৩.
এখন বসন্তকাল। দীর্ঘদিনের হিম-মৃত্যুতে ঢাকা প্রকৃতি আবার নবজীবনে মঞ্জরিত হয়ে উঠেছে। গত ছ’মাস যে ভূর্জ গাছ ছিল নিষ্পত্র–তাতে নবপল্লব জন্ম নিচ্ছে। বরফ গলে যাওয়ার পর পৃথিবী আবার হয়ে উঠেছে শ্যামল, বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে বনষ্পতি ও ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধে ছড়াচ্ছে অপূর্ব মাদকতা। দিগন্তব্যাপী সারা পৃথিবী নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কোথাও গাছে গাছে শোনা যেতে লাগল পাখীদের কাকলী, কোথাও বা ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাক। গলে যাওয়া বরফের স্রোতে ধারে বসে কোথাও বা নানাজাতীয় জলচর পাখী ছোটখাট পোকা-মাকড় খুঁটে খাচ্ছে, আবার কোথাও বা রাজহংসগুলিকে প্রণয়-ক্রীড়া-রত দেখা যাচ্ছে। এখন এই শ্যামল পার্বত্য বনের মধ্যে দেখা যাবে দলে দলে হরিণগুলোকে ছুটে বেড়াতে। কোথাও ভেড়া, কোথাও ছাগল, রক্তমৃগ বা গরু চরে বেড়াচ্ছে আর এদের শিকারের জন্য ওৎ পেতে বসে আছে নেকড়ে আর চিতাবাঘ।
শীতের সময় নদী হয়ে যায় অবরুদ্ধ জমাট বরফ। শীতের অবসানে আবার বিগলিত ধারায় প্রবাহিত হয়। অবরুদ্ধ নদীর মতোই যে মানুষের দল আটকে পড়েছিল তারাও দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আপন আপন অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, চামড়া ও ছোট ছেলেমেয়েদের বোঝা ঘাড়ে করে গৃহ-অগ্নি নিয়ে মানুষের দল আরও উন্মুক্ত অঞ্চলে অগ্রসর হতে থাকল। যতই দিন যেতে লাগল–পশু ও বনষ্পতির মতোই মানুষের শুক্নো কুঞ্চিত চামড়ার নীচে আবার মেদ-মাংস জমতে লাগল, কখনও কখনও তাদের পোষা রোমশ কুকুরগুলো হরিণ বা ছাগল ধরে আনত, আবার কখনও বা তারা নিজেরাই ফাঁদ পেতে তীর বা কাঠের বর্শা দিয়ে জানোয়ার শিকার করত। নদীতে মাছও ছিল প্রচুর, ভোলগার তীরবর্তী অধিবাসীদের জাল কখনও খালি উঠত না।
এই সময় রাত্রে ঠাণ্ডা পড়ত, তবে দিনের বেলা থাকত গরম। বর্তমানে আরও কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে মিলে ভোল্গার তীরে নিশা পরিবার বসবাস করছিল। নিশার পরিবারের মতো অন্যান্য পরিবারগুলিও মায়েদের ছিল। এদের পরিবার পিতৃশাসিত নয়, পরিবারগুলি মাতৃশাসিত। তার কারণও ছিল, তখন কে কার পিতা তা বলা আদৌ সম্ভব ছিল না। নিশার বয়স বর্তমানে পঞ্চান্ন। তার আটটি মেয়ে ও ছ’টি ছেলের মধ্যে চার মেয়ে এবং তিনটি ছেলে বেঁচে আছে। তারা যে নিশার সন্তান তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ প্রসবের সাক্ষী স্বয়ং বর্তমান, কিন্তু কে যে পিতা তা বলা যায় না। নিশার পূর্বে তার মা অর্থাৎ বৃদ্ধ মাতামহীর যখন শাসন ছিল, তখন তার পরিণত বয়সে অনেকগুলি স্বামী ছিল। এই স্বামীদের কেউ বা ভাই-স্বামী বা পুত্র-স্বামী। তারা আবার বহুবার নিশার সঙ্গে নাচ গানের সময় প্রেমপ্রার্থী হয়েছে। তারপর নিশা যখন নিজে