বছরে একটা বিশেষ দিন বলে এই দিনটা গণ্য হত। বক্ষু তটে (অক্সাসের তীরে) স্বাত উপত্যকায় অতীতের পুরু-জনের প্রথা অনুসারে পশুপালের সেরা ঘোড়াটি বলি দেওয়া হত। সারা স্বাত উপত্যকায় এই সময় ঘোড়া খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না—তবু ইন্দ্রপূজার বলি হিসাবে সকলেই ভক্তিভরে প্রসাদ নিত। জনের মহাপিতর—যাকে এখানে জনপতি বলা হয়—আজ আপন জনপরিষদের সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রপূজার প্রিয় অশ্বমেধ যজ্ঞে যোগ দিত। এই বলিদানের সব বিধি-বিধান প্রত্যেকেরই জানা। বক্ষু উপত্যকায় অধিবাসীরা যে মন্ত্র পড়ে ঘোড়া ইন্দ্রের নামে উৎসর্গ করত— তা তাদের সবটাই মুখস্থ ছিল। বাদ্য ও মন্ত্রস্তুতির সঙ্গে অশ্বকে স্পর্শ করে এবং প্রক্ষালন থেকে বলি পর্যন্ত সমস্ত ক্রিয়া সম্পন্ন হল। তারপরে ঘোড়াটির চামড়া ছাড়িয়ে তার দেহ খণ্ড খণ্ড করে কাটা হল— পরে কয়েক খণ্ড মাংসে মশলা মাখিয়ে আহুতি হিসাবে আগুনের মধ্যে দেওয়া হল।
যজ্ঞের বলি, প্রসাদ বিতরণ করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ইতিমধ্যে যজ্ঞভূমি নর-নারীতে ভরে গেছে। এই দিন সকলেই আপন আপন শ্রেষ্ঠ বসন-ভূষণে সজ্জিত হয়ে এসেছে। মেয়েদের দেহে ছিল সূক্ষ্ম রঙিন কম্বল—কোমরের কাছে বাঁধা কারুকার্যখচিত নানা রঙের কোমরবন্ধনী, আর নীচে সুন্দর লোমবস্ত্রের আবরণ। প্রায় প্রত্যেকের কানেই সোনার কুণ্ডল। বসন্ত শেষ হয়ে আসছে—সারা উপত্যকায় ফুল যেন আজকের দিনটিকে লক্ষ্য করে বিকশিত হয়েছে। আজকের রাত নর-নারীর স্বচ্ছন্দ বিহারের রাত—ইচ্ছামতো প্রণয় ও কামনা-ভোগের রাত। রাত্রে যখন উৎসবের সজ্জায় সুসজ্জিতা ঊষা পুরুধানের হাতে হাত মিলিয়ে ঘুরছিল তখন সুমেধের নজরে পড়ল, কিন্তু কি বা করতে পারে সে— হতাশ ভঙ্গীতে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ইন্দ্রের উৎসবের দিনে নর-নারীর যথেচ্ছ মিলনে রাগ করার পর্যন্ত অধিকার কারুর নেই।
রাতে মধু ও ভাঙ-এর নদী বয়ে যাচ্ছিল। সারা গাঁয়ের মানুষ জড়ো করেছে, ভোগ দেওয়ার জন্য সুস্বাদু গোমাংস আর সোমরস। সর্বত্রই অভিনব প্রেমের মাদকতাপূর্ণ জড়ানো কন্ঠের সম্ভাষণ আর যুগ্ম তরুণ-তরুণীর পদচারন নজরে পড়ছে। এক টুকরো মাংস মুখে পুরে এক পেয়ালা সোমরসে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে। বাজনা বেজে উঠছে—আর বাজনার তালে তালে নাচছে তারা। শ্রান্ত হলে বিশ্রামের পর অপর গ্রামের আগন্তুকদের গিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। সারা গোষ্ঠীর লোকদের উদ্যোগে উৎসবের আয়োজনও বিরাট—আর নাচের জন্য আসরও ছিল বিস্তৃত। ইন্দ্র উৎসব ছিল যুবজনের মহোৎসব। এদিন তাদের কোনো কিছু করতেই বাধা-নিষেধ ছিল না।
২.
