তারা খুব নিষ্ঠুরভাবে অসুর পুরুষদের বধ করল। আর নগরাধিপতিকে নগরের চৌরাস্তায় এনে অসুর প্রজাদের সামনে তার এক-একটি অঙ্গচ্ছেদ করে হত্যা করল। স্ত্রীলোক, শিশু এবং ব্যাপারীদের তারা মারল না।ওই সময়ে অসুরদের যদি দাস ইচ্ছা থাকত তবে এত অধিকসংখ্যক অসুর নিহত হত না। পুষ্কলাবতীর বহুলাংশ তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলল। অসুর দুর্গর এই প্রথম পতন ঘটল। অসুর এবং পীতকেশীদের মহান বিগ্রহের, দেবাসুরের সংগ্রাম – এইভাবেই সূত্রপাত হল।
পুরুধান ফিরে এসে অজাগিরিবর্তে অসুর সৈন্যবাহিনীকে নির্মুল করল। তারপর সমগ্ৰ গীতকেশী সাৰ্থ আপনি আপনি জন্ম-ভূমিতে ফিরে গেল। কয়েক বছরের জন্য পুষ্কলাবতীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। গীতকেশীর অসুর-পণ্য নিতে অস্বীকার করুল, কিন্তু তামা, পিতলকে কতদিন দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে?
০৬. অঙ্গিরা (স্থান: গান্ধার (তক্ষশিলা) ।। কাল ১৮০০ খৃষ্টপূর্ব)
(১)
“এই সুতি কাপড় একেবারেই অকেজো এতে না আটকায় শীত, না রোখে বর্ষা!” নিজের গা থেকে ভিজে কাপড়টি খুলতে খুলতে যুবকটি বালল।
দ্বিতীয় তরুণটি তার আপন পরিধেয় দরজার কপটে মেলে দিতে দিতে বলল, “কিন্তু যাই বল, গ্রীষ্মকালের পক্ষে এগুলো ভালো”- সন্ধ্যা হতে তভনও দেরি কিন্তু ইতিমধ্যেই অগ্নিকুণ্ডের কিনারায় লোক জুটতে শুরু করেছিল। তরুণদ্বয় ধোঁয়া-ভরা অগ্নিকুণ্ডের পাশে না বসে জানালার ধারে গিয়ে বসল, ঠান্ডা হাওয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্যে দুটো কম্বল নিজেদের গায়ে জড়িয়ে নিল।
প্রথম তরুণটি বলল, “আমরা এখনো এক যোজন পথ হাঁটতে পারতাম, তা’হলে কাল ভোরে গান্ধারনগর (তক্ষশিলায়) পৌছতে পারতাম, কিন্তু এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পথ চলা বড় কষ্টকর।”
দ্বিতীয় তরুণ বলল, “শীতের আগমনকালীন ঋতুর এই পরির্বতন খুবই খারাপ লাগে – এখন বর্ষায় চারিদিক ছেয়ে যাবে। অথচ এই বৃষ্টি না হলে কৃষকেরা ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করবে — পশুপালকেরা করবে কান্নাকাটি।”
প্রথম জন উত্তর দিল, “মিত্র, ঠিকই বলেছ। একমাত্র আমাদের মতো পথিকরাই এই বৃষ্টি পছন্দ করে না। আর সকলে তো সর্বদা পথে থাকে না!” এমন সময় তার সঙ্গীটির গলায় ক্ষতচিহের প্রতি নজর পড়ায় সে প্রশ্ন করল, “তোমার নাম কি বন্ধু ?”
“পাল মাদ্র। আর তোমার?”
“বরুণ সৌবীর।”
“তাহলে তুমি পূর্বদিক থেকেই আসছ?”
“হ্যাঁ মাদ্রদেশ থেকে। আর তুমি দক্ষিণ থেকে তো? আচ্ছা বন্ধু বল তো আমরা যে শুনেছি অসুররা না-কি এখনো আর্যভাষীদের সঙ্গে লড়াই করছে?”
“একমাত্র সমুদ্রতটে একটি শহরকে কেন্দ্র করে এই লড়াই চলছে। আমাদের মঘবা ইন্দ্র কিভাবে অসুরদের একশ’ নগর দুর্গ ধ্বংস করেছিল – তার কথা কি জান,বন্ধু?”
