কয়েক বছরের সাময়িক সংস্পর্শ হেতু অসুররাজের ভিতরকার বহু দুর্বলতা পুরুত্থানের চোখে ধরা পড়ে। উচ্চশ্রেণীর অসুররা আপন অধীনস্থ ভট্ট এবং দাসদের শক্তির জোরে শত্রুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চায়। দুর্বল শক্রকে জয় করতে এরা ভালোভাবেই সফল হয়, কিন্তু বলবান শক্রুর সামনে লড়তেই পারে না। অসুরদের শাসক, রাজা, সামন্ত ভোগ বিলাসকেই জীবনের একমাত্ৰ উদ্দেশ্য বলে মনে করত। প্রত্যেক সামন্তরেই শত শত স্ত্রী এবং দাসী থাকত। স্ত্রীদের তারা দাসীর মতো করেই রাখত। হালে কিছু পাহাড়ী স্ত্রীকেও বলপূর্বক অসুররাজা আপন অন্তপূরে এনে রেখেছিল। এর ফলে আর্যভাষী জনের ভিতরে প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু অসুবিধা এই ছিল যে, অসুররাজের রাজধানী সীমান্ত থেকে বহুদূরে, আর্যভাষী-জনের পক্ষে সেখানে উপস্থিত হওয়া মুখের কথা নয়। তাই আর্যভাষী রমণীদের অসুরদের নিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে আর্যভাষী জনেরা কিংবদন্তী বলেই মনে করত।পুষ্কলাবতীর রাজার কাছ থেকে নানাপ্রকার অলঙ্কার, কার্পাস-বস্ত্র, অস্ত্র-শস্ত্র এবং অপরাপর দ্রব্যসম্ভার, সুব্যস্ত কুনারের উপরিভাগে কাঠার ছাউনিতে পৌছাতে আরম্ভ করেছিল। সুবাস্তুর স্বর্ণকেশী আর্যভাষী রমণীরা দক্ষ অসুর শিল্পীদের হাতে গড়া অলঙ্কারে মুগ্ধ হয়ে প্রতি বছর অধিকতর সংখ্যায় পুষ্কলাবতী আসতে আরম্ভ করল।
সুমেধ বেচারা সত্যি সত্যি উষাকে বিধবা বানিয়ে চলে গিয়েছিল, ঊষা এখন তার খুড়তুতো দেবীর পুরুত্থানের পত্নী। এ বছর সেও পুষ্কলাবতীতে এসেছিল। পুষ্কলাবতীর নগরাধিপতির লোকজনেরা আর্যভাষীদেরে তাঁবুর ভিতর বহু সুন্দরী সেই খবর আপন প্রভুর কাছে পৌঁছে দিল। তারা ঠিক করুল, সার্থ যখন ফিরে যেতে থাকবে তখন পাহাড়ে ঢুকতেই হামলা করে তাদের লুট নিয়ে যাবে। যদিও এই কাজ বুদ্ধিহীনতার লক্ষণ, কারণ পীতকেশীরা অত্যন্ত যুদ্ধকুশল – এ খবর তাদেরও জানা ছিল। কিন্তু নগরাধিপতির মগজে বুদ্ধির লেশমাত্র ছিল না। নগরের বড় বড় শেঠ সাহুকারেরা তাকে ঘৃণা করত। যে ব্যাপারীর সঙ্গে পুরুধানের মিত্ৰতা ছিল, তার সুন্দরী কন্যাকে হালে নগরাধিপতি জবরদস্তি করে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছিল, এ জন্য সে তার সারা জীবনের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঊষাও এই অসুর সওদাগরের বাড়ি কয়েকবার গিয়েছে। যদিও ওই সওদাগর পত্নীর একটি কথাও সে বুঝতে পারত না, তবুও পুরুধানের দোভাষীর কাজে এবং শেঠগিন্নীর ব্যবহারে দুই নারীর ভিতর সখিত্ব সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিল। বিদায় নেবার দিন দুই আগে সওদাগর তার বড় গ্রাহক পুরুধানকে নিমন্ত্রণে আপ্যায়িত করল। সেই সময় সে পুরুধানের কানে নগরাধিপতির ঘূণ্য মতলবের কথা জানিয়ে দিল।