কর্ত্রী হল তখন তার নিরস্তর পরিবর্তনশীল কামনাকে প্রত্যাখ্যান করবার সাহস তার ভাই বা পুত্রদের ছিল না। এই জন্যই নিশার জীবিত সাত সন্তানের কে কার পিতা বলা অসম্ভব। নিশার পরিবারে এখন সে নিজেই সবচেয়ে বড়–বয়স ও প্রতিপত্তি দুই দিক দিয়েই। অবশ্য এই কর্তৃত্ব আর বেশিদিন থাকবে না। দ’এক বছরের মধ্যে সে নিজেও বুড়ি দিদিমাতে পরিণত হবে। আর মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বলিষ্ঠা শক্তিশালিনী কন্যা হচ্ছে লেখা–সে তার স্থান দখল করবে। অবশ্য এই অবস্থাতে লেখার সঙ্গে তার বোনদের ঝগড়া অনিবার্যভাবেই বাঁধবে। প্রত্যেক বছরই কিছু লোক নেকড়ে বা চিতাবাঘের মুখে, ভাল্লুকের থাবায়, বুনো ষাঁড়ের সিং-এ, ভোলগার স্রোতে যেখানে প্রাণ হারাচ্ছে সেই ক্ষয়িষ্ণু পরিবারকে রক্ষার দায়িত্ব হচ্ছে প্রতি পরিবারের রাণী মায়ের! অবশ্য লেখার বোনদের মধ্যে হয়ত কেউ কেউ স্বাভাবিকভাবেই স্বতন্ত্র পরিবার গড়ে তুলবে। এই রকম ভাবে পরিবারের শাখা বেরিয়ে যাওয়া তখনি বন্ধ হবে যখন পুরুষ হবে দলের কর্তা। অনেক পুরুষের একজন স্ত্রীর বললে, একজন পুরুষ অনেক স্ত্রীর স্বামী হবে।
পরিবারের কর্ত্রী নিশা লক্ষ্য করেছে তার মেয়েদের মধ্যে লেখাই শিকারে সবচেয়ে পটু। পাহাড়ে চড়তে পারে হরিণের মত দ্রুত গতিতে। একদিন সকলের নজরে পড়ল উঁচু পাহাড়ের শৃঙ্গদেশে একটি মৌচাকের ওপর। এত উঁচু যে মধুকর ভাল্লুকও সেখানে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু লেখা লাঠির পরে লাঠি বেঁধে টিকটিকির মতো সেগুলো বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওপরে উঠে রাত্রে মশাল জ্বেলে হুলো মাছিগুলোকে পুড়িয়ে মৌচাক ফুটো করে দিয়ে তার নীচে থলি ধরল। তাতে কম করে হলেও ত্রিশ সেরের কম মধু পড়েনি। শুধু নিশা পরিবার নয়, লেখার এই দুঃসাহসিকতার প্রশংসা অন্যান্য পরিবারগুলিও করেছিল। কিন্তু মা নিশা এতে আনন্দিত হল না। মা দেখল যে তার পুত্রেরা এখন লেখাত ইঙ্গিতে নাচতে যতটা উৎসাহ পায়, ততটা আগ্রহান্বিত নয় তার কথায়। অবশ্য খোলাখুলিভাবে তাতে অবজ্ঞা করার সাহস এখনো তাদের হয়নি।
কিছুকাল ধরেই নিশা একটা উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করছিল। অনেক সময় তার ইচ্ছা হত লেখাতে ঘুমন্ত অবস্থায় মেরে ফেলতে, কিন্তু সে সাহস পেত না। সে জানত লেখা তার চেয়ে শক্তিশালিনী। সে অন্যের সাহায্য চাইতে পারে, কিন্তু তাকে অন্যরা সাহায্য করবে কেন? পরিবারের সব পুরুষই লেখার প্রেম-প্রার্থী, কৃপার পাত্র হতে চায়। নিশার অন্য মেয়েরাও তাকে সাহায্য করবে না, কারণ তারা ভয় করত লেখাকে। তারা জানত যদি এই ধরনের কোন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় তা’হলে তাদের সকলকেই অসহ্য কষ্ট পেয়ে মরতে হবে। নির্জনে বসে বসে নিশা ভাবছিল। সহসা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল, লেখাকে পরাস্ত করার উপায় সে খুঁজে পেয়েছে। বেলা তখন এক প্রহর। নিশা ও পরিবারের অন্যান্য সকলেই নিজ নিজ তাঁবুর পেছনে বসে অথবা শুয়ে, নগ্নদেহে রোদ পোহাচ্ছিল। নিশা বসেছিল তাঁবুর সামনে, লেখার তিন বছরের ছেলেটি খেলছে তার সামনে।
