‘‘হ্যাঁ দাদু, মাটিকে মা বলি, দেবী বলি, তাকে পূজাও করি।’’
‘‘আর সেই মায়ের বুক নিজ হাতে চিরে দিয়েছে ওই সব পাপীরা। আরও কি সব করেছে—নাম ভুলে যাচ্ছি, স্মৃতিশক্তি ঠিক কাজ করছে না বাছা।’’
‘‘কৃষি, চাষ।’’
‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কৃষি আর চাষ চালু করেছে ওরা, গম বোনে, ধান বোনে এ সব শোনাই যায়নি আগে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কখনও ধরিত্রী মায়ের বুক চেরেনি, কখনও দেবীর অপমান করেনি। ধরিত্রী মাতা আমাদের পশুকুলের আহারের জন্য ঘাস দিত। জঙ্গলে রকমারী মিষ্টি ফল ছিল, আমরা খেলেও সব ফুরাতো না। কিন্তু এই মাদ্রদের পাপ আর তার দেখা দেখি আমাদের কৃত পাপের ফলে এই এক মানুষ উচু ঘাস আজ কোথায়? আগেকার মতো সেই পুষ্ট গরু, যা দিয়ে একটা গোটা মাদ্র-গোষ্ঠীর একদিনের পর্যাপ্ত আহার হয়ে যেত—তা এখন কোথায়? সেই গরু, সেই ঘোড়া সেই ভেড়া কিছুই নেই। জঙ্গলের হরিন আর ভাল্লুকও এখন আর অত বড় হয় না। মানুষ আর আগের মতো বেশী দিন বাঁচে না। এই সবই ধরিত্রী দেবীর কোপের ফল ছাড়া আর কিছুই নয়।’’
‘‘দাদু, তুমি কতগুলো শীত দেখেছ?’’
‘‘একশ‘র ওপরে বাছা! এক সময়ে আমাদের গাঁয়ে দশটি তাঁবু ছিল, আর এখন মাটি-পাথরের দেয়ালে তৈরী এক‘শ ঘর হয়ে গেছে সেখানে। যখন ক্ষেত ছিল না, তখন আমাদের চলতি ফিরতি ঘর, চলতি-ফিরতি গাঁ হত। কিন্তু যখন ক্ষেত চালু হল, তখন হরিণের মুখ থেকে শস্য রক্ষার জন্যে ক্ষেত মানুষকে বেঁধে রাখবার খুঁটিতে পরিণত হল। কিন্তু বাছা, মানুষ এক জায়গায় বন্দী হয়ে থাকবার জন্য জন্ম নেয়নি। দেবতারা যা মানুষের জন্য সৃষ্টি করেনি, নিম্নমাদ্র আর পরশুরা সে সব তৈরী করছে।’’
‘‘কিন্তু দাদু, আমরা কি এখন ইচ্ছা করলেও এইসব চাষ-আবাদ ছেড়ে দিতে পারি? ধানই যে আমাদের অর্ধেক খাদ্য আজ।’’
‘‘সে কথা স্বীকার করি কিন্তু ধান আমাদের পূর্বপুরুষেরা খেত না; এখান থেকে পঁচিশ ক্রোশ দূরে গমের বন আছে, সেখানে আপনাআপনিই গম জন্মায়। ফসল ধরে তারপর ঝরে যায়, সেগুলো গরুরা খায়, তাদের দুধ বেড়ে যায়। ঘোড়ারা খেয়ে মোটাসোটা হয়ে ওঠে। প্রতি বছর আমাদের পশুরা সব সেখানে যায়। ধরিত্রী মা মানুষের জন্য ধান সৃষ্টি করেনি—তার দানা আমাদের ক্ষেতের গম থেকে ছোট—পশুকুলের জন্যই ওগুলো। আমার ভয় যে, কোনোরকমে এই জংলী গম নষ্ট হয়ে না যায়! আমাদের খাওয়ার জন্য এই সব গরু রয়েছে; ঘোড়া, ভেড়া, ছাগল রয়েছে; জঙ্গলের ভেতর ভাল্লুক, হরিণ, শুয়োর, নানা রকমের শিকার রয়েছে, আঙ্গুর প্রভৃতি কত