সকালে উঠে পুরুহুত যাবার কথা বলল, কিন্তু প্রপিতামহ তাকে এত তাড়াতাড়ি যেতে দেবে কেন। দুপুরে খাওয়ার পরে বৃদ্ধ নিজের কথা আরম্ভ করলে এবং কথারাম্ভ হল ঝুড়ির পাশে পড়ে থাকা তামার কড়াইকে কেন্দ্র করে। বৃদ্ধ বলল, ‘‘এই তামা এবং ক্ষেতগুলোকে দেখলে আমার সারা অন্তর জ্বলে ওঠে। যখন বক্ষুতটে এইসব জিনিসের আমদানী হয়েছে, তখন থেকে পাপ-অধর্ম ছেয়ে গেছে, দেবতারাও রুষ্ট হয়েছেন, মহামারী বেড়ে গেছে—প্রবল হয়ে উঠেছে হানাহানি।’’
‘‘তা‘হলে কি আগে এ সব জিনিস ছিল না দাদু?’’—পুরুহুত প্রশ্ন করল।
‘‘না বাবা, এইসব জিনিস আমার ছোটবেলাতেই শুরু হয়েছে একটু একটু করে। আমার ঠাকুর্দা তো এ সবের নাম পর্যন্ত শোনেনি, সে সমস্ত কিছুই পাথর, হাড়, শিং কিম্বা, কাঠ থেকে তৈরী হত।’’
‘‘কাঠ কি দিয়ে কাটত দাদু?’’
পাথরের কুড়ুল দিয়ে।’’
‘‘তা‘হলে তো অনেক সময় লাগত, আর এত সুন্দর করে কাটা যেত না নিশ্চয়ই?’’
‘‘এত তাড়াহুড়োর তাগিদই তো সমস্ত কাজ মাটি করেছে, এখন তোমরা ছ‘মাসের খাবার অথবা অর্ধেক জীবন কাটাবার মতো একটা ঘোড়া দিয়ে একখানা তামার কুড়ুল নাও, তারপর জঙ্গলের পর জঙ্গল কেটে উজার কর অথবা গাঁ-এর পর গাঁ কে নিশ্চিহ্ন করে ফেল! কিন্তু গাঁগুলো জঙ্গলের গাছ-গাছালির মতো নিরস্ত্র নয়। তাদের কাছেও অমনি তীক্ষ্ম কুড়ুল রয়েছে। এ তাম্র-কুঠার যুদ্ধকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। এর আঘাতে বিষাক্ত ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আগে তীরের ফলা পাথরে তৈরী হত। এই তামার ফলা দিয়ে দুধের ছেলরা বাঘ শিকার করতে চায়। এখন আর লোকে কুশলী ধনুর্ধর হতে চাইবে কেন?’’
‘‘তোমার একটা কথার সঙ্গে আমি একমত দাদু—মানুষ একজায়গায় থাকবার জন্যে জন্মায়নি।’’
‘‘হ্যাঁ বাছা, প্রথম দিনের ময়লার ওপর রোজ রোজ ময়লা ফেলা খুবই খারাপ।
আমাদের তাঁবু এখানেই রয়েছে। পশুরা এখানকরা ঘাস খেয়ে ফেলবে। এর আশেপাশে মানুষ এবং পশুর মলমূত্র জমে উঠতে থাকবে, আর সেই সময় আমরা এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব—যেখানে নতুন নতুন সবুজ ঘাস প্রচুর মিলবে, জলহাওয়া অনেক বেশী নির্মল হবে।’’
‘‘হ্যা দাদু, আমিও এমনি ভালোবাসি—এই মাটিতেই আমার বাঁশীর সুর আরো মিষ্টি হয়ে ওঠে।’’
‘‘ঠিক বলেছ বাছা! আগে আমরা এই তাঁবুর মেলাকেই গাঁ বলতাম, আর এইসব মেলা এক জায়গায় এক বছর কেন তিন মাসও থাকত না, কিন্তু এখানকার গাঁ পুত্র-পৌত্র এমন কি একশ‘ পুরুষের বলতি হিসাবে তৈরী হচ্ছে। পাথর, কাঠ আর মাটির দেওয়াল তোলা হয়, ফলে ভিতরে হাওয়া ঢুকতে পারে না। অগ্নিকে দেবতা বলা, বায়ুকে দেবতা বলা আজ শুধু মুখের কথায় দাঁড়িয়ে গেছে, আজ আর আমাদের হৃদয়ে তাদের জন্য সেই শ্রদ্ধা-সম্মান নেই। এই জন্যেই এখন বহু নতুন নতুন রোগের উৎপত্তি। হে মিত্র, হে নাসত্য, হে অগ্নি! তুমি যে এই মানবকুলের ওপর ক্রোধ বর্ষণ করছ, তা ঠিকই।’’
‘‘কিন্তু দাদু, এই তামার কুড়ুল, তামার খাঁড়া, তামার শল্য ছাড়া আমরা কি করে বেঁচে থাকব? এ সব ত্যাগ করলে শত্রুরা আমাদের একদিনেই গ্রাস করবে।’’
‘‘আমি স্বীকার করি বাছা, দু‘মাসের আহার অথবা আজীবন কাটাবার মতো ঘোড়া খুশী মনে বেচে লোকে তামার খাঁড়া কেনেনি। ঐ নিম্নমাদ্র এবং পরশুরা বক্ষু মাতার গায়ে কলঙ্গের দাগ লাগিয়েছে। বক্ষু নদী কতদূর পর্যন্ত বয়ে গেছে তা আমি জানি না, মিথ্যাবাদীরা অবশ্য বলে, পৃথিবীর প্রান্তে যে অপার জলরাশি রয়েছে সেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে। এ কথা আমরাও জানি যে, মাদ্র আর পরশুদের দেশ শেষ হতেই বক্ষু নদী পাহাড় ছেড়ে সমতলভূমিতে চলে যায়, আর তারপরেই হল মিথ্যাবাদী। দেবশত্রুদের দেশ। তারা বলে সেখানে না-কি বড় বড় ঠ্যাংওয়ালা ছোটখাটো পাহাড়সদৃশ জন্তু আছে, কি যেন তাদের নাম বাবা?—স্মৃতিশক্তি এখন ক্ষীণ হয়ে আসছে আমার।’’
‘‘উট বলে দাদু। কিন্তু পাহাড়ের মতো উঁচু হয় না। একদিন এক নিম্নমাদ্র উটের বাচ্চা নিয়ে এসেছিল। বলল, ছ‘মাসের বাচ্চা, আকারে সে তো আমাদের ঘোড়ার মতোই ছিল।’’
‘‘হ্যাঁ বাছা, বাইরের দেশ থেকে যারা ঘুরে আসে, তারা বড় বেশী মিথ্যা বলতে শেখে। তারা বলত—কি যেন ওর নাম?’’
‘‘উট।’’
‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ উট। বল তো উটের গলা কি এত লম্বা যে, সে বক্ষুর এপারে দাঁড়িয়ে ওপারের ঘাস খেতে পারে!’’
‘‘এ মিথ্যা কথা, তাই না দাদু?’’
‘‘হ্যাঁ বাবা, সেই বাচ্চার গলা ঘোড়ার থেকে সত্যিই লম্বা ছিল; কিন্তু ঘাস খাওয়ার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা…’’
‘‘এই মিথ্যাবাদী মাদ্র এবং পরশুরাই তামার কুড়ুল, তামার খাঁড়ার জিগীর তুলেছে। পরশুরা আমাদের উত্তর-মাদ্রের ওপর ওইসব অস্ত্র নিয়েই হামলা করেছিল। এ ঘটনা ঘটে আমাদের আমলে। আমাদের লোকেরাও নিম্নমাদ্রদের কাছ থেকে দুটো করে ঘোড়ার বিণিময়ে তামার কুড়ুল কিনেছিল।’’
‘‘তামার কুড়ুল-এর সামনে পাষাণ-কুঠার কিছুই কাজের নয়, তাই না দাদু?’’
‘‘হ্যাঁ, একেবারে কিছুই নয় বাছা! এই জন্যই বাধ্য হয়ে আমাদের তাম্র-অস্ত্র নিতে হয়েছিল। আর যখন পুরুদের ওপর নিম্নমাদ্ররা আক্রমণ চালাল, তখন তোমাদের লোকেরা আমাদের কাছ থেকে তাম্র-অস্ত্র খরিদ করল। উত্তর-মাদ্র এবং পুরুদের মধ্যে কখনও ঝগড়ার খবর শোনা যায়নি কিন্তু পরশু এবং নিম্নমাদ্রেরা সব সময়েই দস্যুবৃত্তি চালিয়ে এসেছে, সর্বদাই পুরনো ধর্মকে ছেড়ে নতুন নতুন কথা বলেছে, আর তারই ফলে আমাদের লোকেদেরও প্রাণরক্ষার জন্য সেই একই ব্যাপার করতে হয়েছে। আমি বুঝি যে, যতক্ষণ পর্যন্ত নিম্নমাদ্র এবং পরশুগণ তামার অস্ত্রপাতি ত্যাগ না করে, ততক্ষণ আমাদের অধিবাসীদের পক্ষে সে সব ত্যাগ করা আত্মহত্যারই সামিল। কিন্তু তামার এতটা প্রসার যে খুবই খারাপ, তাতে কোন সন্দেহ নেই বাছা! আর এই পাপের প্রসারে সাহয্য করছে ঐ দুটো দল—দেবতার আর্শীবাদ এরা কোনোদিনই পাবে না। ঘোর অন্ধকারময় পাতালে প্রবেশ করতে হবে ওদের। ওদের দেখাদেখি, ওদের ভয়ে আমাদের মাটি পাথরের গ্রাম তৈরী করতে হয়েছে। কিন্তু নিম্নমাদ্র আর পরশুরা এই ব্যবস্থা নষ্ট করে দিয়ে এইসব তামার অস্ত্র দিয়ে মাটি মায়ের বুক চিরে দেবার বুদ্ধি কোত্থেকে পেল! এমন পাপ কেউ করেনি। মাটিকে আমরা মা বলি বাছা।’’