“শুনেছি, অসুরদের নগর-দুর্গ তাম্র নির্মিত ছিল।” “অসুরদের এত তামা নেই যে তা দিয়ে তারা দুর্গ বানাবে। এই গুজব ছড়িয়ে পড়ল কি করে তা অবশ্য জানি না। তাদের বাড়ি-ঘর ইট দিয়ে বানানো শহরের চারপাশেৱ মোটা দেওয়ালও ইঁটের। মাটি আগুনে পুড়িয়ে লালচে রঙ-এর ইট হয়। কিন্তু তা মাটির চেয়ে চারগুণ শক্ত – তামার মাতো মজবুদ। তবু ইট আর তামার তফাৎ অনেক। অনেকে ভুল করে ইটকে হয়ত তামা মনে করে।”
“তুমি যাই বল বরুণ, আমরা কিন্তু তাম্রদুর্গের কথাই শুনেছি।”
“আমাদের ইন্দ্রকে দুর্গ ধ্বংস করতে অনেক কষ্ট ও শক্তিক্ষয় করতে হয়েছে—তাই বোধহয় এ দুর্গ তাম্রনির্মিত বলে কথিত হয়েছে।”
“তা ছাড়া সম্বরের শৌর্যবীর্যের কত না কাহিনী আমাদের কানে এসেছে। সমূদ্রের মধ্যে তার নাকি ঘর, আকাশ পথে তার রথ উড়ে চলত।”
“রথের কথা ডাহা মিথ্যা, একেবারেই আজগুবি। তা’ছাড়া অশ্বারোহী যোদ্ধা হিসাবে অসুরেরা দুর্বল। এখনও, তাদের উৎসবের সময় অশ্বরথের জায়গায় বৃষরথ নিয়ে আসে। আমরা যুদ্ধে জিতেছি। ঘোড়ার জোরে – ভালো ঘোড়সওয়ার হতে না পারলে যুদ্ধে আমরা অসুরদের হারাতে পারতাম না। সম্বর প্রায় দুশো বছর হল মারা গেছে। আকাশপথে উড়ে যাওয়া দূরের কথা, তার কাছে অশ্বরখ পর্যন্ত ছিল না।”
“সম্বর যদি এতই সাধারণ মানুষ ছিল, তবে ওই অসুর শক্ৰকে পরাজিত করায় আমাদের ইন্দ্রের এত নামডাক কেন?”
“কারণ, সম্বর ছিল খুব বড় বীর। সৌবীর নগরে আমি তার স্বর্ণখচিত তাম্রকবচ, (বর্ম) দেখেছি – সেটা যেমন দৃঢ়, তেমনিই বিশাল। অসুররা সাধারণভাবে বেঁটে গড়নের কিন্তু সম্বর ছিল বিরাটাকায়, খুবই বলিষ্ঠ। আর আমাদের মঘবা ইন্দ্র ছিল পাতলা ছিপছিয়ে জোয়ান মানুষ। সিন্ধু নদের তীরে এখনো দেখতে পাবে পুরনো দিনের অসুর নগরীর অবশেষ। মনে কর সেইসব দিনের কথা, দুর্গের মধ্যে থেকে কিছু তীরন্দাজ হাজার হাজার আক্রমণকারীকে হটিয়ে দিত। ওই দুর্গগুলো ছিল দুর্ভেদ্য – আর এই অপরাজেয় পুরীকে ধ্বংস করেছিল আমাদের মঘবা ইন্দ্ৰ।”
“আচ্ছা বরুণ, দক্ষিণে কি অসুরদের শক্তি অটুট আছে?”
“তোমাকে কি বলিনি, সমুদ্রতটর শেষ দুর্গাও অসুরেরা হারিয়েছে। আমরা তা ধ্বংস করেছি। ওই যুদ্ধে আমিও যোগ দিয়েছিলাম।” কথা বলতে বলতে বরণের মুখমণ্ডলে রক্তিমাভা ফুটে উঠল। সে তার দীর্ঘ সোনালী চুলের গোছা হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, “অসুরদের সর্বশেষ দুর্গের পতন ঘটে গেছে।”
“এই যুদ্ধে আমাদের ইন্দ্র কে ছিল?”
“ইঞ্জের পদ আমরা বিলোপ করেছি।”
“বিলোপ করেছ?”
“হা, আমরা দক্ষিণের আর্যভাষীরা ক্ৰমেই শঙ্কিত হচ্ছিলাম।” “শঙ্কিত হচ্ছিল! কেন ?”
“আর্যভাষীরা সেনানায়ককে সর্বেসর্বা বলে মেনে চলতে রাজী নয়। যুদ্ধের সময় সেনানায়কের আদেশ যতই শিরোধার্য হোক না কেন, আর্যভাষীরা সব সময় তাদের জন-পরিষদকে সর্বোচ্চ স্থান দেয় যেখানে স্বাধীনভাবে প্রত্যেকে নিজের চিন্তাধারা উত্থাপন করবার অধিকারী।”
“হ্যাঁ, ঠিকই তো, এ অধিকার আছে।”
“কিন্তু অসুরদের প্রথা অন্য রকম। তার ইন্দ্রকে রাজা বলে মনে করে। আর এই রাজা নিজেকেই সব কিছু মনে করে – নিজের ওপরে জন-পরিষদকে স্থান দেয় না।অসুররাজের মুখ দিয়ে একবার যা বেরিয়ে গেল তা সমস্ত অসুরের অবশ্য পালনীয়, আর সেটা পালন না করলে মৃত্যুবরণ করতে হবে।”
“না, এ ধরনের ইন্দ্ৰকে আমরা কখনও স্বীকার করতে পারি না।”
“কিন্তু অসুরেরা এই ধরনের ইন্দ্রকেই বারবার মেনে এসেছে। তারা তাদের রাজাকে মানুষের ঊর্ধ্বে দেবতার আসনে বসিয়েছিল। জীবিত মানুষ রাজাকে পূজো পর্যন্ত করত। আর এই পূজার অনুষ্ঠানের কথা বললে তুমি তা বিশ্বাসই করবে না।”