রকমের ফল রয়েছে। এইসব আহার ধরিত্রী মা আমাদের খুশী মনেই দিত; কিন্তু এই সর্বনাশা নিম্নমাদ্র আর পরশু এরা পুরনো সেতু ভেঙ্গে ফেলে নতুন সড়ক তৈরী করছে। আর তাদের এই পাপ কাজে মানুষের ওপর দেবতার কোপদৃষ্টি পড়েছে। জানি না বাছা এখন বক্ষুবাসীদের ভাগ্যে আর কী কী দূর্দশা লেখা রয়েছে। আমি তো পঁচিশ বছর থেকে পাহাড়ের চূড়ো ছেড়ে গাঁয়ে যাই নি কখনও। শীতের সময় নীচের দিকে ছাউনিতে চলে যাই। যে সব লোক পূর্বপুরুষের বাঁধা সেতুকে ভেঙে ফেলতে চাইছে তাদের মধ্যে কেন যাব! পূর্বপুরুষের মুখনি:সৃত বাণীও আমি এতদিন গোপন রেখেছিলাম, এখনও যার শিখবার দরকার, সে-ই আমার কাছে চলে আসে। কিন্তু সেইসব বাণী অমান্য করে চলবার লোক বেড়েই চলেছে। এখন শুনতে পাচ্ছি মাদ্র-পরশুদের খেতে থেকেও পেট ভরছে না। এখন এরা বক্ষুবাসীদের আহার পরিধান বয়ে নিয়ে কোথায় দিয়ে আসছে, আর তার জায়গায় কি পাওয়া যাচ্ছে?—দ্যাখ একটা ঘোড়ার বিনিময়ে কেনা এই কড়াই। ক্ষুধায় মরতে থাকলে কি এই কড়াইতে পেট ভরবে? এখন পেটের আহার এবং দেহের পোষাকের বদলে তাদের ঘরে ঘরে দেখতে পাবে এইসব কড়াই।’’
‘‘এ ছাড়া আর একটা কথা শুনেছি দাদু, নিম্নমাদ্রদের স্ত্রীলোকেরা না-কি কানে এবং গলায় হলদে আর সাদা গয়না পরতে শুরু করেছে। একটা কানের গহনার দাম না-কি একটা ঘোড়া, ওগুলো তামা নয়, সোনা বলে, আর সাদা-সাদা গুলোকে বলে রুপো।’’
‘‘কেউ মার দেয় না এইসব অধর্মীদের! সারা বক্ষুজনমণ্ডলের সর্বনাশ করে ছাড়বে! আমাদের স্ত্রীরাও ওদের দেখাদেখি দুই ঘোড়ার বিনিময়ে কর্ণকুণ্ডল পড়বে। হে দয়ালু অগ্নি! আর বেশীদিন আমাকে মানুষের মধ্যে রেখনা, পিতৃলোকে নিয়ে চল আমাকে।’’
‘‘আরও একটা গুরুতর পাপ রয়েছে দাদু! নিম্নমাদ্র আর পরশুরা কোনখান থেকে মানুষ ধরে নিয়ে আসে, আর তাদের দিয়ে তামার খাঁড়া, কুড়ুল তৈরী করায়। এরা অত্যান্ত দক্ষ শিল্পী দাদু। কিন্তু নিম্নমাদ্র আর পরশুরা এদের যখন খুশি পশুর মতো বেচে দেয়, আবার দরকার মতো নিজেদের কাছে রাখে। ক্ষেতের কাজ, কম্বল বোনার কাজ, আরও অন্যান্য নানা রকমের কাজ এইসব ধরে আনা লোকদের দিয়ে করায়। এদের দাস বলা হয়।’’
‘‘মানুষ কেনা-বেচা! কিন্তু আমরা তো খাবার, পোষাক বেচাও অন্যায় মনে করতাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা ভাবতেও পারেনি, যে এই মাদ্র কলঙ্ক এত দূর নীচে নেমে যাবে। আঙ্গুলে যদি পচ ধরে তো তার ওষুধ হল তাকে কেটে ফেলা; না হলে সমস্ত শরীরটাই পচে যাবে। এই মাদ্র-পরশুদের বক্ষুতটে থাকতে দেওয়া পাপ বাছা। আমি আর বেশীদিন এ সব দেখবার জন্যে বেঁচে থাকব না।’’
