২.
গুহার মধ্যে এদের নিভৃত গল্প-গুঞ্জনে ব্যস্ত রেখে আমরা বাইরে এসে দেখছি বরফের ওপর চামড়ার আবরনে আচ্ছাদিত অনেকগুলি পায়ের চিহ্ন। আসুন, আমরা ওদের এই পদচিহ্ন দ্রুত অনুসরণ করি। পায়ের সারি গিয়ে মিশেছে পাহাড়ের ওপাশের জঙ্গলে। আমরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু চলমান পায়ের রেখা বহ্ন করে নিয়ে চলেছে টাট্কা পায়ের ছাপ। আর আমরা চলেছি শুভ্র তুষারক্ষেত্র অতিক্রম করে, আবার কখনও বা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। পাহাড়ের ওপর দিয়ে এসে পড়েছি অন্য কোনো হিমক্ষেত্রে- সর্বশেষে আমাদের নজরে পড়ল একটি বৃক্ষলতাহীন পাহাড়ের ওপরে। এখানে নীচে থেকে ওঠা শুভ্র হিমরাশি গিয়ে মিশেছে নীল নভোমণ্ডলে–আর নীলাকাশের পটভূমিতে মানবমূর্তি দেখা যাচ্ছে, এই মানুষের সারি গিয়ে অন্তর্হিত হচ্ছে পাহাড়ের প্রান্তে। মূর্তিগুলির পেছনে যদি নীলাকাশ না থাকত তা’হলে আমরা কিছুতেই মানুষগুলিকে দেখতে পেতাম না। ওদের শরীর ঢাকা আছে বরফের মতই সাদা বৃষচর্মে, তাদের হাতের অস্ত্রগুলিও যেন ধবধবে সাদা। এই পরিব্যাপ্ত শ্বেত তুষারের ক্ষেত্রে আন্দোলিত মূর্তিগুলিকে কি করে চিনে ওঠা যায়!
আরো কাছে গিয়ে দেখা যাক। সবার আগে রয়েছে একজন স্ত্রীলোক, বলিষ্ট তার দেহ– বয়স চল্লিশ-পঞ্চাশের মধ্যে। তার নগ্ন দক্ষিণ বাহুর দিকে তাকালেই বোঝা যায় সে খুব বলবতী। মাথার চুল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি সামাদের গুহায় দেখা পূর্বোক্ত তরুনীদ্বয়ের মতোই- তবে আকারে বোড়। বাঁ হাতে একটি ছুঁচলো তিন হাত লম্বা ভূর্জ গাছের মোটা কাঠ। ডান হাতে কাঠের হাতলে দড়ি দিয়ে বাঁধা পাথরের কুঠার, শিকারের জন্য ঘষে ঘষে শান দেওয়া হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে চারজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রীলোক। একজন পুরুষের বয়স মেয়েটির চেয়ে কিছু বেশি, আর বাকী সকলেই চৌদ্দ থেকে ছাব্বিশের মধ্যে। বয়স্ক পুরুষটির মাথার চুল লম্বা এবং রঙ আর সকলের মতো স্বর্ণাভ-শুভ্র, সারা মুখ দাড়ি গোঁফে ঢাকা। পূর্বোক্ত স্ত্রীলোকটির মতো শরীরের গঠন বলিষ্ঠ এবং তারও কাছে স্ত্রীলোকটির মতোই দুটি অস্ত্র আছে। বাকি তিনজন পুরুষের মধ্যে দু’জনের মুখ দাড়ি-গোঁফে ঢাকা, কিন্তু বয়স কম। স্ত্রীলোক দুটির মধ্যে একজনের বয়স বাইশ, অপর জন ষোড়শী–হয়ত বা আরো কম। আমরা আগের গুহায় মাতামহীকে দেখেছি। এদের সকলকে মিলিয়ে দেখলে মনে হয়ে যেন এরা সকলেই একই ছাঁচে গড়া। হাতে কাঠ, হাড় ও পাথরের অস্ত্রাদি এবং তাদের অভিযান দেখে মনে হয়, তারা যেন যুদ্ধে যাচ্ছে।
