অবশেষে ইন্দ্র এবং তার দুই গোষ্ঠী, নিম্নমাদ্র ও পুরশুদের ধ্বংশ করার সংকল্প গ্রহণ করল, পুরুহুত স্বয়ং লৌহকারের কাজ শিখেছিল, এবং তার উপদেশ মতো খড়্গ, ভল্ল এবং বাণ-ফলকের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। বলিষ্ঠ এবং কুশলী যোদ্ধাদের শত্রুর আঘাত থেকে রক্ষা করবার জন্য বহু তামার ঢাল তৈরী করিয়েছিল। ইন্দ্র ঠিক করল যে, প্রথমে শুধু এক শত্রুকে আত্রমণ করা হবে, আর সেই আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে পরশুদেরই বেছে নিল সে!শীতের দিনে পরশুরা অধিক সংক্যায় ব্যবসা উপলক্ষে বাইরে চলে যেত। ইন্দ্র এই সময়টাকেই সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে করল। উত্তর মাদ্র এবং পুরুগণ যোদ্ধাবৃন্দকে রণকৌশল শেখাল। যদিও পরশু আর উত্তর মাদ্রদের সঙ্গে শত্রুতা বহুদিন ধরেই চলে আসছিল, কিন্তু তারা বুঝতেই পারেনি যে এমন আচম্কা তাদের ওপর শত্রুর এমন এক ভয়ঙ্কর আক্রমণ আরম্ভ হবে যে বক্ষু উপত্যকা থেকে তাদের নাম পর্যন্ত মুছে যাবে। ইন্দ্র স্বয়ং তার নেতৃত্বে বাছাই করা উত্তর মাদ্র আর পুরু যোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ করল।
যুদ্ধের উদ্দেশ্য বুঝতে পরশুদের দেরী হল না, এবং বুঝবার পর তারা প্রাণপণ বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করল। কিন্তু সেই দ্রুত আক্রমণের মুখে তার সমস্ত পরশু গ্রাম একসঙ্গে যুদ্ধ করতে সক্ষম হল না। ইন্দ্রের সৈন্যরা একের পর এক গ্রাম অধিকার করে হাজার হাজার পরশুকে হত্যা করল—কাউকেই বন্দী করে রাখল না। এদিকে নিচের মাদ্ররা যখন সঙ্কটকে উপলব্ধি করতে পারল, তখন আর সময় নেই। পরশুদের কয়েকটি মাত্র গ্রাম অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল। তাদের জন্য কিছু সৈন্য রেখে পুরুহুত কুরু-ভূমি তে চলে এল। নিম্ন মাদ্ররা পাল্টা আক্রমণ করল, কিন্তু তাদেরও পরশুদের দশা হল। নিম্নমাদ্র এবং পরশুদের যে কোনো লোক-শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ হাতের কাছে এল তাকেই ওরা মেরে ফেলল। স্ত্রীলোকদের আপন স্ত্রীদের সঙ্গে সামিল করে নিল। অধিকৃত দাসদের মধ্যে যারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইল,তাদের ফিরে যেতে দেওয়া হল, কিছু নিম্নমাদ্র এবং পরশু স্ত্রী-পুরুষ প্রাণ বাঁচিয়ে বক্ষু-উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমের দিকে চলে যায়। তাদের বংশধরেরাই পরে পরশু(পাসিয়ান) এবং মাদ্র (মিতিয়ান) নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। এদের পূর্বপুরুষদের ওপর ইন্দ্রের নেতৃত্বে যে অত্যাচার হয়েছিল, তা এরা ভুলতে পারেনি। এই জন্য ইরানীরা ইন্দ্রকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু বলে মনে করে। সমগ্র বক্ষু উপত্যকা উত্তর মাদ্র ও পুরুদের হাতে এসেছিল। বক্ষুর দক্ষিণ এবং বাম তট আপেোষে ভাগ করে নিল এই দুই দল।