একদিন বরুণ, পাল মাদ্রকে সুমিত্রের কাছে পাঠাল — গান্ধার বণিকের কাছ থেকে উপঢৌকন নিয়ে যাবার ছিল করে। পাল ফিরে এসে বলল, পীতকেশ ও গৌরবর্ণ বাদ দিলে সুমিত্ৰ এখন পুরোপুরি একটি অসুর-রাজ বনে গেছে। তার প্রাসাদ আর আর্যভাষী সেনাপতির সরল অনাড়ম্বর বাসস্থান নয়, রৌপ্য অলঙ্কারে ঝলমল অসুর- রাজের প্রাসাদকক্ষের মতোই সুসজ্জিত। তার পার্শ্বচর সৈনিকদের মধ্যেও অনাড়ম্বরতার কোনো চিহ্ন নেই। সপ্তাহ যেতে না যেতেই তারা ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করে বুঝল – এখন আর্যভাষী সেনানায়কদের খবর নিতে হলে অসুর কন্যাদের নৃত্য ও সূরাপানের আড্ডাগুলিতে সন্ধান করতে হবে। বহু আর্যভাষী রমণী তাঁদের স্বামীদের কাছে এসে গৃহসংসার পাততে চায়, কিন্তু নানা অজুহাত দেখিয়ে তাদের আসতে মানা করা হচ্ছে। সুমিত্র তার স্ত্রীর কাছ থেকে বহু অনুরোধ পাওয়া সত্ত্বেও তাকে আসতে নিষেধ করেছে, এদিকে সে নিজে অসুর পুরোহিতের কন্যাকে প্রেম সমর্পণ করছে। শুধু তাই নয়, এ নগরীর বহু অসুর-সুন্দরী তার অন্তঃপুরচারিণী। নিজের পার্শ্বচর আর্য সৈনিকদের জন্যে এ ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ শিথিলতা ছিল। কিন্তু অন্য আর্যভাষীরা যদি এখানে যাতায়াত শুরু করত তাহলে অনার্থ দাসদের দিয়ে দাঙ্গা বধিয়ে দিত ফলে বাইরের আর্যভাষীরা এখানে আসা বন্ধ করেছে।
বরুণ পুরোপুরি খবরাখবর নিয়ে তার বন্ধুর সঙ্গে চুপচাপ সৌবীরপুরে ফিরে এল। সৌবীরপুরে এসে জন-নায়কদের বলল যে, সুমিত্র ইতিমধ্যে তার শক্তি যথেষ্ট দৃঢ় করেছে। অসুরপুরের শুধু আৰ্যশক্তিই নয় – অসুরদের বিরুদ্ধেও আমাদের যুদ্ধ করতে হবে, আর এ জন্যে তৈরী হয়েই সমস্ত কথা সাধারণ মানুষকে বলতে হবে।
বরুণ ছিল নাচের আসরের প্রিয় পাত্র। বছরের পর বছর যে সমস্ত স্ত্রীরা স্বামীদের জন্যে বৃথাই অপেক্ষা করে বিরহ সহ্য করছে তারা যখন এই সুন্দর নর্তকের মুখে তাদের স্বামীদের কীর্তিকলাপ শুনল তখন তা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করল। ক্ৰমেই এক থেকে অপর কান খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কথাটা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। বরুণ নিজে ছিল একজন কবি, পতি-বিরহিনী আর্য রমনীদের জীবনীতে অসুর কন্যাদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ উপলক্ষে সুমিত্রের বিলাসপূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ-সর্বস্ব জীবনের আলেখ্য নিয়ে সুন্দর সুন্দর গান রচনা করল। এই গান ক্রমেই দাবানলের মতো সারা সৌবীরের আর্য গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে গেল —মুখে মুখে গীত হতে লাগল। কিছু কিছু আর্য স্ত্রীরা যাতে তাদের স্বামীর কাছে যায় তার ব্যবস্থা করা হল। স্বামীদের কাছে তিরস্কৃত হয়ে তাদের ফিরে আসার পরিণাম আরও খারাপ হল। এবার সুমিত্ৰকে সৌবীরপুরে ফিরে আসতে বলা হল এবং সে ফিরে আসতে অস্বীকার করায় তার স্থলে বরুণকে সেনানায়ক