মাদ্র দাদুর কথাবার্তা বড়ই মনোরঞ্জক ছিল, কিন্তু পুরুহুতের এও বোঝবার ক্ষমতা ছিল যে নতুন হাতিয়ার সৃষ্ট হয়েছে,তাকে ত্যাগ করে মানব এবং পশুর শত্রুতার মাঝে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তৃতীয় দিনে যখন পুরুহুত বিদায় নিতে গেলে তখন বৃদ্ধ তার ললাট এবং ভ্রু চুম্বন করে তাকে আর্শীবাদ করল। রোচনা বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল তাকে এবং বিদায়ের মুহুতের্ একে অপরের দুই গণ্ডকে অশ্রুসিক্ত করে দিল।
৩
মাদ্র দাদুর কথাই সত্য প্রমাণিত হল, যদিও তা পঁচিশ বছর পর। নিম্নমাদ্র এবং পরশুরা দিনের পর দিন ওপরের বাসিন্দা পুরু আর উত্তর মাদ্রদের দাবিয়েই চলল। এই ওপরের বাসিন্দা জনগণের মধ্যে কাপড়, কম্বল-বোনা স্ত্রী-পুরুষ সবাই স্বাধীন; এদের খাওয়া পরায় বেশী খরচ লাগে, এবং তার ফলে তাদের হাতে বোনা দ্রব্য সুক্ষ্ম হলেও বেশী দামের হয়, কিন্তু নিচের মাদ্র আর পরশুদের কাছে ক্রীতদাস; যাদের তৈরী জিনিস ভালো না হলেও দামে সস্তা। সেখানকার ব্যবসায়ীরা যখন এইসব জিনিস উট অথবা ঘোড়ার পিঠে বোঝাই করে দেশে দেশে নিয়ে যেত, তখন সেগুলো যথেষ্ট বিক্রী হত। ওপরের বাসিন্দাদের কাছেও এখন তামার জিনিস অধিকতার সংখ্যায় প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। একে তো ওগুলো বছর বছরই সস্তা হয়ে পড়ছিল, দ্বিতীয়ত মাটি-কাঠের জিনিস থেকে ওগুলা দীর্ঘস্থায়ী। পঁচিশ বছর আগে যেখানে তামার কড়াই ব্যবহৃত হয় না। সোনা-রুপার ব্যবহারও অনেক বেড়েছে। আর এই সবের বিনিময়ে জনসাধারণকে তার আহার্য, কম্বল, চামড়া, ঘোড়া অথবা গরু বেচতে হচ্ছে, ফলে তাদের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে পড়ছিল। ওপরের বাসিন্দা কিছু লোক নিজেরাই ব্যবসা করার চেষ্টা করছিল, কেননা তাদের সন্দেহ হচ্ছিল যে, নীচের পড়শীরা তাদের ঠকিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু বক্ষুর নীচে যাবার রাস্তা নীচের অধিবাসীদের আবাসভুমির ভিতর দিয়েই গিয়েছে এবং তারা এ রাস্তার যাতায়াত করতে দিতে চায়নি। এই নিয়ে ছোটো-খাটো ঝগড়াও হয়ে গেছে। অনেক বারই উত্তর-মাদ্র এবং পুরুরা বাইরের দেশসমুহে যাবার অন্য রাস্তা বের করতে চেয়েছে, কিন্ত তাতে তারা সফল হয়নি। ওপরের আর নীচের উপত্যকার মধ্যে এই সংঘর্ষে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, নীচের লোকেরা নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় একতা