(৩)
সৌবীরের (তৎকালীন সৌবীর দেশ বর্তমান করাচীর কাছে) দক্ষিণ অঞ্চল থেকে এখানে নানা রকমের দুঃসংবাদ আসতে থাকায় বরুণ ক্রমেই চিন্তান্বিত হয়ে পড়ছিল। সে বুঝতে পারছিল যে, অসুরদের শেষ দুর্গের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আর্যদের নিজেদের মধ্যে এক ভয়ংকর আত্মকলহের ঝড় আসন্ন।বরুণ কয়েকবারই সৌবীরেরে সমস্যা নিয়ে গুরুর সঙ্গে আলোচনা করেছিল। ঋষি অঙ্গিরার বক্তব্য ছিল যে, হতে পারে এই ঝগড়ার সূত্রপাত সৌবীরের মধ্যেই শুরু হয়েছে, কিন্তু এ কথা ঠিকই যে, এই বিরোধ একদিন সারা আর্য
জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আর্যভাষীরা চিরকাল জনের (সমষ্টির) অধিকারকে ব্যক্তির অধিকারের ওপর স্থান দিয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি অসুরদের রাজসত্তার এই নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছাচারিতা ও ভোগবিলাসিতার নিদর্শন অনেক আর্যভাষী নেতাকে ক্ষমতালোভী ও আত্মসর্বস্ব করে তুলবার আশঙ্কা হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই দুই মনোবৃত্তির সংঘাতও ছিল অবশ্যম্ভাবী, আর যে জনপদে অসুররা সংখ্যায় বেশী – সংঘর্ষের সম্ভাবনাও সেখানে বেশী; কারণ পরাজিত অসুররা আর্যদের এই আত্মঘাতী সংঘর্ষ থেকে লাভবান হতে চেষ্টা করবে এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক।
সৌবীরপুর থেকে দুঃসংবাদ আসতে থাকায় বরুণ আট বছরের আবাসন্থল গান্ধারপুর ছেড়ে দেশে ফিরতে মনস্থ করল। এখানে আসার পথে ঋষি শিষ্যদের মধ্যে প্রথম যাকে পথ-চলা সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিল সেই পুরাতন বন্ধু পাল মাদ্র তার সহযাত্রী হল। গান্ধারপুরের সীমানা অতিক্রম করে তারা লবণ-পাহাড়ের পথ ধরে সিন্ধু জনপদে প্রবেশ করল। লবণের খনিতে কর্মরত ব্যাপারী ও শ্রমিকদের মধ্যে অসুরদের সংখ্যা বেশী, আর এদের প্রভাব গীতকেশী আর্যভাষীদের ওপর পড়েছিল। আর্যরা ইতিমধ্যেই অলস ও আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা নিজেদের কাজগুলো অনার্য কারিগর দিয়ে করিয়ে নিত। তারা ভাৰত তরবারি নিয়ে অস্ত্রচালনা করা বা অশ্বারোহণ করাই তাদের একমাত্র উপযুক্ত কাজ। অসুর-রাজ যেমন অন্যের ওপর নিজে প্রতিপত্তি দেখাত তেমনি একইভাবে অনার্যদের ওপর ছোট ছোট প্রতিপত্তি খাটাতে গিয়ে আর্দের মনে রাজসত্তার অঙ্কুর উদগমের ভূমি প্রস্তুত হতে লাগল। দুই বন্ধু ধীর পদে লবণ-পাহাড় অতিক্রম করে এসে পৌঁছাল সৌবীর সীমান্তে (এই স্থানকে বর্তমানে মূলতান বলা হয়), এখানকার অবস্থা কিছুটা উন্নত মনে হল।এখানকার সমস্ত অধিবাসী আর্য আর জনের পক্ষে সেটা ছিল খুবই গর্বের ব্যাপার। এখানকার ভীষণ গরম সহ্য করে জনপদকে এরা পুরোপুরি আর্যভাষী জনপদে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বরুণ ও পাল সিন্ধু নদের ওপর দিয়ে নৌকা বেয়ে চলেছিল, তাই সময়টা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি হলেও পুরো কষ্টটা তারা পায়নি। তবু সৌবীর নগরের আবহাওয়া ছিল অত্যাধিক গরম, তার প্রভাব অবশ্যই কিছুটা পড়েছে।
