‘‘কিন্তু সুর!তুমিও তো তাদেরেই মতো—বরং তাদের চেয়েও কর্মঠ, ক্ষিপ্রগতি, সুগঠিত তোমার দেহ—আমি তোমার কামনাকে তো নিরাশ করেছি।’’
‘‘আমি তো কখনও কামনা প্রকাশ করিনি,দিবা!’
‘মুখে করনি বটে! মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা, তখন তুমি কিছুই প্রকাশ করতে না কিন্তু তোমার মনের কথা বুঝতে পারতাম। তারপর দিবা সুরকে ভুলে গেল।
দিবা কথনও সুরকে—দিন কখনও সূর্যকে ভুলে থাকতে পারে? না সুর! দিবা আর কথনও তোমাকে ভুলে থাকবে না।’’
‘‘ তা’হলে ছেলেবেলার সেই দিবা-সুর হয়ে উঠব আমরা আবার।’’
ছোট শিশুর মতো নগ্ন মনোরম মূর্তি পরিপূর্ণভাবে পরস্পরের অধরে অধর মিলিয়ে দিল। আর দিবা, সুরের তিসি ফুলের মতো নীল চোখ দুটোর ওপর তার দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে চুমু খেতে খেতে বলল ‘তুমি আমার আপন মায়ের ছেলে—আর আমি তোমাকেই ভুলে ছিলাম।’’
দিবার চোখ জলে ভরে উঠল। সুর দিবার গাল নিজের চোখের জলের ধারায় মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘না তুমি তো আমায় কথনও বঞ্চিত করনি, দিবা। তুমি যখন বড় হয়ে উঠলে তোমার কণ্ঠস্বর, তোমার চোখ, তোমার সারা দেহে যখন পরিবর্তন দেখা দিল তখন আমি তোমার কাছ থেকে দুরে সরে গেলাম।’’
‘‘মনের দিক দিয়ে নিশ্চয়ই নয় সুর?’’
‘‘দিবা, সে কথা……’’
‘‘না, তোমাকে বলতেই হবে। তুমি বল আর কখনও তুমি আমায় দেখে লজ্জা পাবে না?’’
‘‘না, আর কথনও তোমার কাছে আমার লজ্জা-ভয় থাকবে না।……আচ্ছা, এবার আমি তোমার চুলে ফুলগুলো সাজিয়ে দিই?’’
সুর লম্বা গাছের ছাল থেকে আঁশ বার করে সেই সুতোয় লাল, সাদা, বেগুনি প্রভৃতি নানা রঙ-এর ফূল নিয়ে একটি সুন্দর মালা গাঁথল। দিবার চুলের রাশ একত্র করে তা পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিল। গরমের দিনে ভোলগার তীরবাসী তরুণ-তরুণীরা প্রায়ই জলে নেমে স্মান করত সাঁতার কাটত। তাই দিবার চুলে কোন জট ছিল না। সুর নিচের গাঁধা মালাটি দিবার চুলে তিন ভাঁজ করে, কটিবন্ধে মেঘলা জড়ানোর মতো করে দু‘পাশে সাজিয়ে দিয়ে একটা প্রান্ত তার কপালের ওপর ঝালরের মতো ঝুলিয়ে দিল—তার দু‘পাশে রইল দুটো রক্তবর্ণের আর মাঝখানে সাদা রঙ-এর ফুলের সারি।
দিবা তখনো সেই শিলাখণ্ডের ওপর বসেছিল, সূর একটু দুরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। কত সুন্দরই না দেখাচ্ছিল দিবাকে। আরও একটু পেছনে সরে এসে সূর দেখতে লাগল—আরও সুন্দর দেখাল দিবাকে। তবে দুরে চলে আসার জন্যে ফুলের আর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল না। ফিরে এসে সুর দিবার পাশে বসল, নিজের গালের সঙেগ গাল মিলিয়ে দিল। দিবা সাথীর চোখে চুমু খেল্ আর নিজের ডান হাত সূরের কাঁধের ওপর রাখল। সূর তার বাঁ হাত দিয়ে দিবার কটিদেশ জড়িয়ে ধরে বলল,‘‘দিবা! এই ফুলগুলে আগের চেয়েও কিন্তু অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে।’’
‘‘ফুল না আমি?’’
সূরের মুখে কোনো উত্তর যোগাল না, ক্ষণকাল মৌন থেকে সে বলল, ‘‘আমি যখন তোমাকে দূর থেকে দেখছিলাম তখন তোমাকে কতই না সুন্দর দেখাচ্ছিল, তারপর আরও একটু দূর গেলাম—আরও অনেক বেশী সুন্দর লাগল।’’
‘‘আর যদি ভোলগা তট থেকে দূরে দেখতে—তা’হলে?’
‘‘না, না অতদূর থেকে নয়’’—এই কথা বলার সময় সূরের চোখে দুশ্চিন্তার ঝলক নেমে এল। সে আবার বলল, ‘‘বেশী দূরে গেলে ফুলের গন্ধ পাওয়া যায় না, আর তোমার মুখটাও অস্পষ্ট হয়ে যায়।’’
‘‘তুমি তা’হলে কিভাবে আমাকে দেথতে চাও? দূর থেকে না কাছ থেকে?’’
‘‘কাছে থেকে। দিনের মধ্যেই সূর্য থাকে উজ্জ্বল—দিবার কাছে থাকবে সূর?’’