পাহাড় থেকে নামার পথে প্রথম স্ত্রীলোকটি হচ্ছে মা। সে বাঁ দিকে ঘুরল, আর সকলে তাকে নীরবে অনুসরণ করল। বরফের ওপর দিয়ে চলার সময় তাদের চামড়ায় ঢাকা পায়ের কোনো শব্দ হচ্ছিল না। সামনে দিকে ঝুঁকে-পড়া একটি পাহাড়–তার চারপাশে কতকগুলি ঢিলা। শিকারীরা এবার তাদের গতি একেবারে কমিয়ে দিল। তারা সতর্কতার সঙ্গে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো, তারপর অতি ধীরে সন্তর্পণে দূরে দূরে পায়ের পাত ফেলা ঢিলার দিকে এগোতে লাগল। মা সকলেও আগে গুহামুখে গিয়া পৌঁছাল। গুহার বাইরের সাদা বরফের দিকে ভালো করে তাকাল–সেখানে কোন কিছুর পায়ের চিহ্ন পড়েছে কি-না? দেখল কোনো চিহ্ন নেই। সে একলাই গুহামধ্যে প্রবেশ করল; কয়েক পা এগিয়ে গুহার একটি বাঁক দেখা গেল, আরল খুবই কম। কিছুক্ষণ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকারকে চোখ-সওয়া করে নিল, তারপর এগুলো। সেখানে দেখতে পেল, তিনটি ধূসর রঙ-এর ভাল্লুক–বাবা, মা ও তাদের বাচ্চা নীচের দিকে মুখ করে নিশ্চলভাবে পড়ে আছে–মরে গিয়াছে কি-না অনুমান করা যায় না। জীবনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
মা পা টিপে টিপে ফিরে এল। মায়ের উৎফুল্ল মুখ দেখে পরিবারের আর সকলেই ব্যাপারটা আন্দাজে বুঝে নিল। বুড়ো ও কড়ে আঙুল চেপে মা তিনটি আঙ্গুল তুলে দেখাল। তারপর মা আবার গুহার মধ্যে প্রবেশ করল। অস্ত্রাদি বাগিয়ে তার পিছনে চলল দু’জন পুরুষ। বাকি সবাই দমবন্ধ করে সেইখানেই অপেক্ষা করতে লাগল। গুহার মধ্যে গিয়ে মা দাঁড়াল মরদ ভাল্লুকটির কাছে, আর দু’জন পুরুষের মধ্যে একজন মাদী ভাল্লুকটির কাছে, অপরজন বাচ্চাটির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তিনজনে একই সঙ্গে ভাল্লুকের উদরে সুতীক্ষ্ণ কাঠের বর্শা দিয়ে বিদ্ধকরে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত যখন করল। জন্তুগুলো আর নড়াচড়া করাবার অবসর পেল না। তাদের শীতকালের ছ’মাস নিদ্রাভঙ্গের তখনও একমাস বাকি। কিন্তু শিকারীদের পক্ষে তখন তা জানার উপায় ছিল না। তাদের তাই সতর্ক হয়েই কাজ করতে হয়। ডান্ডার তীক্ষ্ণ ফলাটি আরো তিন চার বার সজোরে আঘাত করে ভাল্লুকগুলিকে উল্টে দিল। তারপর নির্ভয়ে ভাল্লুক তিনটির পা ও মুখ ধরে বাইরে টেনে আনল। সকলেই খুশী হয়েছে, এতক্ষণে তাদের প্রাণ-খোলা হাসি ও গলা-ছেড়ে চীৎকার শোনা গেল।
