“তা’হলে, তোমাদের ওখানে অসুরদের রীতি-নীতির প্রভাবের কোনো ভয় নেই?”
“মাদ্র-জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় নেই, মল্লদের বেলাও এ কথা বলা যায়। আরও আগের কথা বলতে পারি না, আমাদের ওখানের অনার্যরা জঙ্গলের বাসিন্দাই রয়ে গেল।”
দুই বন্ধু এইভাবে রাত্রি পর্যন্ত তাদের পরস্পরের খবরাখবর ও গল্পে মশগুল ছিল। অতিথিশালার পরিচারিকা এসে খাওয়া-দাওয়ার কথা জিজ্ঞেস না করলে তাদের কথা হয়ত শেষই হত না। এই অতিথিশালাটি নির্মিত হয়েছিল গ্রামবাসীদের খরচে – পথিকদের বিশেষ করে শ্বেতজাতির পথিকদের বিশ্রামের জন্য নির্মিত এ কথা অবশ্য বলার কোনো দরকার হয় না। যাদের কাছে আহার্য কিছু থাকত না, তাদের জন্য চাল-ভাজা ও গোমাংসের সুরুয়ার ব্যবস্থা হত। কোনো পথিকের কাছে খাদ্যবস্তু থাকলে তা সে অতিথিশালার রক্ষকের কাছে দিলে সে রান্না করে দিত, আর তা না থাকলে সমতুল্য কিছু দিতে হত। এই অতিথিশালাটি সোমরসের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। দুই বন্ধু গো-মাংস এবং মদ্য একত্রে পানাহার করে তাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় করে নিল।
(২)
ঋষি অঙ্গিরা সিন্ধুনদের পূর্ব-পারের এই গান্ধারের জন-এর শ্ৰেষ্ঠ সম্মানের অধিকারী হয়েছিল, সে একদা জন-পতি পর্যন্ত ছিল। পুষ্কলাবতীর (চরসদ্দা) প্রথম যুদ্ধের পর অসুররা পিছু হটতে শুরু করে। পরবর্তী পুরুষে গান্ধার জনের একটি শাখা কুনার তীর থেকে এসে পশ্চিম গান্ধার অঞ্চল অধিকার করল। তাই অসুররা পশ্চিম গান্ধার দেশ দ্রুত ত্যাগ করতে লাগল। মাত্র তিরিশ বছর যেতে না যেতেই গান্ধার ও মাদ্ররা সিন্ধু নদের পূর্বপারের ভূ-খণ্ড জয় করল। বিজিত দেশ তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল; বিতস্তা থেকে সিন্ধুর মধ্যকার ভূমি পেল গাদ্ধার জন আর বিতস্তা থেকে ইরাবতীর মধ্যকার ভূখণ্ড দখল করল মাদ্র-জন। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ দুটি অঞ্চলই দখলকারীদের নামানুসারে পূর্ব গান্ধার ও মাদ্র জনপদ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করল। এই প্রারম্ভিক দেবাসুর যুদ্ধে উভয় জাতিই অমানুষিক নৃশংসতার পাল্লা দিয়েছিল, যার পরিণামে গান্ধারভূমিতে একটি অসুরও অবশিষ্ট ছিল না। মাদ্রদের ভূখণ্ডেও খুব অল্পসংখ্যক অসুর অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধেরও আস্তে আস্তে ভঁটা পড়তে লাগল। পীতকেশীরাও তাদের যুদ্ধের সময়কার নিষ্ঠুরতা কমিয়ে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বরুণ সৌবীরের বর্ণনা অনুযায়ী গীতকেশীদের ওপর অসুরদের নানা প্রকার প্রভাব পড়তে লাগল। ঋষি অঙ্গিরা বক্ষু উপত্যকা থেকে আগত আৰ্য্যদের অতীত ঐতিহ্যের শুধুমাত্র বড় পণ্ডিতই ছিল না, সে চাইত আর্যভাষীরা তাদের রক্ত ও আচার-ব্যবহারের বিশুদ্ধতা বজায় রাখুক। এই কারণেই পূর্বগান্ধার দেশে অশ্ব-মাংস খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে আবার সেখানে অশ্বপালন প্রথা পুনরায় চালু করল। ঋষি অঙ্গিরার এ আর্যপ্রীতি, আর্য