবার নারীকণ্ঠের সুললিত সুর-লহরী শোনা যাচ্ছে—আবার শোনা যায় পুরুষ কণ্ঠের পুরুষ ও গম্ভীর সুর।
কুটিরের এক অংশে গোষ্টীর স্ত্রী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, একত্রে সমবেত হয়েছে। ছাউনির মাঝখানের ছাত কাটা আছে, আর তারই নিচে পাইন কাঠের আগুন জ্বলছে। স্ত্রী পুরুষ সুললিত তালে গান গাইছে, গানের পদে এই শব্দগুলো বোঝা যাচ্ছে—’’
‘‘অ-ন্ত-ন্ত-গ-লী-ীী-এ-সে—’
মনে হচ্ছে এরা যেন আগুনের কাছে প্রার্থনা করছে। গোষ্ঠীর নেত্রী ও জন-সমিতির লোকেরা আগুনের মধ্যে মাংস, চর্বি, ফল ও মধু আহতি দিতে আরম্ভ করল। বর্তমানে জনের হাতে অনেক শিকার সঞ্চিত হয়েছে, প্রচুর ফল ও মধু আহরিত হয়েছে-আর এই ঋতুতে কেউ জানোয়ার বা শত্রুর দ্বারা নিহত হয়নি। তাই আজ জনের মানুষেরা পূর্ণিমার রাত্রে অগ্নি-দেবতার কাছে কৃতাঞ্জলিপুটে প্রার্থনা নিবেদন করছে। জনের নেত্রী এক পাত্র সোমরস আগুনে সমর্পণ করল এবং গোষ্ঠীর সবাই আগুনের চারপাশে ঘিরে দাঁড়াল। জন্মের সময় মানুষ যেমন উলঙ্গ হয়ে পৃথিবীতে আসে—এরা সেই জন্ম থেকে আজও নিরাবরণ, সেইভা্বেই এখানে এসেছে। এখন শীতকাল নয়—গরমের সময়, মৃত পশুর চামড়ায় নিজের দেহ আবৃত করার দরকার মনে করে না।
কিন্তু, কি সুন্দর সুডৌল এদের শরীর্। কারও ভুঁড়ি গজায়নি, কারও শরীরে চর্বি জমে দেহ স্থুল হয়নি। একেই বলে দেহসৌন্দর্য—সুন্দর স্বাস্থ্য! এদের সকলের মুখশ্রী একই ছাঁচের। আর, না-হবেই বা কেন? এরা সকলেই নিশা সন্তান—পিতা-পুত্র-ভাইদের দ্বারা জাত। সকলেই স্বাস্থ্যবান এবং বলিষ্ঠ। অস্বাস্থ্য এবং ক্ষীনকল ব্যক্তি বেঁচে থাকতে পারে না, এই প্রকৃতি ও শিশু জগতের শত্রুতার মধ্যে টিকে থাকা সম্ভব নয়। গোষ্ঠী কর্ত্রী উঠে কুটিরের বড় ঘরটায় গেল। অন্যান্য সকলে কুটিরের মাটিলেপা মেঝেতে এসে বসল।
চামড়ার থলির পর থলি ভতি হয়ে সোমরস আসতে লাগল। কারও কাছে চষক (পেয়ালা) মাটির পাত্র, কেউবা নিয়েছে ভাঁড়, কারও হাতে মাথার খুলি, আবার কেউ হয়ত জোগাড় করেছে গাছের পাতার ঠোঙ্গা। তরুণ-তরূণী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই পানাহারে মত্ত হল। সব দলে দলে পৃথক হয়ে বসে খাচ্ছিল। অবশ্য এটা সাধারণ রীতি নয়। বৃদ্ধদের মনে পড়ছিল, তাদের বয়সকালে তারা জীবনের আনন্দ কিভাবে উপভোগ করেছে। তারা জানে এখন তরুণ-তরুণীদের পালা, কোনো কোনো তরুণ-তরুণী অবশ্য বৃদ্ধদের মুখে মদের পাত্র তুলে ধরছিল, যারা জীবন সাহাহ্নে পৌছেছে, তাদের কাছে পৌছে দিচ্ছিল যৌবনের হাতছানি। ওই দেখুন দিবাকে। তাকে ঘিরে কত তরুণ-তরুণী বসে আছে। তার হাত আজ রিভুর কাঁধে। সূর বসেছে আজ দামার সঙ্গে।
পান-আহার, নৃত্যগীত এ সবের পর একই ঘরের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকারা অঙ্কশয্যায় শয়ন করে রইল। সকালে উঠে কতক স্ত্রী-পুরুষ ঘরের কাজে লাগবে, কতক শিকারে বেরুবে, আর কিছু লোক যাবে ফল আহরণে। রক্তিম কপোল ছোট ছোট শিশুরা কেউ মায়ের কোলে, কেউ বিছানো চামড়ার ওপর শুয়ে রইল। আবার কেউ বা একটু বয়স্ক বালক বালিকার কোলে-কাঁধে চেপে ঘুরতে লাগল, কেউ কেউ ভোল্গার বালুতটে লাফালাফি করে বেড়াতে লাগল।
নিশার যুগের তুলনায় এ যুগের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অনেক বেশী শান্ত ও সন্তুষ্ট। গোষ্ঠী বা জন এখন আর একজন মায়ের অধীনে নয়। পরন্তু অনেক জীবিতা মায়ের ছেলেমেয়ে এখন একত্রে এক গোষ্টীতে বা বৃহৎ পরিবারে সমবেত হয়েছে এবং এখানকার কর্ত্রী-মায়ের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ নয়—রাজত্ব একচ্ছত্র নয়। জন-সমিতি এখন দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা। তাই আর আর কোনো নিশার আপন কন্যাকে জলে ডুবিয়ে মারবার দরকার হয় না।
৩
দিবা এখন চার পুত্র এবং পাঁচ কন্যার জননী, বয়স পঁয়তাল্লিশ। এখন সে নিশা-গোষ্ঠীর কর্ত্রী মায়ের পদে অধিষ্ঠিতা। গত 25 বছরে নিশা-গোষ্ঠীর লোক সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে গেছে । এই বাড়বাড়ন্তের জন্য সূর যখন দিবাকে চুমু খেয়ে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছে, দিবা জবাব দিয়েছে, ‘‘এ সবই অগ্নির দয়ায়—সূর্য দেবতার কৃপায়। অগ্নি ও সূর্য যারই সহায় হন, সে সেখানেই থাক—ভোল্গার স্রোতের মতোই তার ঘরে মধুর বন্যা বইবে; দলে দলে হরিণ আসবে বনে—তার আহার যোগাবার জন্যে।’’