সমস্ত আর্যভাষী সাৰ্থ নায়ককে ডেকে সারারাত পরামর্শ করল পুরুধান। যাসের হাতে অস্ত্র কম ছিল, তারা নতুন অস্ত্র কিনল। বিক্রি করবার জন্যে আনীত ঘোড়া এবং অন্যান্য ভারী মোট তারা বেচে দিল। শুধু নিজেদের চড়বার ঘোড়া এবং অন্যান্য কেনা জিনিসপত্র, যেমন অলঙ্কার এবং অন্যান্য ধাতব দ্রব্য রেখে কিছুটা হালকা হল। আর্যভাষী রমনীদের মধ্যে অলঙ্কার-প্রতি অত্যন্ত প্রবল ছিল, কিন্তু এই সময় পর্যন্ত তাদের শিক্ষায় নৃত্যগীতের সঙ্গে শস্ত্ৰ-শিক্ষাও চলে আসছিল, এ জন্য সঙ্কটের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাও আপন-আপন খড়গ এবং চামড়ার ঢাল তুলে নিল ।
পুরুধানের এ খবর জানা ছিল যে, অসুর সৈন্য সীমান্তের গিরিবর্তে আগে থেকে রাস্তা আটকে আক্রমণ করবে এবং সেই সময় তাদের এক অংশ পিছন থেকেও ঘিরে ফেলতে চাইবে। এ জন্য পুরুধান পুরোদস্তুর তৈরী হয়ে গেল, আর প্রথমেই খবর পাওয়া গেল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। যদিও শক্রকে জানতে না দেবার জন্য তারা পুঙ্খলাবতী থেকে দু-একদিন আগে পিছে রওনা দিল, কিন্তু ঠিক হল যে অজার (অবাজই) দ্বারে সকলেই এক সঙ্গে পৌঁছাবে। দ্বার যখন ক্রোশ দুই বাকি পুরুধান তখন পাঁচশ জন সওয়ারীকে আগে পাঠাল। যে সময় সওয়ারীরা দ্বারের ভিতরে এগুতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে অসুর সৈন্যরা তাদের ওপর বাণ খুঁড়তে আরম্ভ করল। আক্রমণের সংবাদ সত্যে পরিণত হল, সওয়ারীরা পিছু হট আপন সার্থ-নায়কদের সংবাদ দিল। পুরুধান প্রথমে পিছন থেকে এগিয়ে আসা শক্রর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চাইল। এতে সুবিধাও ছিল, কারণ যদিও অসুরেরা প্রতি বছর আর্যভাষীদের কাছ থেকে হাজার হাজার ঘোড়া কিনেছিল বটে কিন্তু তখনো পর্যন্ত সুদক্ষ অশ্বারোহী সৈনিক হয়ে উঠতে পারেনি।
সাৰ্থ রক্ষার জন্য বহুসংখ্যক উটকে সেখানে ছেড়ে বাকি সওয়ারীদের সঙ্গে পেছনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। অসুর-সেনা প্রত্যাশা করেনি যে, পীতকেশীরা এভাবে পাল্টা মার দেবে। গীতকেশীদের দীর্ঘ বল্লম এবং খড়গের সামনে তারা বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারল না, কিন্তু আর্যরা এদের শুধু পরাজিত করেই ছাড়তে চাইল না। তারা এইসব বোঁচা নাক, কালো অসুরদের বুঝিয়ে দিতে চাইল যে, পীতকেশীদের ওপর নজর দেওয়া কি ভয়ঙ্কর বিপদের কাজ। অসুর-সেনাদের পলায়ন করতে দেখে পুরুধান সার্থকে খবর পাঠাল এবং নিজে ঘোড়সওয়ার নিয়ে পুষ্কলাবতীতে এসে পড়ল। অসুর সেনানীদের মতো তাদের নগরাধিপতিও এমনটি আশা করেনি। অসুরেরা তাদের পূর্ণ শক্তিকে সংগঠিত করবার সুযোগ পেল না এবং সহজেই অসুর-দুর্ এবং নগরাধিপতি, পীতকেশীদের অধিকারে চলে এল।