বক্ষুবাসীগণ প্রাণপনে চেষ্টা করছিল নতুনকে সরিয়ে পুরনো ব্যবস্থা পুন:স্থাপন করবার, কিন্তু এরা তামা ছেড়ে পাথরের হাতিয়ারের প্রত্যাবর্তন ঘটাতে পারেনি। তামার জন্য বক্ষুর পাহাড়ী উপত্যকার বাইরে ব্যবসা বিস্তার করা একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল—বিজয়ী পুরু এবং উত্তর মাদ্রদের। কিন্তু দাসত্বকে তারা কখনোই মেনে নেয়নি, এবঅং বাইরের লোককে কখনও বক্ষু উপত্যকায় স্থায়ী অধিবাসী হয়ে দেয়নি। বহু শতাব্দী পরে যখন ইন্দ্র পুরুহুতকেও লোকে ভুলতে আরম্ভ করল অথবা তাকে দেবতার রুপে কল্পনা করতে লাগল, তখন এতটা বংশবৃদ্ধি হয়ে গেছে যে সকলের ভরণ-পোষণ করতে আর বক্ষু উপত্যকা সক্ষম নয়। এ জন্য তার বহু অধিবাসীকেই বাধ্য হয়ে দক্ষিণের দিকে চলে যেতে হল।
আগে এক গোষ্ঠী অপরের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে থাকত, মহাপিতরের প্রাধাণ্য থাকলেও তার সব কিছুই জনতার ওপর নির্ভর করত। কিন্তু বক্ষুতটের শেষ-সংঘর্ষ একাধিক গোষ্ঠীর এক সেনাপতি ইন্দ্রকে জন্ম দিয়েছিল।’’
০৫. পুরুধান (দেশ : উপরিস্বাত ।। কাল : ২০০০ খৃষ্টপূর্ব)
সুবাস্তর বাঁদিকে সবুজে ঢাকা পর্বতমালা, পাহাড় থেকে আছড়ে-পড়া ঝর্ণার ধার, আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে আন্দোলিত গমের ক্ষেতে সুশোভিত এই অঞ্চল গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে। কিন্তু এই অঞ্চলের আর্যভাষীদের সবচেয়ে বেশি গর্ব ছিল পাথরের দেওয়াল ও পাইন শাখার আচ্ছাদিত গৃহচূড়া নির্মিত নিজেদের বাসস্থান সম্পর্কে। আর এই জন্যই এই প্রদেশের নামও তারা দিয়েছিল সুবাস্তু, অর্থাৎ স্বাতসুন্দর গৃহসজ্জিত প্রদেশ। বক্ষুতট পরিত্যাগ করে আর্যভাষীগণ পারমীর ও হিন্দুকুশের দুর্গমগিরিপথ এবং কুনার ও পঞ্জ-কোরার নদী অতিক্রম করে এসেছিল। অতীতের সেই স্মৃতি সম্ভবত অনেক দিন অম্লান ছিল। মঙ্গলপুরের (মঙ্গলোরের) ইন্দ্র উৎসব হচ্ছে আজ। উৎসবের এই বিরাট প্রস্তুতির কারণও বোধহয় ইন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞান– কারণ আপন ইন্দ্রের পরিচালনায় দুর্গম পার্বত্যপথ তারা একদিন নিরাপদেই অতিক্রম করেছিল।
মঙ্গলপুরের পুরুরা তাদের সুন্দর ঘরগুলি পাইন শাখায় ও রঙ বেরঙের পতাকায় সাজিয়েছিল। পুরুধান তার ঘর সাজাচ্ছিল এক বিশেষ ধরনের রক্ত পতাকা দিয়ে। তা দেখে প্রতিবেশী সুমেধ বলল। ‘‘মিত্র পুরু। তোমার পতাকাগুলো বেশ হালকা ও চিকন দেখছি। আমাদের এখানে তো এ রকম কাপড় বোনা হয় না, এতে বোধহয় অন্য কোনো ধরনের ভেড়ার লোম ব্যবহার করা হয়েছে?’’
‘‘না, এ-তো কোনো ভেড়ার লোমে বোনা হয়নি সুমেধ!’’
‘‘তা’হলে?’’
‘‘এ এক রকমের পশম— গাছে জন্মায়। আমরা ভেড়ার গা থেকে পশম নিয়ে কাপড় বুনি, আর এই পশম জন্মায় জঙ্গলের গাছে।’’
‘‘এ রকম শোনা যায় বটে কিন্তু নিজের চোখে এ ধরনের গাছ কখনও দেখিনি।’’
উরুর ওপর তকলী ঘষে সেটা ঘুরিয়ে দিয়ে ভেড়ার লোমের ফেটি লাগাতে লাগাতে সুমেধ বলল, ‘‘কী ভাগ্যবান তারা, যাদের গাছে এই পশম জন্মায়। আচ্ছা, আমাদের এখানে ওই গাছ লাগানো যায় না?’’
