‘‘তা ছাড়া আমরা এখন দু‘জন পুরুহুত,কাজেই আমাদের সামনে আসবার মতো সাহস চিতাবাঘের হবে না।’’
‘‘আর আমার কুকুরও তো রয়েছে, রোচনা ।’’
‘‘কুকুর!’’
‘‘হ্যাঁ, আমার এই লাল শিকারী কুকুর।’’
কুকুরটাকে ডাকতেই সে দাঁড়িয়ে তার প্রভুর হাত চাটতে লাগল। রোচনাও আদর করে ডাকল তাকে। সে এসে তার গা শুঁকতে লাগল, তারপর রোচনা যখন তার পিঠে হাত দিল তখন লেজ নাড়তে নাড়তে সে তার পায়ের ওপর বসে পড়ল। পুরুহুত বলল, ‘‘ও খুব বুদ্ধিমান, রোচনা।’’
‘‘খুব বলিষ্ঠও বটে।’’
‘‘হ্যাঁ, ভাল্লুক, নেকড়ে, চিতা কাউকেই ভয় করে না।’’
ভেড়া এবং গাধাগুলো এতক্ষণে প্রচুর ঘাস খেয়েছে, ক্লান্তিও দূর হয়ে গেছে, তাই দুই পথিক আবার পথ চলা শুরু করল। কুকুরটা পিছন পিছন চলল। চলার পথ যদিও এঁকে-বেঁকে তেরছাভাবে ওপরে উঠেছে, তবুও চড়াই অত্যন্ত কঠিন ছিল, এ জন্য অত্যন্ত সাবধানে ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে চলছিল তারা। পুরুহুত কখনও সরস লাল স্ট্রবেরী ফল, কখনও বা করমচা ফল ছিঁড়ছিল এবং রোচনাকেও তার ভাগ দিচ্ছিল। ভালো ভালো ফলগুলো এখনও তেমন পাকেনি, পুরুহুতকে তাই কিছুটা নিরাশ হতে হচ্ছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা এমনি আলাপ করতে করতে ওপরে উঠল। ঘন গুল্মরাজির নীচ দিয়ে কল-কল স্বরে ধাবিত এক ঝর্ণাধারা তাদের নজরে এল, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পাশেই একটুখানি খোলা জায়গা, সেখানে পড়ে রয়েছে আধপোড়া কাঠের গুঁড়ি আর ছাই। খুব খুশী হয়ে বলল, ‘‘রোচনা রাতের বিশ্রামের জন্য এর থেকে ভালো জায়গা সামনে আর পাওয়া যাবে না। কাছেই জল রয়েছে, আর প্রচুর ঘাস এবং শুকনো কাঠ। এ ছাড়াও সকালে এখান থেকে যে সব পথিক রওনা হয়েছে, তারা ছাই চাপা দিয়ে আগুনও রেখে গেছে।’’
‘‘হ্যা পুরুহুত, এর চেয়ে ভালো জায়গা পাওয়া যাবে না। আজ এখানেই থাকা যাক। পরের ঝর্ণা পর্যন্ত পৌছাতে অন্ধকার হয়ে যাবে।’’
পুরুহুত বসে পরে তাড়াতাড়ি নিজের ঝুড়িটা নীচে নামিয়ে পাথরের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখল, তারপর রোচনার ঝুড়িটা নামাল। দু‘জনে মিলে গাধাগুলোর পিঠ থেকে বোঝা নামাল এবং তাদের জিন্খুলে দিল। গাধাগুলো দু‘তিনবার গড়াগড়ি খেয়ে চরতে চলে গেল। ভেড়ার বোঝা নামাতে কিছু দেরী হল, কারণ তাদের জোর করে ধরে আনতে হচ্ছিল। মশক হাতে রোচনা ঝর্ণার জল ভরতে গেল। পুরুহুত পাতা এবং কাঠের টুকরো দিয়ে আগুল জ্বালাল, তারপর বড় বড় কাঠের খণ্ড দিয়ে বড় রকমের অগ্নিকুণ্ড তৈরী করল। রোচনা যখন জল নিয়ে ফিরল, তখন পুরুহুত এক তামার পাত্র সামনে রেখে গরুর একখণ্ড পা ছুরি দিয়ে কাটছে। রোচনাকে দেখে সে বলল, ‘‘কাল সন্ধ্যায়র মধ্যে আমরা ওপরে পৌছে যাব রোচনা। তোমার গোষ্ঠ তো তবে আর বেশী দুর হবে না?’’