বজায় পারতা না; ওপরের অধিবাসীরা একতাবদ্ধ হয়ে আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ চালাতে পারত। এইসব যুদ্ধে আপর বীরত্ব এবং বুদ্ধিমত্তার জন্যে পুরুহুত নিজ গোষ্ঠীর প্রিয়পাত্র ছিল, আর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই সে পুরু-গোষ্ঠী কর্তৃক গোষ্ঠী-নেতা নির্বাচিত হয়েছিল। পুরহুত পরিষ্কার বুঝেছিল যে, নিম্ন মাদ্রদের এই অন্যায় ব্যবসা যদি বন্ধ না করা যায় তো উপরবাসীদের কোনো কিছুই আশা নেই আর। তামার ব্যবহার কমে যাবার বদলে দিন দিন বেড়েই চলেছিল। হাতিয়ার, বাসনপত্র বা গয়নাতেই শুধু নয়, লোকে এখন বিনিময়ের কাজেও মাংস বা কম্বল বয়ে নিয়ে যাবার বদলে তামার তলোয়ার বা ছুরি নিয়ে যাওয়াই বেশী পছন্দ করছে। নিজ গোষ্ঠীর বৈঠকে পুরুহুত তাদের দুঃখের কারণ বিশ্লেষণ করে দেখাল যে, তার মূলে রয়েছে নিম্ন মাদ্রদের অন্যায় ব্যবসা। সকলেই এ বিষয়ে একমত হল যে, পথের কাঁটা মাদ্রদের সরিয়ে না দিলে তাদের হাতে খেলার পুতুল হয়ে খাকতে হবে। হয়ত বা এমন দিন আসবে যখন তাদের পরশু ও নিম্নমাদ্রদের দাসে পরিণত হতে হবে—পুরু এবং উত্তর মাদ্রের নেতৃবৃন্দের মিলিত বৈঠক এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হল। দুই গোষ্ঠী সম্মিলত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পুরুহতকে সম্মিলিত বাহিনীর সেনাপতি নির্বাচিত করল এবং তাকে ইন্দ্র উপাধীতে ভূষিত করল। এইভাবে পুরুহুতই প্রথম ইন্দ্র হল। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে পুরুহুত সেনাবাহিনী গঠন করতে লাগল। ইন্দ্র হয়েই সে অস্ত্র নির্মান-ব্যবস্থায়র জন্য দু‘জন দাস লৌহ-কারিগরকে আপনার আশ্রয়ে এনে রাখল। ওপরের বাসিন্দারা তাদের সঙ্গে খুব ভালভাবে কথাবার্তা বলতে লাগল, আর তাদের সহায়তায় নিজেরা লৌহ-শিল্পী হয়ে উঠল। তাদের প্রতিবেশীরা নিজেদের লোহার দাসদের ফিরিয়ে দেবার কথাই শুধু বলল না, লড়াইও করবে বলল। কিন্তু নীচের অধিবাসীদের মধ্যে ব্যবসায়ের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে যোদ্ধা-সুলভ পরাক্রম কমে এসেছিল। লড়াইতে সফল হতে না পেরে তারা তামা দেওয়া বন্ধ করে দিল। কিন্তু শীগগিরই তারা বুঝতে পারল যে এতে করে তাদের ব্যবসা মাটি হয়ে যাচ্ছে। এদিকে উত্তর মা্দ্র আর পুরুরা আগের কেনা কড়াই এবং অন্যান্য বাসনপত্র থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় অন্য এক পুরুষ ধরে সরবরাহ করতে সক্ষম ছিল।