‘‘তা বলতে পারি না। কতটা শীত-তাপ সে গাছ সহ্য করতে পারে তাও জানি না। কিন্তু সুমেধ। মাংস তো আর গাছে জন্মাতে পারে না।’’
‘‘কোনো দেশে যদি গাছে পশম জন্মাতে পারে— কে জানে হয়ত এমন দেশও আছে যেখানে গাছেই খাবার মাংস পাওয়া যায়। যাক্, এ কাপড়ের দাম কত?’’
‘‘পশমী কাপড়ের চেয়ে অনেক কম, তবে টেকে না বেশীদিন।’’
‘‘কোথায় খরিদ করলে?’’
‘‘অসুরদের কাছ থেকে। এখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ দূরে তাদের দেশ, সেখানকার লোকেরা গাছের পশমের কাপড় পরে।’’
‘‘এত সস্তা যখন, তখন আমরাই বা পরি না কেন?’’
‘‘ওই কাপড়ে শীত কাটে না।’’
‘‘তবে অসুররা পরে কি করে?’’
‘‘ওদের দেশে ঠাণ্ডা কম, বরফ পড়েই না।’’
‘‘আচ্ছা পুরু, তুমি কেবল দক্ষিণ দিকেই ব্যবসা করতে যাও কেন?’’
‘‘লাভ বেশী হয়— সেই জন্যেই! আর বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রও পাওয়া যায়। তবে খুব কষ্টও হয়। ওদিকে গরম প্রচণ্ড, একটু ঠাণ্ডা জলের জন্য প্রাণ ছটফট করে।’’
‘‘ওখানকার লোকেরা সব কেমন পুরুধান?’’
‘‘লোকগুলো বেঁটে বেঁটে, রঙ তামাটে। বড়ই কুৎসিত। আর নাক আছে কি নেই সেটা বোঝা যায় না— খুব চেপ্টা ও ভোঁতা। আর সবচেয়ে খারাপ হল যে, সেখানে মানুষ কেনা-বেচা চলে।’’
‘‘কি বললে? মানুষ কেনা-বেচা!’’
‘‘হ্যাঁ, ওরা এই ব্যবসাকে বলে দাস-ব্যবসা।’’
‘‘দাস ও তাদের প্রভুদের মধ্যে কি চেহারার কোনো পার্থক্য আছে?’’
‘‘না। তবে দাসরা খুব গরিব ও পরাধীন— দেহ-মন সবই প্রভুদের অধীনে।’’
‘‘ইন্দ্র রক্ষা করুন, এমন লোকের মুখ যেন দেখতে না হয়।’’
‘‘মিত্র সুমেধ! তোমার তকলী তো ঘুরছেই— যজ্ঞে যাবে না?’’
‘‘যাব না কেন! ইন্দ্রের দয়াতেই তো আমরা নধর পশু আর মধুর সোমরস পাচ্ছি। এমন কোন হতভাগা আছে যে এই ইন্দ্রপূজায় মিলিত হবে না?’’
‘‘তোমার বউটির খবর কি? তাকে তো আজকাল দেখা-ই যায় না!’’
‘‘কেন, তুমি তার প্রেমে মজেছ না-কি, পুরুধান?’’
‘‘মজবার কথা হচ্ছে না। তুমি তো জেনেশুনেই বুড়ো বয়সে তরুণীর সঙ্গে প্রণয়ের জিদ ধরেছিলে!’’
‘‘পঞ্চাশে লোক বুড়ো হয় না।’’
‘‘কিন্তু পঞ্চাশ আর বিশ বছর বয়সের পার্থক্য কত, জান?’’
‘‘বেশ তো, সে তা’হলে তখনই আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেই পারত!’’
‘‘তুমি তখন গোঁফ-দাড়ি মুড়িয়ে চেহারা করেছিলে যেন আঠারো বছরের ছোকরা! আর ঊষার মা-বাপের নজর ছিল তোমার পালিত পশুদের ওপর।’’
‘‘এ সব কথা বন্ধ কর পুরু। তোমরা ছেলেছোকরা তো খালি…।’’
‘‘বেশ, এ সব কথা না হয় বলব না। ওদিকে কিন্তু বাজনা আরম্ভ হয়ে গেছে— উৎসব এ বার শুরু হবে।’’
‘‘দিলে তো এখানে দেরি করিয়ে— বেচারা সুমেধ এখন গাল খাক আর কি।’’
‘‘বেশ তো চল, ঊষাকেও সঙ্গে নেওয়া যাক্।’’
‘‘সে কি এখনো বাড়ি বসে আছে না-কি।’’
‘‘যাক্, এই পশম আর তকলীটা রেখে চল এখন।’’
‘‘আরে, এগুলো সঙ্গে থাকলে যজ্ঞের কিছু অঙ্গহানি হবে না।’’
‘‘এই জন্যেই তো ঊষা তোমায় পছন্দ করে না।’’
‘‘পছন্দ ঠিকই করে— অবশ্য তোমরা মঙ্গলপুরের তরুণরা যদি তাকে পছন্দ করতে না দাও— তা’হলে আমার আর দোষ কি?’’