নিযুক্ত করে বৃহৎ আর্যবাহিনীর সেনাপতি হিসাবে বরুণকে পুরোভাগে রেখে অসুরপুরীতে অভিযান শুরু হল। বরুণের আগমন বার্তায় সুমিত্রের সৈন্যদের মধ্যে ভাঙন ধরুল এবং অনেকেই নিজেদের অনার্য ব্যবহারের জন্যে অনুতপ্ত হল। অবশিষ্ট সৈন্যদের সাহায্যে সুমিত্রর জিতবার আশা ছিল না, তাই সে বরুণের হাতে নগর সমর্পণ করে সৌবীরপুরে ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করল। এইভাবে আর্য-জন প্রথমবারের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। বরুণ অসুরদের প্রতি কোনো প্রকারের দয়া প্রদর্শন করল না। অসুরদের কাছে কোনো অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও এবং তারা কোনো যুদ্ধ না করলেও বরুণ তাদের রেহাই দিল না। আর্যরা যাতে অসুরদের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে পারে তার জন্যে এক আলাদা আর্যনগরী নির্মাণ করে ঋর্ষি অঙ্গিরা বর্ণিত – শিক্ষাকে কাজে লাগানো হল।*
[*প্রায় দেড়শত পুরুষ আগেকার কাহিনী।]
০৭. সুদাস (স্থান: কুরু-পঞ্চাল (উত্তর প্রদেশের পশ্চিম) ।। কাল: ১৫০০ খৃষ্টপূর্ব)
বসন্তকাল শেষ হয়ে আসছিল। চন্দ্ৰভাগা নদীর তীরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পাকা সোনালী গমের শীষগুলি হাওয়ায় দোল খাচ্ছিল, আর এদিক সেদিক থেকে স্ত্রী-পুরুষ গান গাইতে গাইতে ক্ষেতের ফসল কাটছিল। কাটা ক্ষেতের যে সব জমিতে নতুন ঘাসের উদগম হয়েছে সেখানে বাচ্চাসমেত ঘোড়াগুলিকে চরবার জন্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে একজন ক্লান্ত পথিককে আসতে দেখা গেল তার পরনে মলিন ছিন্ন বসন, মাথায় একটি পুরনো চাদর। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে ছিন্ন উষ্ণীষে ঢাকা সোনালী চুলের জট দেখা যাচ্ছিল—পুরনো চাদরে শরীর আবৃত, কোমরে জড়ানো ছিলো অন্তর্বাস—হাঁটু পর্যন্ত একখণ্ড কাপড়।
হাতের লাঠির ওপর ভর করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলছিল, পিপাসায় গলার তালু পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছে। তবু পরবতী গ্রামে পৌছাবেই এই পণ নিয়ে সে এগিয়ে চলছিল, কিন্তু পথের ধারে একটি কুয়া ও ছোট শমীবৃক্ষ দেখে তার পূর্ব প্রতিজ্ঞ ভেঙে গেল। প্রথমে সে উষ্ণীব বস্ত্র খুলল পরে উলঙ্গ হয়ে পরণের ধুতি খুলে একত্রে বেঁধে কৃয়ার মধ্যে একটি প্রান্ত ফেলে দিল, কিন্তু জলের নাগাল পেল না। একান্ত নিরাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত গাছের। ছায়ায় গিয়ে বসল। তার মনে হতে লাগল আর কোনোদিন সে উঠতে পারবে না। ঠিক। সেই সময়ই এক কাঁধে একটি মশক, অন্য কাঁধে দড়ি আর হাতে চামড়ার কলসী নিয়ে হাজির হল একটি কুমারী মেয়ে। তরুণীটি কুয়ার কাছে এসে কলসীটা যখন জলে ডেবাতে যাচ্ছে, তার চোখ পড়ল পথিকের দিকে। পথিকের মুখের চেহারা ফ্যাকাসে, ঠোঁট দুটো গেছে, চোয়াল গেছে চুপসে–কিন্তু তা সত্ত্বেও তারুণ্যের দীপ্তি তার মুখমণ্ডলে স্পষ্ট ফুটে বেরুচ্ছিল।