বড় ভাল্লুকটিকে চিৎ করে ফেলে মা চমকির পাথরের ছুরিটা চামড়ার পোষাক থেকে বার করে পুনরায় ভাল্লুকটির প্রথম আঘাত স্থানের ক্ষত থেকে সরু করে পেটের চামড়াটা চিরে ফেলল। পাথরের ছুরি দিয়ে এত পরিষ্কারভাবে চামড়া চেরা খুবই অভ্যস্ত ও মজবুত হাতের কাজ। তারপর মা নরম হৃৎপিণ্ড থেকে একখণ্ড মেটে কেটে নিজের মুখে পুরল এবং আর একখণ্ড সর্বকনিষ্ঠ ছেলেটির মুখে দিল। সবাই ভাল্লুকটির চারদিকে ঘুরে বসল আর মা তাদের সবাইকেই কলিজার মাংস খণ্ড খণ্ড করে কেটে ভাগ করে দিতে লাগল। একটি ভাল্লুকের মেটের খাওয়া শেষ করে অন্যটির কলিজা কাটবার যখন উদ্যোগ করহচিল তখন দলের ষোল বছরের মেয়েটি বাইরে এসে একখণ্ড বরফ তুলে মুখে পুরে দিল; এই সময় দলের প্রবীণ পুরুষটিও বেরিয়ে এসে বরফের টুকরো তুলে মুখে দিল এবং ষোড়শী মেয়েটির হাত চেপে ধরল। মেয়েটি প্রথমটা একটু ইতস্তত করে শান্ত হল। পুরুষটি তাকে বাহুবেষ্টিত করে এক পাশে চলে গেল। এরা দু’জনে যখন হাত-ভর্তি বরফকণা নিয়ে কাটা ভাল্লুকের কাছে ফিরে এল তখন তাদের চোখ মুখের রঙ উজ্জ্বল, গাল রক্তিমাভ।
পুরুষটি বলল, “এবার দাও আমি কাটি, তুমি শ্রান্ত হয়ে পড়েছ।”
মা তার হাতে ছুরিটি তুলে দিল। তারপর একটু নত হয়ে পাশে উপবিষ্ট চব্বিশ বছরের যুবকটির মুখে চুমু খেয়ে তার হাত ধরে বেরিয়ে গেল।
এরা সকলে মিলে তিনটি ভাল্লুকের মেটে খেয়ে ফেলল। চার মাসের অনাহারী নিদ্রিত ভাল্লুকগুলোর চর্বি বিশেষ কিছুই ছিল না। তবে বাচ্চা ভাল্লুকটির মাংসই শেষ পর্যন্ত দেখা গেল নরম ও উপাদেয়। তাই তার অনেকখানি মাংস এরা খেয়ে ফেলল। তারপর সবাই পাশাপাশি শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিল।
এবার তাদের ঘরে ফেরার পালা; মদ্দা ও মাদী ভাল্লুক দুটির চার পা চামড়ার দড়িতে বেঁধে লাঠিতে ঝুলিয়ে দু’জন করে কাঁধে নিল, বাচ্চাদিকে কাঁধে নিল ষোড়শী তরুণী, পাথরের কুড়াল হাতে নিয়ে মা আগে আগে চলল।
এইসব বন্য মানুষগুলির সময়ের হিসাব ছিল না, ঘড়ির কাঁটার কোন জ্ঞান না থাকলেও এ ধারণা তাদের ছিল যে আজকের রাত চাঁদনী রাত হবে। তারা কিছুদূর যাবার পরে সূর্য দিগন্তে অস্তমিত হল বলে মনে হলেও আসলে কিন্তু তখনো সূর্যাস্ত হয় নি–আরো কয়েক ঘণ্টা গোধূলির আলো রইল। সূর্যকিরণের শেষ গোধূলির আলো মিলিয়ে যেতে না যেতে বিশ্বচরাচর শুভ্র জ্যোৎস্নালোকে ভরে গেল।
তাদের গুহাশ্রয় তখনো অনেক দূরে। পথে চলতে চলতে মা হঠাৎ প্রান্তরের মধ্যে থমকে দাঁড়াল, কান পেতে কিছু শুনতে লাগল। ষোল বছরের মেয়েটি ছাব্বিশ বছরের ছেলেটির কাছে গিয়ে বলল। “গুর্র, গুর্র, বৃক্, বৃক্” অর্থাৎ নেকড়ে বাঘ।
মা মেয়েটির কথায় মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, ‘বহু বৃক্, বহু বৃক্” অনেক নেকড়ে। তারপর উত্তেজিত কণ্ঠে রুদ্ধশ্বাসে মা আবার বলল, “প্রস্তুত হও।”