ঐতিহ্য ও আর্য শিক্ষায় তার অনুরক্তি এবং যুদ্ধবিদ্যায় অসাধারণ কুশলতার খ্যাতি, তাকে এমনি প্রথিতযশা করে তুলেছিল যে, সুদূর জনপদ থেকে আর্য কুমারগণ তার কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসত। কিন্তু সেদিন কে জানত যে, অঙ্গিরা রোপিত গান্ধারপুরের এই বিদ্যা-অঙ্কুর ভাবীকালে একদিন তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়-রূপ বিশাল মহীরূপে পরিণতি লাভ করবে। কে জানত, এই মহীরূহের ছায়ায় সুমিস্ট ফললাভের প্রয়াসে সহস্ৰ যোজন পথ দূর থেকে আর্যগাথার ভক্তরা ছুটে আসবে।
ঋষি অঙ্গিরার বয়স ৬৫ বছর। পলিত কেশ, কটি বিলম্বিত শ্বেত উজ্জ্বল শ্মশ্রু এবং সৌম্য মুখমণ্ডল ঋষির আকৃতিকে আকৰ্ষণীয় করে তুলেছে। সেদিন থেকে কয়েক শতাব্দী পরে কালি-কলম ও ভূৰ্জপত্রে লেখার রীতি মানুষের আয়ত্তে এসেছিল। তখন ছিল শ্রুতি ও স্মৃতির যুগ, তাই সব শিক্ষাই প্রদও হত মৌখিকভাবে, বিদ্যাধীরা পুরাতন সংগীত ও কাহিনী বার বাৱ আবৃত্তি করে – স্মরণে রাখত। দূর দেশ হতে আগত বিদ্যার্থীরা দীর্ঘদিনের উপযোগী নিজেদের খাদ্য-বস্ত্র আনতে পারে না। ঋষি অঙ্গিরাকেই খাদ্য বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে হত। এর জন্যে তার নিজের জমি চাষ করার পরও বিদ্যার্থীদের দিয়ে জংলা জমি চাষ করে নতুন আবাদ করেছিল। তাইতেই সারা বছরের উপযোগী যথেষ্ট গম উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়েছিল। তখনো পর্যন্ত পুষ্প উদ্যান করার রেওয়াজ হয়নি। কিন্তু বনের জংলী ফলমূল যখন পাকবার সময় হত তখন সে নিজের শিষ্যমণ্ডলী নিয়ে সেখানে তা আহরণে যেত, তখন তারা ফুলও সংগ্রহ করত। চাষের কাজে, বীজ বপন, ফসল কাটা অথবা ফুল ফল জ্বালানী কাঠ সংগ্রহের সময় বিদ্যার্থীরা বক্ষুর তীরে সুবাস্তুর তটভূমিতে রচিত গানগুলি পরম আদরে উচ্চ রাগিণীতে সমবেতভাবে গাইত। অঙ্গিরার অশ্বশালাও ছিল গান্ধারের মধ্যে সবচেয়ে বড়। দূর-দূরান্তের শিষ্য বা পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে অনুরোধ পাঠাত ভালো জাতের ঘোড়া ভেট আনবার জন্য, উচ্চশ্রেণীর ঘোটক-ঘোটকী সংগ্রহ করে ভালো জাতের ঘোড়ার বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা করত। পরবর্তীকালের বিখ্যাত সিন্ধী-ঘোটক সৃষ্টি হয়েছিল তারই অশ্বশালা থেকে। এ ছাড়া তার হাজার হাজার গরু ও ভেড়া ছিল। শিষ্যদের বিদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রমের কাজও করতে হত। অঙ্গিরা নিজেও কাজ করত কারণ কায়িক পরিশ্রম না করলে সকলের খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান হতে পারে না।
তক্ষশিলার পূর্বদিকের অধিকাংশ পাহাড় ছিল সুজলা সুফলা। একদিন বরুণ ও পাল একদল বিদ্যার্থীর সঙ্গে পশুচারণ ভূমিতে কাজে লিপ্ত ছিল। তাঁবু থেকে অনতিদূরে শ্বেত ও লোহিতাভ বর্ণের গো-বৎস খেলে বেড়াচ্ছিল। ঋষি অঙ্গির শিষ্যদের মাঝে বসে তকলি কাটছিল আর অতীত ও বর্তমানের আর্য ও অনার্যের রীতি, নীতি, শিল্প ও বাণিজ্যের মধ্যে কোনটা গ্রহণীয় আর কোনটা বর্জনীয় – তার ব্যাখ্যা করছিল।