‘‘এই বাশী আমার বড়ই প্রিয় রোচনা, আমার প্রাণটাই যেন এই বাঁশীর সঙ্গে বাঁধা।’’
‘‘আমাকে বাঁশী শোনাও পুরুহুত।’’
‘‘এখন না, খাওয়ার পরে।’’
‘‘এখন একটু শোনাও, খাওয়ার পরে আবার শুনব।’’
‘‘আচ্ছা—’বলে পুরুহুত বাঁশীতে ঠোট লাগিয়ে আটটি আঙ্গুল যখন তার ছিদ্রগুলোর ওপর দিয়ে চালাতে শুরু করল, তখন বিশাল বৃক্ষরাজির ছায়া থেকে বেরিয়ে নি:শব্দ পদসঞ্চারী সন্ধ্যার অন্ধকার আর স্তব্ধতার মাঝে দিগন্ত প্রতিধ্বনিত করা মধুর ধ্বনি চারদিকে মায়াজাল বিস্তার করতে লাগল। রোচনা সমস্ত কিছু ভুলে তন্ময় হয়ে শুনতে লাগল সেই ধ্বনি। কোন উর্বশীর বিয়োগব্যথায় ব্যাকুল পুরুরবার বেদনাপূর্ণ গান বাঁশীতে বাজিয়ে চলেছিল পুরুহুত! গান শেষ হয়ে গেলে রোচনার মনে হল,যেন স্বর্গ থেকে সোজা ধরণীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে।
আনন্দাশ্রু পূর্ণ চোখে সে বলল, ‘‘তোমার বাঁশীর গান বড় মধুর পুরুহুত, বড়ই মধুর। আমি এমন বাঁশী কখনও শুনিনি। কি সুন্দর এই সুর!’’
‘‘লোকে এই কথাই বলে রোচনা, কিন্তু আমি বুঝতে পারি না। বাঁশীতে ঠোট লাগানো মাত্রই আমি সব ভুলে যাই। এই বাঁশী যতক্ষণ আমার কাছে থাকে ততক্ষণ পৃথিবীর কোন কোনো কিছুই আমি চাই না।’’
‘‘আচ্ছা—এস পুরু, নইলে মাংস জুড়িয়ে যাবে।’’
‘‘রোচনা, আমি যখন রওনা হই, তখন মা এই দ্রক্ষাসুরা দিয়েছিলেন, অল্পই আছে। মাংসের সঙ্গে পান করলে বেশ লাগবে।’’
‘‘সুরা েতোমর খুব প্রিয়, পুরু?’’
‘‘প্রিয় বলা যায় না রোচনা। প্রিয় জিনিসে অরুচি হয় না। কিন্তু আমার চোখদুটো একটু লাল হয়ে উঠলেই আর এক ঢোকও পান করতে পারি না।’’
‘‘আমারও ঠিক এমনি মনে হয় পুরু। নেশায় চুর লোক দেখলে আমার বড় ঘৃণা হয়।’’—বলতে বলতে রোচনা নিজের কাঠের পেয়ালা বের করে নীচে রাখল।
তিনভাগের একভাগ মাংস কুকুরকে দেওয়া হয়েছিল। ওরা দু‘জন অনেক দেরীতে পানাহার শেষ করল। চারিদিকে ঘন অন্ধকারের আস্তরণ ছড়িয়ে পড়েছে। মোটা কাঠের গনগনে আগুনের লাল আভা আর তার আশেপাশের কিছু জায়গা ছাড়া আর কিছুই সেখানে দেখা যাচ্ছিল না। তবে কিছু আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল—মনে হয় পোকামাকড়ের ডাক। গল্প-গুজব এবং মাঝে মাঝে বাঁশী বাজানো চলতে লাগল। শেষ কয়েকঘণ্টার মধ্যে ছাতু দিয়ে মাংসের সুপ তৈরী হয়ে গেল। দু‘জনেই নিজ নিজ পেয়ালা নিয়ে গরম গরম সুপ পান করল। অনেক রাত হয়ে গেলে ওরা ঠিক করল ঘুমোবে। চামড়ার বিছানা তৈরী করে রোচনা নিজের পরিচ্ছদ খুলতে লাগল। পুরুহুত আগুনের ওপর আরও কাঠ সাজিয়ে দিল, পশুগুলোর সামনে ঘাস এগিয়ে দিল, তারপর বনদেবতার কাছে প্রার্থনা শেষ করে পরিচ্ছদ খুলে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে উঠে দু‘জনেই অনুভব করল যেন একরাত্রীর ভিতরে দু‘জনের মধ্যে সহোদর ভাই-বোনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেছে। রোচনা উঠবার পর পুরুহুত নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। বলল, ‘‘তোমার মুখে আমার চুমু দিতে ইচ্ছা করছে, রোচনা বোন!’’