‘‘আচ্ছা, আজ তুমি আমার সঙ্গে নাচবে তো!’’
‘‘নিশ্চয়ই।’’
‘‘আজ সারাদিন আমার সঙ্গে থাকবে?
‘‘অবশ্যই।’’
‘‘সারারাত?’
‘‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’’
‘‘তাহলে আজ জন-এর কোন পুরুষকে কাছে থাকতে দেব না।’’—এই বলে দিবা সুরকে আলীঙ্গনাবদ্ধ করল।
এই সময় শিকারী তরুণ-তরুণীরা ফিরে এল। তাদের সাড়া পেয়েও এরা দুজনে আগের মতোই দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে রইল।
নবাগতাদের একজন বলল, কিরে দিবা! আজ তুই সুরকেই সাথী করে নিলি?’’
ওদের দিকে ফিরে তাকিয়ে দিবা বলল,‘‘হ্যাঁ, এই দেখ, সুর আমাকে ফুল দিয়ে সাজিয়েছে।’’
একটি তরুণী কলকণ্ঠে বলল, ‘‘সুর তুমি তো বেশ ফুল সাজাতে পার? আমার চুলও সাজিয়ে দাও না?’’
দিবা প্রতিবাদ করে বলল, ‘‘আজ নয়, আজ সুর আমার—আমার একার।’’
তরুণী বলল ‘‘বেশ কাল সুর আমার।’’
‘‘না, কালও সুর আমার থাকবে।’’
তরুণী এবার রাগত স্বরে বলল, ‘‘রোজ রোজ সুর তোমারই থাকে না-কি? এ ঠিক না, দিবা।’’
দিবা নিজের ভুল বুঝতে পারল। বলল, ‘‘রোজ নয়, শুধু আজ আর কাল।’’
ক্রমে আরো শিকারী সেখানে এসে হাজির হল। একটা বিরাট কালো কুকুর এল তাদের সঙ্গে—আর এসেই সূরের পা চাটতে লাগল। সূরের মনে পড়ে গেল তার নিজের শিকার করা ভেড়াটার কথা। দিবার কানের কাছে ফিস্ ফিস্ করে কি বলে এক দৌড়ে চলে গেল।
২
কাঠের দেওয়াল এবং খড়ের ছাওনি দেওয়া এক বিশাল কুটির। পাথরের কুঠার ধারাল হলেও তাই দিয়ে ভারী কাঠের গুঁড়ি কাটা সম্ভব হয়নি। কুড়ুলের ব্যবহার করলেও-বড় বড় কাঠ কাটার ব্যাপারে আগুনের সাহায্য নিতে হয়েছে। আর এত বড় কুটির? নিশা নাম্নী পুরাকালের কোনো স্ত্রীলোকের বংশধরদের নামেই নিশা-জনের উৎপত্তি। হ্যাঁ নিশা-জনের সমস্ত লোকজনই এখানে বাস করে।সমগ্র জন গোষ্টি এক ছাউনির নীচে বাস করে, একই সঙ্গে শিকার করে, ফল মধু সবই একত্রে আহরণ করে। সবাই একজনকে, কর্ত্রীকে মানে। গোষ্ঠী পরিচালিত হয় সমষ্টিগতভাবে—সমিতির দ্বারা। পরিচালনা—হ্যাঁ, এই পরিচালনায় জনের ব্যক্তি বিশেষের জীবনের কোনো ঘটনাই সমষ্টি জীবনের বাইরে ছিল না। শিকার, নাচ-প্রেম, গৃহ –নির্মাণ, চামড়ার গাত্রবাস তৈরী—সমস্ত কাজই জনসমিতির পরিচালনায় হত। আর এই সমস্ত কাজে জন-মাতাদের প্রাধান্যই ছিল প্রবল। নিশা জনে দেড়শ নরনারী বাস করে। তবে কি এরা একই পরিবাভুক্ত? এ অর্থে তাদের সবাইকে একটা পরিবার-ভুক্ত বলা চলে আবার অ্য অর্থে কয়েকটি পৃথক পরিবারের সমষ্টিও বলা চলে। মাতার জীবনকালের তাদের কন্যাদের যে সন্তানাদি হয় তার দ্বারা আবার ছোট ছোট শাখা পরিবারের সৃষ্টি হয়। কারণ মাতার নামেই সন্তানরা পরিচিত হয়। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে, দিবার সন্তানরা দিবা-পুত্র বা দিবা-কন্যা বলেই পরিচিত। কিন্তু, খাদ্য মাংস বা ফল বা মধু যাই তারা সংগ্রহ করুক না কেন তা দিবা সন্তানদের ব্যক্তিগত নিজস্ব সম্পত্তি হবে না। জনের স্ত্রী পুরুষ সকলে একত্রে সম্পত্তি অর্থ্যাৎ খাদ্যবস্তু প্রভৃতি সংগ্রহ করে—আর সকলে মিলেই তা ভোগ করে। যদি কিছুই আহরণ করা সম্ভব না হয়, তবে একসঙ্গে সকলেই অনাহারে থাকবে। জন থেকে পৃথক করে ব্যক্তি বিশেষের কোনো বিশেষ অধিকার থাকে না। জনের বা গোষ্টীর আজ্ঞা এবং রীতিনীতি পালন করা তাদের কাছে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার মতোই সহজ বলে মনে হতো।