শিকার মাটিতে রেখে সকলে নিজ নিজ হাতিয়ার শক্ত করে ধরল এবং প্রতি দু’জনে পিঠে পিঠ দিয়ে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিবন্ধ করে দাঁড়াল; নিমিষের মধ্যে সাত আটটি নেকড়ে বাঘের একটি দল লক্লকে জিভ বার করে তাদের দিকে এগিয়ে এল, তারা কাছে এসে গজরাতে গজরাতে চারিদিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল। মানুষের হাতে কাঠের বর্শা ও পাথরের কুঠার দেখে নেকড়েগুলো তাদের আক্রমণ করতে অতস্তত করতে লাগল। ইতিমধ্যে চক্রের মাঝখানের সর্বকনিষ্ঠ ছেলেটি তার লাঠির সাথে বাঁধা কাঠের ফলক খুলে নিজের কোমরে বাঁধা শক্ত চামড়ার দড়ি কাঠে বেঁধে ধনুক তৈরি করে ফেলল। কে জানে কোথায় নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছিল ছুঁচলো পাষাণ ফলকের তীর। সে চব্বিশ বছরের যুবকটির হাতে তীর ধনুক দিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল চক্রের মধ্যস্থলে নিজের জায়গায়, আর নিজে গিয়ে তার জায়গায় দাঁড়াল। চব্বিশ বছরের যুবকটি তখন ধনুকের গুণকে আরো শক্ত করে বেঁধে নিল, তারপর তীর ছুঁড়ে একটি নেকড়ের পেটে বিদ্ধ করল। নেকড়েটি গড়িয়ে পড়ে গেল, কিন্তু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার যখন মরিয়া হয়ে আক্রমণের উদ্যোগ করছিল, যুবকটির দ্বিতীয় তীর গিয়ে লাগল–আঘাতটা হল মারাত্মক। নেকড়েটাকে নিশ্চল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে অন্যগুলি তার কাছে এগিয়ে এলো, তার দেহ থেকে ঝরে-পড়া গরম তাজা রক্ত পান করতে লাগল; আর পরক্ষণেই মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করে তার মাংস খেতে শুরু করল।
জানোয়ারগুলিকে ভোজন উৎসবে ব্যস্ত রেখে দলটি নিজেদের শিকার তুলে নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে দ্রুত পায়ে এগুতে লাগল। এবার মা চলছে সবার পিছনে, আর বার বার পিছনে ফিরে চারিদিকে নজর রাখছিল। আজ তুষারপাত হয়নি, তাই চাঁদনী রাতের আলোতে নিজেদের পদচিহ্ন অনুসরণের কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। তাদের গিরিগুহা থেকে যখন তারা আধ মাইল পথ দূরে, তখন নেকড়ের পাল আবার তাদের ঘিরে ধরল। আরা শিকারগুলো মাটিতে রেখে হাতিয়ার বাগিয়ে দাঁড়াল। ধনুকধারী কয়েকটি তীর ছুঁড়ল, এবার কিন্তু একটাকেও বিদ্ধ করা সম্ভব হল না। কারণ, নেকড়েগুলি এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় প্রতি মুহূর্তে স্থানবদল করে বেড়াচ্ছিল। কিছুক্ষণ পাঁয়তারা করবার পরে চারটে নেকড়ে একসঙ্গে ষোড়শীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মা তার পাশেই ছিল। সে একটি নেকড়ে পেটে তার বর্শা ঢুকিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। কিন্তু অন্য তিনটে নেকড়ে মেয়েটির উরুতে নখ দিয়ে মাটিতে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি বার করে ফেলল। সকলের নজর যখন এই ষোল বছরের মেয়েটিকে বাঁচাবার দিকে–সেই সময়েই অন্য তিনটে নেকড়ে চব্বিশ বছরের যুবকটির অরক্ষিত পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর আত্মরক্ষার সামান্য সুযোগটুকুও না দিয়ে তার পেট চিরে ফেলল। যখন অন্য সকলে আবার যুবকটিকে বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত, সেই অবসরে নেকড়েগুলো ষোড়শীর ক্ষত-বিক্ষত দেহ প্রায় হাত পঁচিশেক দূরে টেনে নিয়ে গেল। মা চেয়ে দেখল মৃতপ্রায় নেকড়ে বাঘটির পাশে চব্বিশ বছরের যুবকটিও শেষ নিশ্বাস ফেলছে। মুমূর্ষূ নেকড়েটির মুখে ডাণ্ডা ঢুকিয়ে দিয়ে, একজন সামনের পা চেপে ধরছে আর সকলে তার ক্ষতস্থানে মুখ লাগিয়ে লবণাক্ত রক্ত পান করছে। নেকড়ের কণ্ঠনালি কেটে দিয়ে মা তাদের কাজ আরো সহজ করে দিল। ব্যাপারগুলি ঘটে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। তারা জানত যে মেয়েটিকে খাওয়া শেষ করে নেকড়েগুলি আবার তাদের ওপর আক্রমণ করবে। তাই তারা মৃতপ্রায় যুবকটিকে সেখানে ফেলে রেখে তাদের তিনটি ভাল্লুক ও মৃত নেকড়েটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটতে লাগল এবং নিরাপদে নিজেদের গুহায় পৌঁছাল।
গুহার মধ্যে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল, তারই লাল আভায় শুয়ে ঘুমাচ্ছিল শিশুরা আর তরুণীদ্বয়। শিকারীদের ফিরে আসার শব্দ পেয়ে বৃদ্ধা ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল “নিশা-আ-আ এলি?”
“হ্যাঁ” বলে মা প্রথমে এক কোণে তার অস্ত্র-শস্ত্র রেখে চামড়ার পোষাকটি খুলে সম্পূর্ণ দিগম্বরী হল, অন্যেরাও শিকারগুলো মাটিতে রেখে তার মতো চামড়ার পোষাক ছেড়ে নগ্ন দেহের প্রতি রোমে আগুনের আরামদায়ক উত্তাপ উপভোগ করতে লাগল।
এখন গোটা ঘুমন্ত পরিবারটি জেগে উঠল। সামান্য শব্দে জেগে ওঠার অভ্যাস ছেলেবেলা থেকেই এদের মজ্জাগত। খাদ্য রসদ যা পাওয়া যেত তা খুব হিসাবের সঙ্গে খরচ করেই মা তার এই গোষ্ঠীকে এ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে। হরিণ, খরগোস, বনগরু, ভেড়া, ছাগল, ঘোড়া, প্রভৃতি শিকার করার সুযোগ শীত আরম্ভ হওয়ার আগেই পাওয়া যায়, কারণ শীতের দিনে এইসব প্রাণী দক্ষিণের গরম প্রদেশে চলে যায়। মায়ের পরিবারেরও আরো কিছুটা দক্ষিণে যাওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু ঐ সময়টাতেই ষোড়শী তরুণীটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেই যুগের মানব সমাজের নিয়ম অনুসারে পরিবারের মা অর্থাৎ গোষ্ঠীর কর্ত্রী একজনের জন্য পরিবারের সকলের জীবন বিপন্ন করতে পারত না–তা বিধেয় ছিল না। কিন্তু মায়ের আন্তরিক দুর্বলতা প্রকাশ পেল এই মেয়েটির অসুখের সময় এবং তার ফলে আজ তাকে একজনের বদলে পরিবারের দু’জনকে হারাতে হল। শিকারযোগ্য প্রাণীদের এই অঞ্চলে ফিরে আসবার এখনো দু’মাস বাকি। এর মধ্যে না জানি আবার কত জনকে হারাতে হয়। তিনটি ভাল্লুক এবং একটি নেকড়ের মাংস বাকি শীতকালের খোরাকের পক্ষে যথেষ্ট নয়।
