“বৎস! যা কিছু নতুন তা সবই পরিত্যাগ করতে হবে, অথবা প্রাচীন হলেই তা গ্ৰহণযোগ্য – এই ধরনের কথা খুবই ভুল। আর এই আপ্তবাক্যকে কাজে লাগানো তো একেবারেই অসম্ভব। কক্ষু নদীর তটভূমিতে আর্যরা যেদিন পাথরের অস্ত্রাদি ছেড়ে উন্নত ধরনের তামার অস্ত্র ব্যবহার করতে শিখল সেদিন কত লোকই না নতুন হাতিয়ারের বিরুদ্ধতা করেছিল।”
শিষ্য বরুণ প্রশ্ন করল, “পাথরের অস্ত্রাদি দিয়ে কিভাবে কাজ চলত?”
“বৎস, আজ তামার প্রচলন হয়েছে তাই তামার হাতিয়ার খুবই তীক্ষ্ণ মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতে এর চেয়েও তীক্ষ্ণ কোনো ধাতুর হাতিয়ার গড়া হবে তখন আবার মানুষ হয়ত তোমার মতো প্রশ্ন করবে তামার হাতিয়ার দিয়ে কিভাবে কাজ চালাত।মানুষ যখন যে হাতিয়ার সংগ্রহ করতে পারে, তখন তাই দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয় — সেইভাবেই তারা অভ্যস্ত হয়। যখন পাথরের কুড়ুল দিয়ে যুদ্ধ করত, তখন উভয় পক্ষের যোদ্ধাদের পাথরের হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু যে-ই একপক্ষ তামার তরবারির ব্যবহার শিখল তখনই অপর পক্ষের কাছে পাথরের কুড়ুল ত্যাগ করে তামার তরবারি ব্যবহার করা অপরিহার্য হয়ে উঠল। আর তারা যদি তা না করত, এ দুনিয়াতে তাসের কোনো চিহ্ন থাকত না। তাই আমি বলছিলাম, সমস্ত নতুন চিন্তাধারা পরিত্যাজ্য এ কথা খুবই ভুল। আমি নতুনদের বিরোধী হলে এত সুন্দর সুন্দর ঘোড়া, গরু প্রতিপালন করতে পারতাম না। আমি জেনেছিলাম যে, ভালো ঘোড়ার বাচ্চা পেতে হলে ভালো জাতের ঘোটক ঘোটকীর মিলন চাই। তাই আজ পঁয়ত্রিশ বছর পরে এ-জাতীয় শ্রেষ্ঠ ঘোটক-ঘোটকী দেখতে পাচ্ছ।
“অসুররা ক্ষেতের জমি ভালোভাবেই দেখা-শোনা করত, তাতে ভালো সার দিত। তারা পাহাড়ী নদী থেকে খাল কেটে সেচের যে ব্যবস্থা করত – তা যে খুব উঁচু ধরনের এ কথা আমরা স্বীকার করি। তাদের শহর গড়ার কায়দা ও চিকিৎসার নানা রকম ভালো ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করেছি। এ কথা ভাবলে চলবে না যে, এটা নুতন না পুরনো, এটা আৰ্য না অনার্য – খাওয়া-পরা ও জীবনধারণের মানকে উন্নত ও সহজ করার জন্যে যত রকম জিনিস পাওয়া যায়, তাকে স্বীকার করে কাজে প্রয়োগ করতে হবে। আগে আর্যরা কার্পাস তুলার ব্যবহার জানত না, সূতী বস্ত্রের নাম পর্যন্ত শোনেনি। কিন্তু এখন আমরা শ্ৰীষ্মকালে সূতী বস্ত্র পরি, গরমের দিনে এই কাপড় খুবই আরামদায়ক। এইভাবে নতুন জিনিস আমরা যেমন গ্রহণ করেছি তেমনি অনেক কিছু বর্জনও করেছি। এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলো বিষের ন্যায় পরিত্যাগ করা উচিত। অসুরদের লিঙ্গপূজা, তাদের ধর্ম অনুসরণ করা যেমন আমাদের পক্ষে নিন্দনীয়, তেমনি তাদের জাতি-বিভাগও বর্জনীয়। জাতি-বিভাগের জন্যেই মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে অস্ত্ৰধারণ করে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।এতে শুধু নিজেদের মধ্যে ছোট ও বড়, উঁচু-নীচু এই চিন্তার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ কথাও ঠিক যে, অসুরসের সঙ্গে আমাদের রক্তের মিশ্রণ হওয়া উচিত নয়, কেন না, তাতে আমাদের অসুরবৃত্তি গ্রহণেরই পথ উন্মুক্ত হবে। আর এর ফলে আর্যভাষীদের মধ্যেও নানা শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ছোট ও বড় জাতিবিভাগ দেখা দেবে।”
পাল প্রশ্ন করল, “রক্তের সংমিশ্রণকে প্রত্যেকটি আর্যভাষী খুব অনুচিত কাজ বলে মনে করে কি?”
জবাবে ঋষি,“ হ্যা, তবে এর জন্যে তারা ততো বেশী মনোযোগ দিতে রাজী নয়। আর্যভাষীরা অসুর কিম্বা কোল স্ত্রীসের সঙ্গে সমাগম করে।”
বরুণ, “সীমান্তের লোকেরা এ কথা বলেই থাকে যে, আমাদের যোদ্ধারা অসুরপুরীর বারাঙ্গনাদের কাছে হামেশাই যাতায়াত করে।”
ঋষি বলল, কথাটা ঠিক। কিন্তু, এর পরিণাম কি? এর ফলে বাড়বে বর্ণ-সঙ্করতা।
অসুরদের মধ্যেও পীতকেশ বালক-বালিকা জন্ম নেবে। ভ্রমবশত আর্যরা এদের নিয়ে আসবে নিজেদের পরিবার পরিজনদের মধ্যে, তখন আর্য-রক্তের বিশুদ্ধতা কোথায় থাকবে? আর এই রক্ত-শুদ্ধতার জন্য চাই সমস্ত আর্য স্ত্রী-পুরুষের জাতীয় সচেতনতা। আর এর জন্য চাই, আর্যদের মধ্যে দাসপ্রথা কিছুতে প্রবেশ করতে না পারে, তার ব্যবস্থা। কারণ, এর মতো রক্তের শুদ্ধতা নষ্টকারী সর্বনাশা জিনিস আর কিছুই নেই। আর্য জনপদে অনার্যরা যাতে কিছুতেই প্রবেশ করতে না পারে তারও ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। সবচেয়ে বিপদজনক ও সকল মন্দের মূলে আছে অসুরদের রাজ-প্ৰথা, আর এরই অপর অঙ্গ হচ্ছে পুরোহিত প্রথা। অসুর-জন তাদের সমস্ত অধিকার হারিয়ে বসে আছে। অসুর জনের কোনো স্বাধীনতা নেই, অসুর-রাজা যা বলবে সেই মতো কাজ করা অসুররা ধর্ম বলে মনে করে। অসুরদের পুরোহিতরা শেখায় যে, জনগণের ভালো-মন্দের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে। ওপরে ভগবান, আর নীচে তার প্রতিনিধি রাজা। এই ধর্মমত অনুসারে সাধারণের কিছু বলবার বা করবার নেই। ধরিত্রীতে স্বয়ং রাজাই হচ্ছে দেবতা। তাই আমি যখন শুনলাম, শিবি-সৌবীররা ইন্দ্ৰ পদ তুলে দিয়েছে তখন খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। যদিও এ কথা ঠিকই যে অসুর-রাজের স্থান ইন্দ্র কোনোদিনই অধিকার করতে পারেনি। আর্যদের মধ্যে ইন্দ্রের স্থান হচ্ছে – জন কর্তৃক নির্বাচিত একজন বড় যোদ্ধা বা সেনাপতি মাত্র। জনের ওপর শাসন করার কোনো অধিকার তার নেই। তবুও ওই পদ থেকে ভবিষ্যতে বিপদের আশঙ্কা ছিল এবং কিছু লোক ওই পদের আড়াল থেকে আর্যভামীদের মধ্যে রাজ-প্রথা কায়েমের চেষ্টাও করেছিল।আর্যভাষীরা যদি নিজেদের আর্যত্ব বজায় রাখতে চায় তা’হলে কাউকেই রাজ-অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না, আর উচিতও হবে না। কিন্তু যেদিন অসুরদের মতো রাজপদের সৃষ্টি হবে সেই দিনই অসুরদের মতোই পুরোহিতদেরও আবির্ভাব ঘটবে। আর এ-সব হলেই বুঝবে যে, আর্যভাষীদের আর্যত্ব নষ্ট হয়েছে। সমগ্র জন পরিশ্রম করবে, আর সেই আর সেই পুরশ্রমের ফলভোগ করবে রাপদে আসীন একজন ব্যক্তি। এর ওপর আছে পুরোহিত, পুরোহিতকে উৎকোচ দিতে পারলে ভগবানের আশীর্বাণী পাওয়া যাবে। এইভাবে রাজা ও পুরোহিতে মিলে সমগ্ৰ জনকে তাদের দাস করে ছাড়বে। আমাদের আর্যভাষীদের প্রাচীন রীতি-নীতিকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আঁকড়ে থাকতে হবে। এবং যেখানেই কোনো আর্যজন ব্যতিক্রম ঘটাবে — তাদের আর্য-শ্রেণী থেকে দূর করে দিতে হবে।”