উপরি-স্বাতের এই অংশ পশু এবং শস্যসম্ভারে পরিপূৰ্ণ – এখানকার লোকেরা সুখী এবং সমৃদ্ধ । এদের যে সব জিনিসের অভাব সোনা-রূপা ও কয়েকটি রত্ন যার অভাব দিন-দিনই বেড়ে চলেছে। এইসব জিনিসের জন্য স্বাত এবং কুভা (কাবুল) নদীর সঙ্গমস্থলে অসুর-নগর রয়েছে। মনে হয়, এই আর্যভাষীরা অসুর-নগরকে পুষ্কলাবতী (=চরসদদা) নামে ডাকে আর আমরাও এখানে এই নামকে স্বীকার করে নিচ্ছি। শীতের মাঝামাঝি —স্বাত, পঞ্জকোরা, এবং অন্যান্য উপত্যকাবাসী পাহাড়ী গোষ্ঠীসমূহ, যথা পুরু, কুরু, গান্ধার, মাদ্র, মল্ল, শিবি, উশীনার ইত্যাদি – নিজ নিজ ঘোড়া, কম্বল এবং অপরাপর বস্তু নিয়ে পুষ্কলবতীর বহির্ভাগে অবস্থিত ময়দানে ডেরা (তাঁবু) বেঁধে বসত। বহু শতা্ব্দী ধরে এই নিয়ম ভালোভাবেই চলে আসছিল, এ বছর পুরুদের যে সার্থ (ক্যারাভান) বা বণিকদল পুষ্কলাবতী গেল তাদের নেতা ছিল পুরুধান। এদিকে কয়েক বছর থেকে পাহাড়ীদের ধারণা হচ্ছিল যে, অসুররা ভয়ানক ঠকাচ্ছে। অসুর নাগরিকেরা এই পাহাড়িদের চেয়ে বেশি চতুর, এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। তবে নীল চোখ বিশিষ্ট আর্যভাষী ঘোড়সওয়ার কখনই নিজেকে অসুর নাগরিকদের চেয়ে হীন বলে মানতে রাজী ছিল না। ধীরে ধীরে যখন আর্যভাষীদের মধ্যে থেকে পুরুত্থানের মতো বহু লোক অসুরদের ভাষা বুঝতে শিখল এবং তাদের সমাজে চলাফেরা করবার সুযোগ পেল। তখন জানল, অসুররা আর্যভাষীদের পশু-মানব বলে মনে করে।
অসুরদের নগরগুলি সুন্দর, সেখানে পাঁকা ইটের বাড়ি, স্নানাগান, সড়ক ইত্যাদি তৈরী হত। আর্যভাষীরাও পুষ্কলাবতীর সৌন্দর্যকে অস্বীকার করত না। অসুর তরুণীর নাক, কেশ ও উচ্চতা পছন্দ মতো না হলেও তাদের সৌন্দর্যকে তারা মানতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এ কথা তারা কখনোই স্বীকার করত না যে, দেবদারু-সমাচ্ছাদিত পর্ত-মেখলার মাঝে অবস্থিত চিত্র-বিচিত্র কাঠের অট্টালিকা যুক্ত মঙ্গলপুরের সুসজ্জিত স্বচ্ছগৃহপংক্তি থেকে কোনো অংশে হীন। পুষ্কলাবতীতে এক মাস কাটানোও তাদের পক্ষে মুশকিল হত, এবং বারবার আপনি জন্মভূমির কথা স্মরণে আসত। যদিও ওই স্বাত নদী পুষ্কলাবতীর ধারা দিয়েও বয়ে চলেছে, কিন্তু তারা দেখত নদীর জলে সেই স্বাদ নেই। তাদের বক্তব্য ছিল, অসুরদের স্পর্শে এই পবিত্ৰ জল কলুষিত হয়ে গেছে। সে যাই হোক না কেন, আর্যভাষীরা কোনো রকমেই অসুরদের আপনি সমকক্ষ বলে মানতে রাজী ছিল না। বিশেষ করে যখন তারা হাজার হাজার দাস-দাসী এবং ঘরে বসে আপন দেহ বিক্রয়কারিণী বেশ্যাদের দেখত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আর্ভাষীদের অসুরদের মধ্যে অসুরদের আর্যভাষীদের মধ্যে বহু মিত্র ছিল। অসুরগণের রাজা পুষ্কলাবতী থেকে কিছু দূরে সিন্ধুতটের পার্শ্ববর্তী কোনো নগরে বাস করত। এ জন্য পুরুধান তাকে কোনোদিন চোখে দেখেনি। হ্যা, রাজার স্থানীয় অমাত্যকে দেখেছিল সে – বেঁটে, মোটা আর অত্যন্ত অলস, সুরার প্রভাবে তার চোখের পাতা সর্বদাই বুজে থাকত। সারা দেহে বহুবিধ সোনা-রূপার অলংকারে সজ্জিত এই রাজকর্মচারীটি পুরুধানের চোখে কুরূপতা এবং বুদ্ধিহীনতার প্রতীক বলে মনে হত। যে রাজ্যের এমন প্রতিনিধি তার প্রতি পুরুধানের মতো লোকের উঁচু ধারণা থাকতে পারে না। পুরুধান শুনেছিল যে, সে অসুররাজের শালা এবং এই একটি মাত্র গুণের জোরে সে এই পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে।