“হ্যাঁ, আমি নিজেই দেখেছি অসুর পুরোহিতরা মানুষকে গাধা বানিয়ে ছাড়ে।”
“তারা জনসাধারণকে গাধার চেয়েও ছোট মনে করে। তুমি বোধহয় শুনেছ তারা লিঙ্গপূজা করে। শরীরের এই প্রভঙ্গ দুটি নর-নারীর সুখ-সম্ভোগের এবং ভবিষ্যবংশ সৃষ্টির কারণ বটে, কিন্তু তাকে পূজা করা আহম্মুকি নয়? অনেক জায়গায় আবার মাটির লিঙ্গ গড়ে পূজা করা হয়।”
“আহম্মুকি তো বটেই।”
“আর অসুররাজারা এই ধরনের পূজায় বিশেষ আসক্ত। আমার মনে হয়, এর মধ্যে একটা মস্ত চালাকী আছে, বিশেষত অসুররাজারা আর তাদের পুরোহিতরা মুর্থ হয় না, তারা আমাদের আর্যভাষীদের চেয়ে চতুর। তাদের মতো নগর বা দুর্গ বানাতে আমাদের অনেক শিখতে হয়েছে। তাদের দোকান-পাট, পুষ্করিনী, প্রাসাদ, রাজপথ- এ সমস্ত জিনিস তুমি আমাসের এই ভূখণ্ডে দেখতে পেতে না। আমি উত্তর সৌবিরের পরিত্যক্ত অসুর নগরী ও অধুনা বিজিত অসুর নগরটি দেখেছি। আমরা তাদের পুরনো নগরগুলি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হইনি – বিশেষ করে এই নতুন নগর, যা সম্বর প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে প্রবাদ আছে তা তো দেবপুরীর সমতুল্য।”
“বল কি, দেবপুরী?” “সত্যি বলছি। পৃথিবীর কোনো জিনিসের সঙ্গেই এর তুলনা হয় না। একটি পরিবারের বাসোপযোগী থাকবার গৃহের কথাই ধর না কেন। তাতে আছে – সুসজ্জিত বৈঠকখানা, চুন্নী সমেত রান্নাঘর, তার ধোঁয়া বেরবার আলাদা ব্যবস্থা, চত্বরে বাঁধানো কূপ, স্নানের ঘর, শোবার ঘর আর তা’ছাড়া আছে আলাদা গোলাঘর। দু-তিন তলার বাড়ি দেখেছি — সেখানে সাধারণ লোকেরাই থাকত। এর সঠিক বর্ণনা দেওয়া শক্ত, তুলনা করতে হয়।”
“পূব দেশেও অসুর নগরী আছে, সেগুলো আমাদের মাদ্রদেশ (বর্তমানে শিয়ালকোট) থেকে অনেক দূরে।”
“আমি তাও দেখেছি বন্ধু। এ রকম নগর যারা নির্মাণ করেছে, যারা পরিচালনা করেছে – তারা যে আমাদের থেকে অনেক বুদ্ধিমান ও চতুর। এটা স্বীকার করতেই হবে। তুমি সমুদ্রের কথা শুনেছি কখনো?”
“নাম শুনেছি।”
“নাম শুনে বা বর্ণনা শুনে তুমি মহাসাগর সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারবে না। সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে যখন তুমি দেখবে তার নীল জলরাশি আকাশ স্পর্শ করেছে— তখন তোমার চেতনায় আসবে – কিছুটা অনুমান করবে।”
“আকাশ পর্যন্ত কি সাগর পৌছাতে পারে, বরুণ?” “হাঁ, তাই হয়। তোমার দৃষ্টি যতদূর যাবে – তুমি দেখবে বিশাল জলরাশি, তরঙ্গের পর তরঙ্গে ক্রমেই ওপরে উঠছে – ফেনিল জলরাশি ক্রমেই আঞ্চাশ স্পর্শ করছে। উভয়ের বর্ণও এক, সমুদ্র নীলাকাশের মতোই নীল। আর দিগন্তহীন সাগরে অসুররা তাদের বড় বড় নৌকা নির্ভয়ে ভাসিয়ে দেয়- মাস, বছর অতিক্রম করে সমুদ্রপথে ঘুরে বেড়ায়, আর সমুদ্র পার থেকে রত্ন-ভাণ্ডার সংগ্রহ করে। অসুরদের সাহস ও কুশলতার এও একটা নজির। এছাড়াও আর একটি ব্যাপার আছে যা তুমি কোনোদিন শোননি। অসুররা মুখ ছাড়াই কথা বলতে পারে।”
“এ্যাঁ! শব্দ না করে? কি বলছ বন্ধু?”
“হ্যাঁ বিনা শব্দে। মাটি ও পাথর দিয়ে চামড়া বা কাপড়ের ওপর দাগ কেটে যাবে।
– অন্য অসুররা একটা শব্দ না শুনে বা মুখের দিকে না তাকিয়েই ওই সমস্ত সঙ্কেত বুঝতে পারবে। আমরা যা দু’ঘন্টা কথা বলে বোঝাতে পারব না, তা তারা পাঁচ দশটা সঙ্কেতে বুঝিয়ে দেবে। আর্যরা এ বিদ্যা জানত না। এখন তারা এইসব সক্ষেত বুঝতে চেষ্টা করছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে শিখেও কায়দা করতে পারছে না।”
“এ কথা নিঃসন্দেহ যে, অসুররা আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান।”
“দেখ না কেন! এখন আমরা তাদের সর্বত্রই কারিগর, মৃৎশিল্পী, তন্তুবায়, রথ প্রস্তুতকারক ও কর্মকার হিসাবে দেখতে পাই। তারা যে আমাদের চেয়ে গুণী তাতে আর সন্দেহ কি?”
“আর তুমিই তো বলছ অসুরা বীরও বটে।”
হ্যাঁ বীর তো বটেই। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। আর্যভাষীদের মতো ওদের বাচ্চারা মায়ের পেট থেকে পড়েই তরবারি নিয়ে খেলতে শেখে না। ওদের মধ্যে আছে কারিগর, বণিক, দাস প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী। তেমনি সেনানী বা যোদ্ধা হচ্ছে আলাদা শ্ৰেণী। যোদ্ধাশ্রেণী ছাড়া আর কেউ অস্ত্রবিদ্যা শেখে না। যারা যুদ্ধবিদ্যা শেখে না, যোদ্ধারা তাদের হেয় জ্ঞান করে। আর দাসদাসীরা পশু অপেক্ষা হীন জীবন যাপন করে। অসুররা শুধু এদের বেচাকেনাই করত না, তারা এদের দেহ এবং জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলত।”
‘তাদের যোদ্ধা কত?”
“শতকরা একজনও হয়ত তাদের সৈন্য নয়, কিন্তু দাসের সংখ্যা অনেক বেশী – শতকরা চল্লিশ জন। আর তাদের শিল্পী এবং কৃষকরাও অর্থ-দাস, শতকরা দশ জন হবে ব্যবসায়ী আর বাকীরা বৃত্তিধারী।”
“তাই তো অসুররা আর্যভাষীদের কাছে হেরে গেল।” “হ্যাঁ, ওদের হেরে যাওয়ার এটা একটা প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, তারা রাজাকে দেবতা বলে মানত, তাকে জনসাধারণের চেয়ে অনেক ওপরে স্থান দিয়েছিল।”
“আমরা এ ব্যবস্থা কখনই মানব না।”
“এইজন্যেই তো আমাদের ইন্দ্রের পদ বিলোপ করতে হল। মঘবার পর এক ইন্দ্র অসুর রাজার মতো হতে চেয়েছিল। আর সে কি একা, তারপর আরও অনেকে ইন্দ্র হবার চেষ্টা করেছিল। আর কয়েকজন আর্যভাষীও তাদের সাহায্য করতে গিয়ে ধরা পড়ল।”
“সাহায্য করতে গেল!”
“হ্যাঁ, তাই সমগ্র জন-পরিবারের স্বার্থবিবেচনা করে সৌবীর-জন সিদ্ধান্ত নিল যে, এরপর আর কাউকে ইন্দ্র করা হবে না। বজ্ৰ ধারণ করে যে দেবতা তার নামের সঙ্গে মিশে এই নামের মোহ মানুষকে বিভ্রান্ত করছিল –ইন্দ্ৰপদ তুলে দেওয়ার সেটাও কারণ বটে।”
“বন্ধু, সৌবীর-জন ভালো কাজই করেছে।”
“কিন্তু আর্যভাষীদের সুনামে কলঙ্ক আরোপ করার জন্যে কিছু লোক আছে যারা অসুরদের সবকিছুকেই প্রশংসা করতে ক্লান্তিবোধ করেনা। তাদের অনেক কিছুই প্রশংসনীয়, আমি নিজেও তার সমাদর করি। আমরা তাদের হাতিয়ার দেখেই আমাদের অস্তু বানিয়েছি, তাদের বৃষভ-রথ দেখেই তো আমাদের মঘবা ইন্দ্র তার অশ্বরথ নির্মাণ করেছিল। একজন তীরন্দাজের পক্ষে ঘোড়ার চেয়ে রথে বসে যুদ্ধ করা অনেক বেশী সুবিধাজনক। রথে বেশী তৃণ রাখতে পারে, শক্রর তীর থেকে আত্মরক্ষার জন্য আবরণও রাখতে