নিশার হাতে ছিল পাতার ঠোঙা-ভর্তি লাল স্ট্রবেরী ফল। পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ভোলগা নদী, নিশার সমুখের জমি ঢালু হতে হতে ভোলগার জলে গিয়ে মিশেছে। নিশা একটা ফল মাটিতে গড়িয়ে দিল–ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে সেটা কুড়িয়ে খেল। আবার একটি ফল নিশা গড়িয়ে দিল, এটা কুড়িয়া নিতে ছেলেটি আরো কিছুদূর এগিয়ে গেল। আরও একটি ফল গড়িয়ে দিল–আরো দূরে গেল ছেলেটি। এভাবে দ্রুততালে একটার পর একটা ফল নিশা গড়িয়ে দিতে লাগল। ক্রমেই ছেলেটি তা কুড়িয়ে নিতে আরো দ্রুত আরো দূরে যেতে লাগল। এমনি করে হঠাৎ পা পিছলে ভোলগার খরস্রোতে ছেলেটি পড়ে গেল। সেইদিকে চেয়ে নিশা চিৎকার করে উঠল। লেখা কিছুদূরে বসে সব দেখছিল। সে ছুটে এসে নদীর খরস্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছেলেটি তখনো একবার ভাসছে একবার ডুবছে–লেখা তাকে ধরে ফেলল। ছেলেটি ইতিমধ্যে বেশ খানিকটা জল খেয়ে নেতিয়ে পড়ছে। তা’ছাড়া ভোলগার বরফ-গলা ঠাণ্ডা জল ছুঁচের মত তার গায়ে বিঁধছিল। অনেক কষ্টে লেখা তার ছেলেকে নিয়ে স্রোতের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে লাগল। এক হাতে তার ছেলে, অন্য ও পা দিয়ে সে সাঁতার কেটে এগোবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ সে টের পেল এক জোড়া বলিষ্ঠ হয়াত তার গলা চেপে ধরেছে। লেখার আর বুঝতে বাকি রইল না–কে সে? অনেক দিন ধরেই লেখা লক্ষ্য করছিল তার প্রতি নিশার আচরণের পরিবর্তন। আজ দেখল সুযোগ বুঝে নিশা তার পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলতে উদ্যত। লেখা তখনো নিশাকে নিজের শক্তির পরিচয় দিতে পারত কিন্তু তার হাতে ছিল ছেলে। লেখাকে বাধা দিতে দেখে নিশা নিজের দেহের সমস্ত ভার দিয়ে লেখার মাথার ওপর নিজের বুকটাকে চেপে ধরল। এতক্ষণ পর লেখা প্রথম জলের নীচে তলিয়ে গেল। প্রাণপণে ওপরে উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে ছেলেটা হাত থেকে ফস্কে গেল। ইতিমধ্যে নিশা লেখাকে বেশ সঙ্কটজনক অবস্থায় এনেছিল। কিন্তু হঠাৎ নিশার গলার নাগাল পেয়ে লেখার তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হাত দিয়ে নিশার গলা চেপে ধরল। লেখা ততক্ষণে নিজেও অজ্ঞান হয়ে গেছে আর তার দেহের গুরুভার নিশাকেও জলের নীচে টেনে নিচ্ছিল–নিশার তখন বাধা দেবার সামর্থ ছিল না। তবু নিশা কিছুটা চেষ্টা হয়ত করত কিন্তু এখন সবই বিফল। দু’জনে দু’জনার দ্বারা পিষ্ট হয়ে ভোলগার স্রোতে তলিয়ে গেল। পরে নিশা পরিবারের কর্ত্রী-মা হল পরিবারের সবচেয়ে বলিষ্ঠ স্ত্রীলোক রোচনা।*