আর্যরা তখন পর্যন্ত অক্ষর আবিষ্কার করতে পারেনি। তখন এদের মধ্যে লেখার সঙ্কেত (লিপি)প্রচলিত হয়নি।তারই বরুণ মাঝে মাঝে সৌবীরের পখথকদের মারফতে তার মিত্রদের কাছে যে সমস্ত সংবাদ পাঠাত তা পুরোপুরি কোনোদিনই পৌঁছাত না। এই সময় অসুরদের মধ্যে প্রচলিত লিপির কথা তার মনে আসত।
সৌবীরপুরে পৌঁছে সে বুঝতে পারল যে, অবস্থা অনেক দূর গড়িয়েছে। খাস সৌবীরপুরে সুমিত্রের সমর্থক কম ছিল; কিন্তু দক্ষিণ সৌবীরপুরে অসুরদের শেষ দুর্গ ধ্বংসকারীদের মধ্যে বহু আৰ্য সুমিত্রের পক্ষ গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত ছিল। এই শেষ দুর্গটির পতনের পর সেনাপতি সুমিত্র অসুর নাগরিকদের প্রতি অতিরিক্ত অনুকম্পা দেখিয়েছিল বলে বরুণ সেই সময় তার খুব প্রশংসা করেছিল। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারল যে, সেটা ছিল সুমিত্রের একটি চালমাত্র। সুমিত্র জানত যে, অসুররা আর কোনোদিনই আর্যদের বিরুদ্ধে মাথা তুলতে পারবে না। তাই তাদের ওপর এই অনুকম্পা দেখিয়ে সাগরপারের সার্থবাহ অসুরদের সম্পত্তি ও তাদের শক্তির সাহায্যে নিজের ব্যক্তিগত লোভ চরিতার্থ করতে পারবে৷
সুমিত্র তখনো সমুদ্রতীরের অসুরপুরী আপন সৈন্য দিয়ে দখল করে রেখেছিল আর কাল্পনিক যুদ্ধ পরিচালনার অজুহাত সৃষ্টি করে সেখান থেকে ফেরবার নাম পর্যন্ত করত না।সাধারণ দলপতিদের সঙ্গে দেখা করে বরুণ বুঝতে পারল যে, তাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই, তারা ভাবত ব্যক্তিগত আক্রোশের ফলে কোনো কোনো জন-নায়ক সুমিত্রের বিরোধিতা করছে। বরুণ যখন জনের শাসনভারপ্রাপ্ত প্রধান জন-নায়কের সঙ্গে দেখা করল। তখন সে বরুণকে সমস্ত কথা বুঝিয়ে বলল এবং বলল যে, সুমিত্রের উদ্দেশ্য যদিও তার কাছে খুবই স্পষ্ট, তবু এ কথা ঠিকই যে, জনের সাধারণ মানুষ এখনো সুমিত্রের আসল মতলবের কথা জানে না, তারা তাকে অন্যভাবেই দেখে।
অসুরপুরী আক্রমণের সময় বরুণ ছিল সুমিত্রের সাহসেনাপতি। ইতিমধ্যে যদিও ন’টা বছর কেটে গেছে; তবু আজও তার তরবারি চালনার প্রশংসা থেমে যায়নি। জনকে বোঝাবার আগে নিজেই অসুরপুরীতে গিয়ে সুমিত্র সম্পর্কে সঠিক সংবাদ নিয়ে আসা মনস্থ করল। এই উদ্দেশ্যে দুই বন্ধু একদিন দক্ষিণ সৌবীর যাত্রী একটি নৌকায় আরোহণ করল। তারা নিজেদের গাদ্ধারদেশীয় বণিকের বেশে সুসজ্জিত করেছিল। অসুরপুরী দেখে তাকে কিছুতেই আর্যভাষীদের নগরী বলে মনে হয় না – তা সত্যি সত্যি অসুরদের পুরী ছিল। তখনো তা আৰ্যনগরী হয়নি। শহরের পণ্যবীথি প্রাসাদমালায় পূর্ণ ছিল, ছিল সমুদ্রযাত্রী অসুর বণিকদের নিয়ে আসা নানা দেশের বাণিজ্য সম্ভার। বহু সামন্ত অসুর-পরিবার তাদের আপন আপনি পল্লীতে আগের মতোই বসবাস করছিল, তাদের গৃহে পূর্ণের মতো শৃঙ্খলিত বন্দী দাস-দাসী অপেক্ষা করছে বিক্রি হওয়ার জন্যে। এইসব দেখতে দেখতে ওদের মনে প্রশ্ন উঠল, এই পরিবেশে বিজয়ী আর্যরা কোথায়? সুমিত্র নিজেও অসুর-রাজের পুরাতন ব্রাজপ্রাসাদে বাস করে।