‘‘আমারও, পুরু! এ জগতে আমরা পরস্পর ভাইবোন।’’
রোচনা বিম্রস্ত এলোচুলের রাশি পিছনের দিকে সরিয়ে দিয়ে পুরুহুত তার গাল-দুটোতে চুমু দিল, দু‘জনের মুখমণ্ডল প্রসন্ন হয়ে উঠল এবং চোখ জলে ভরে এল। তারপর মুখ ধুয়ে সামান্য ছাতু এবং শুকনো মাংস খেয়ে পশুগুলোর পিঠে বোঝা চাপিয়ে তারা যাত্রা করল। কথাবার্তায় সময় এত তাড়াতাড়ি কেটে গিয়েছিল যে তারা বুঝতেই পারেনি কখন ওপরে এসে পৌচেছে।
রোচনা মাদ্র প্রপিতামহের কাছে পুরুহুতের পরিচয় দিলে সে পুরুদের বীরত্বের প্রশংসা করতে করতে তাকে অর্ভ্যথনা করল।
২
এই গিরিপথে মাদ্রদের একটি ছোট গ্রাম। সমস্ত ঘরই তাঁবু অথবা খড়ের ছাউনি। নীচের দিকে ঢালু এবং খাড়া পাহাড়ের ওপর কেবল ঘন পাইনের জঙ্গল কিন্তু এই পর্বতচুড়ায় বৃক্ষের চিহ্নমাত্র নেই। এখানে ভূমি সমতল, ওপরে সবুজ ঘাসের পুরু গালিচা বিস্তৃত। এই সবুজভূমির কোথাও ভেড়া, কোথাও বা ঘোড়ার দল চরে বেড়াচ্ছিল। এদেরই মধ্যে কোথাও কোথাও এদেরই ছোট ছোট বাচ্চারাও লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করছিল। এই সমতল ভূমিকেই দেখে মাদ্রবাবা বলেছিলেন, ‘মানুষ এক জায়গায় বন্দী হয়ে থাকবার জন্য জন্মলাভ করেনি।’ মাদ্রবাবার তাঁবু এখানেই পড়েছে এ মাসে। ঘাস কমে গেলে অন্য কোথাও চলে যাবে। এখানে দুধ, দই মাখন এবং মাংসের প্রাচুর্য। তাবুর ভেতরে এইসব জিনিসই রয়েছে। পনেরো বিশ দিন অন্তর গ্রাম থেকে লোক এসে এখান থেকে মাখন ও মাংস নিয়ে যায়। শীতের দিনে এই পাহাড়ের চূড়ায় বরফ পড়তে থাকে। প্রপিতামহ পারলে এখানেই থেকে যেত কিন্তু বরফ খেয়ে থাকতে পারে না, এ জন্য তাকে আঁকা-বাঁকা রাস্তা ধরে কিছুটা নিচে চলে আসতে হয়। আর পশুরা চলে যায় নীচের গ্রামে। বৃদ্ধকে কিন্তু গ্রামে যাওয়ার কথা বললেই তেড়ে মারতে আসে।বেলা থাকতেই দুই পথিক তাঁবুতে পৌচেছিল। জিনিসপত্র নামিয়ে নেবার পর বৃদ্ধ সফেন ঘোড়ার দুধে ভরা কাষ্ঠ পেয়ালা তাদের সামনে রাখল, তিন-চার পেয়ালাতেই পথের ক্লান্তি দূর হল। সন্ধ্যার সময় রোচনার ভাই-বোন এবং গাঁয়ের অন্যান্য তরুণ রাখালরা ঘোড়া, গরু, বাছুর নিয়ে এসে পড়ল। এদিকে রোচনা তার সেই বুড়ো প্রপিতামহের কাছে পুরুহুতের বাঁশীর প্রশংসা করছিল। তার মতো গম্ভীর লোকও পুরুহুত কে ছাড়তে রাজী নয়। সে এবং গোষ্ঠীর সমস্ত তরুণই বাঁশী অত্যন্ত ভালোবাসে। রাত্রে যখন নৃত্যানুষ্ঠান চলল, পুরুহুতও তখন বাঁশীর যাদু দেখিয়ে দিল।