ছোট ছেলেমেয়েগুলি খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে–বেচারিরা খালি পেটেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। মা আগে নেকড়ের মেটে কেটে ছোটদের মধ্যে ভাগ করে দিতে লাগল, ছেলেরা গোগ্রাসে চেটেপুটে খাচ্ছিল। এই অবসরে মা খুব সতর্কতার সঙ্গে নেকড়ের চামড়াটে ছাড়িয়ে ফেলল, কারণ লোমশ চামড়া খুবই দরকারী। মাংস কাটার সময় যারা খুব ক্ষুধার্ত তারা খানিকটা কাঁচা খেয়ে নিল। তারপর আগুনে ঝলসে নিয়ে খেতে লাগল। প্রত্যেকেই তাদের মাংস পোড়া থেকে এক কামড় খাবার জন্য মাকে অনুরোধ করতে লাগল।
মা বলল, “ব্যাস, আর তোমরা সকলে পেট ভরে খাও, কাল কিন্তু এতটা পাবে না।” মা উঠে গুহার একটি কোণ থেকে চামড়ার থলি নিয়ে এসে বলল, “এইটুকু মধুএ সুবরা আছে, আজ সুরা পান, নৃত্য ও ফূর্তি কর।”
ছোটদের এক-আধ ঢোক দেওয়া হল, বড়রা পেল বেশি বেশি। ক্রমেই মদোন্মত্ত উল্লাস দেখা দিল, চোখ হল লাল, আর হাসির উঠল ফোয়ারা। এদের মধ্যে কেউ একজন গান ধরল, প্রবীণ লোকটি একটা লাঠির ওপর কাঠি দিয়ে বাজাতে আরম্ভ করল–আর সকলে মিলে নাচ জুড়ে দিল। আজ হল অবারিত আনন্দের রাত। পরিবার ছিল মাতৃশাসনে কিন্তু সে রাজ্যে অন্যায় বা অসাম্য ছিল না। বুড়ি মাতামহী ও প্রবীণ পুরুষটি ছাড়া বাকি সকলেই মায়ের সন্তান-সন্ততি। মা এবং প্রবীণ পুরুষটি আবার বৃদ্ধা মাতামহীর সন্তান, কাজেই এদের মধ্যে ‘এটা আমার’, ‘ওটা তোমার’ এই প্রশ্ন ওঠেনি। বস্তুত সে যুগে তখনো মানুষের মনে সম্পত্তিবোধ সৃষ্টি হয়নি। তবে এ কথা ঠিক যে, মায়ের অধিকার ছিল সমস্ত পুরুষের ওপর আর সে অধিকার সর্বাগ্রহণ্য। চব্বিশ বছরের যে যুবকটি নেকড়ের আক্রমণে মারা গেল সে ছিল মায়ের পুত্র ও পতিও বটে। তার মৃত্যুতে মায়ের মনে কোনো কষ্ট হয়নি তা নয়, তবে সে যুগে মানুষ অতীতের চেয়ে বর্তমানের কথা বেশি ভাবতে বাধ্য হত। মায়ের এখন দু’জন স্বামী বর্তমান–তার অপর সন্তানের বয়স চৌদ্দ মাত্র, তবে সে অল্পকালেই স্বামী হবে তা কেউ বলতে পারে না। মা চব্বিশ বছরের যুবকটিকে ভালোবাসত বেশি। তাই তিনজন তরুণীর ভাগে পঞ্চাশ বছরের পুরুষটি ছিল।
শীত শেষ হবার আগেই বৃদ্ধা মাতামহী একদিন চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হল। শিশুদের তিনটিকে নেকড়ে বাঘে নিয়ে গেছে আর প্রবীণ লোকটি বরফ গলার সময় তুষারস্রোতে ভেসে গেল। এইভাবে ষোলজনের পরিবারের মাত্র ন’জন বেঁচে রইল।