পারে। আর্যরা অসুরদের বর্শা, গদা, শক্তি প্রভৃতি অস্ত্রাদি সম্পর্কে অনেক শিক্ষা নিয়েছে। অসুরদের নগরপরিকল্পনা থেকে আমরা অনেক কিছু গ্ৰহণ করেছি। তাদের কাছ থেকে সমুদ্রযাত্রা আমাদের শিখতে হবে, কারণ তামা ও অন্যান্য ধাতুরত্ন সাগরতীর থেকে আসে; এখনো এই ব্যবসা অসুর ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া। আমরা যদি তাদের থেকে স্বতন্ত্র হতে চাই তা’হলে সাগরে নৌ-চালনা শিক্ষা করতেই হবে। তবু এমন অনেক বিষয় আছে যা অসুরসের কাছ থেকে নেওয়া বিপদজনক -যেমন লিঙ্গপূজা।”
“কিন্তু লিঙ্গপূজা কোন আর্যভাষী স্বীকার করে নেবে।”
“আর বলো না বন্ধু! আমাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা বলছে অসুরদের মতো আমাসেরও পূরেহিত দরকার। আমাদের এখানে অসুরদের মতো পুরোহিত, ব্যবসায়ী, কৃষক ও শিল্পীদের মধ্যে কোনো প্ৰভেদ নেই, সবাই সব কাজ খুশীমতো করতে পারে। কিন্তু অসুররা আলাদা আলাদা শ্রেণীবিভাগ করেছে। এখন একবার যদি আমাদের মধ্যে পুরোহিত সৃষ্টি করতে দাও তো দেখবে কিছুদিনের মধ্যেই লিঙ্গপূজাও শুরু হয়ে যাবে। লাভ ও লোভের জন্যে আর্যভাষী পুরোহিতদেরও ওই কাজই শুরু করতে হবে।”
“এ তো অত্যন্ত খারাপ হবে, তা’হলে বরুণ!”
“গত দু’শো বছর অসুরদের সংস্পর্শে এসে আর্যদের মধ্যে কতই না পাপ প্রবেশ করেছে। আর তাই দেখে বৃদ্ধরা ক্রমেই হতাশ হচ্ছে। আমি অবশ্য নিরাশ হইনি। আমি বিশ্বাস করি, যদি অতীতের মহান দিনগুলির কথা আর্যভাষী জনদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়, যদি তাদের ভালো করে বোঝানো যায় – তবে তারা পথভ্রষ্ট হবে না। শুনেছি তক্ষশিলায় অঙ্গিরা নামে এক ঋষি আর্যভাষীদের প্রাচীন বিদ্যা জানেন। তিনি আর্যমার্গে চলবার শিক্ষা দেন। আমি আর্ভাষীদের বিজয়ের জন্য তরবারি ধরেছি। এখন আর্য রীতি-নীতি রক্ষার জন্যে কিছু শিক্ষার প্রয়োজন।”
“কি আশ্চর্য! আমিও তো চলেছি ঋষি অঙ্গিরার কাছে যুদ্ধবিদ্যা শিখতে।”
“খুব ভালো, কিন্তু তুমি তো পূর্বদিকের আর্যভাষী জনদের কথা কিছুই বলনি।”
“পুবদেশের আর্যভাষী জন দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। গান্ধারের পরের ভূখন্ড আমাদের মাদ্ররা দখল করেছে। তারপরের অঞ্চল দখল করেছে মল্লরা, এবং ক্রমশ কুরু, পঞ্চাল প্রভৃতি জন বড় বড় প্রদেশ আপন করতলগত করেছে।”
“তা’হলে আর্যভাষীরা ওখানে সংখ্যায় অনেক বেশী।” “খুব বেশী নয়। তবে যতই তারা এগিয়ে চলেছে ততই অসুর ও অন্যান্য জাতির সম্মুখীন হচ্ছে।”
“অন্যরা আবার কারা।”
“অসুরদের গায়ের রঙ তামাটে। কিন্তু পূর্বদিকে এক রকম লোক আছে — তাদের কোল বলা হয় – তারা কয়লার মতো কালো। এই কোলেরা গ্রামেও থাকে, জঙ্গলেও আছে। বন্য কোলেরা নানা রকমের পাথরের অস্ত্র তৈরী করে।”
“তা’হলে তো মনে হয় এই অনার্যদের সঙ্গে খুবই লড়াই করতে হচ্ছে।”
“বড় ধরনের সামনা-সামনি যুদ্ধ খুব কম হয়। আর্যভাষীদের ঘোড়া দেখলেই অনার্যরা পালিয়ে যায়। কিন্তু রাতে আমাদের আক্রমণ করে। এর প্রতিশোধ নেবার জন্যে অনেক সময় ক্রুর ব্যবহার করতে হয়। ফলে অসুর এবং কোলদের গ্রাম প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে। এখন তারা ক্ৰমেই পূবদিকে পালিয়ে যাচ্ছে।”