কথা বলতে বলতে দুই সঙ্গী শহরের সীমা ছাড়িয়ে এগুতে লাগল যজ্ঞ-বেদির দিকে। পথে যে কোনো যুবক বা যুবতীর সঙ্গে পুরুধানের চোখাচোখি হয়— সেই মুচকি হেসে চলে যায় ; পুরুধানও চোখ ঠেরে মাথা ঘুরিয়ে নেয়। এই অবস্থায় একজন তরুণকে সুমেধ পাকড়াও করে বকে উঠল, ‘‘এই তরুণরাই হচ্ছে মঙ্গলপুরের কলঙ্ক।’’
‘‘কি ব্যাপার, মিত্র !’’
‘‘মিত্র-টিত্র নয়, ওরা আমাকে দেখে হাসছে।’’
‘‘আরে, বন্ধু, ও তো বদমাস— তুমিও সেটা জান। ওর কথা ভাবছ কেন?’’
‘‘আমি তো মঙ্গলপুরের কাউকে ভালো দেখি না।’’
যজ্ঞ-বেদির পাশে বিস্তৃত ময়দান—তাতে এখানে-ওখানে মঞ্চ এবং পাইন পাতায় সজ্জিত তোরণ প্রস্তুত হয়েছিল অতিথিদের স্বাগত জানাবার জন্য। গ্রামের বহুসংখ্যক স্ত্রী-পুরুষ বেদির চতুর্দিকে জমায়েত হয়েছিল কিন্তু আসল বড় সমাবেশটা সন্ধ্যার পরই হওয়ার কথা, তখন সারা পুরু-জনের স্ত্রী পুরুষ এই উৎসবে যোগ দেবে— স্বাত নদীর অপর পারের মাদ্র-জনের স্ত্রী-পুরুষেরাও আসবে।
ঊষা দুই বন্ধুকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি তাদের কাছে গিয়ে সুমেধের হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে তরুণী প্রেমিকার মতো চটুল ভঙ্গীতে বলল, ‘‘প্রিয় সুমেধ। সারা সকাল তোমায় খুঁজে খুঁজে আমি প্রায় শেষ হয়ে গেলাম, তবু তোমার পাত্তাই নেই।’’
‘‘কেন, আমি কি মরে ভূত হয়েছিলাম!’’
‘‘এমন কথা মুখে এনো না। বেঁচে থেকে আমাকে বিধবা বানিয়ো না।’’
‘‘পুরু-জনের বিধবাদের ভাবনা কি, দেবরের অভাব নেই।’’
‘‘কেন, সধবাদের কাছে দেবররা কি বিষতুল্য?’’—পুরুধান প্রশ্ন করল।
সুমেধ বলল, ‘‘ঠিক বলেছ পুরু। ও আমাকে শেখাতে এসেছে। নিজে কোন ভোরে বেরিয়েছে—না জানি এর মধ্যে কত ঘর ঘুরে এসেছে। সন্ধ্যার পর এ বলবে আমার সঙ্গে নাচ, ও বলবে— না আমার সঙ্গে। এই নিয়ে বেধে যাবে ঝগড়া, রক্তারক্তি। আর এই বঊ-এর জন্যে বদনাম হবে বেচারা সুমেধের।’’
ঊষা সুমেধের হাত ছেড়ে দিয়ে চাউনি ও কন্ঠের স্বর বদলে চিৎকার করে বলল, ‘‘তুমি কি আমাকে বাক্সে বন্ধ করে রাখতে চাও না-কি? যাও না— রান্না ভাঁড়ারের ভার নাও গে, আমিও নিজের পথ দেখে নিই।’’ যাবার সময় পুরুধানকে একান্তে মুচকি হাসির ইসারা দিয়ে বেদি সংলগ্ন ভিড়ের মধ্যে ঊষা হারিয়ে গেল।