‘‘এই পাহাড়ের মাথায় আমরা যেখানে পৌছাই, সেখান থেকে তিন ক্রোশ পূবে।’’
‘‘আর আমার ছ‘ক্রোশ পুবে। তা‘হলে তো তোমর প্রপিতামহের গোষ্ঠ আমার যাবার পথেই পড়বে। ‘’
‘‘তুমিও তবে তাকে দেখতে পাবে। তার সঙ্গে কি করে তোমার দেখা হবে এইটেই ভাবছিলাম।’’
‘‘আর তো মাত্র এক দিন আছে, সিকি ঠ্যাং-ই যথেষ্ট একদিনের জন্যে।’’
‘‘আমার কাছেও বাছুরের আধখানা ঠ্যাং আছে। আজকাল মাংস বেশীদিন রেখে দিলে দুর্গন্ধ হয়।’’
‘‘নুন দিয়ে মাংস রাধলে কি রকম হবে?’’
‘‘খুব ভালো হবে। আর আমার কাছে গুড়ের রসও রয়েছে, পুরুহুত। মাংস, গুড়ের রস আর শেষে কিছুটা ছাতু মিশিয়ে দিলেই চমৎকার সুপ তৈরী হবে। শুতে যাবার আগেই সুপ খাব আমরা।’’
‘‘আমি একলা হলে সুপ বানাতাম না রোচনা, বড় সময় লাগে ওতে। কিন্তু এখন সেই সময়টা আমি পশুগুলোকে বাঁধতে এবং কথাবার্তা বলেই কাটিয়ে দেব।’’
‘‘প্রপিতামহ আমার রান্না সুপ বড়ই পছন্দ করেন, পুরুহুত। তোমার এ তামার কড়াই কি সুন্দর!’’
‘‘হ্যাঁ, তামার, কিন্তু অনেক দাম রোচনা। এই কড়াই-এর পিছনে একটা ঘোড়ার দাম খরচ হয়েছে; কিন্তু রাস্তায় বেশ কাজে আসে এগুলো।’’
‘‘তোমার ঘরে নিশ্চয়ই তা‘হলে অনেক পশু আাছে পুরুহুত?’’
‘‘হ্যাঁ রোচনা, ধানও আছে। এইজন্যই তো এক ঘোড়ার মুল্যের এই কড়াই। আচ্ছা নাও এইবারে মাংস কাটা আমার শেষ হয়ে গেছে। জল আর নুন দিয়ে মাংস আগুনে চড়িয়ে দাও, আর আমি ওই দিকটাতেও কাঠের আগুন তৈরী করি। তারপর কিছু ঘাস কেটে আমাদের গাধা আর ভেড়াগুলোকে তার মাঝখানে বাঁধতে হবে। জান তো আমাদের কাছে বাছুরের মাংস যেমন লাগে, চিতার কাছে গাধার মাংস তার চেয়ে মিষ্টি।’’ তার কুকুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘আয় তুইও ততক্ষণ এটা চাটতে থাক।’’ কিছুটা মাংসসুদ্ধ একটা হাড় কুকুরের সামনে ছুঁড়ে দিল পুরুহুত। কুকুরটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে পায়ের নীচে হাড়ের টুকরো চেপে দাঁত দিয়ে ভাঙবার চেষ্টা করতে লাগল।
পুরুহুত ওপরের গাত্রবাস এবং কোমরবন্ধনী খুলে ফেলল। হাতাবিহীন জামার নীচে তার প্রশস্ত বক্ষ এবং পেশীবহুল বাহুযুগল জানিয়ে দিতে চায় এই বিশ বছর বয়স্ক তরুণের দেহে অপরিসীম শক্তি। কাজ করবার সময় পুরুহুতের লোমরাজি কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।ঝুড়ির ভেতর থেকে কোদাল বের করে এক লহমায় একগাদা ঘাস সংগ্রহ করে ফেলল। তারপর কাণ ধরে গাধাগুলোকে নিয়ে এসে খুঁটো গেড়ে বাঁধল এবং তাদের সামনে ঘাস ছড়িয়ে দিল। ভেড়াগুলোর ব্যবস্থা একই হল।
কাজ শেষ করে পুরুহুতও আগুনের কাছে এসে বসল্ কড়াই থেকে সিদ্ধ মাংসখণ্ড তুলে চামড়ার ওপরে রাখতে যাচ্ছিল রোচনা। পুরুহুত ঝুড়ির ভিতর থেকে এক টুকরো চামড়া বের করে বিছিয়ে দিল। তারপর কাঠের এক সুন্দর চষক এবং পেটের চামড়ায় তৈরী বোতল বের করে রাখল, সেই সঙ্গে বাঁশীটাও মাটিতে পড়ে গেল। যেন কোনো কোমল শিশু মাটিতে পড়ে গেছে এবং ব্যথা লাগবার ভয়ে তার মা কেঁপে উঠছে—এমনিভাবে তাড়াতাড়ি বাঁশীটাকে তুলে কাপড়ে মুছল। তারপর তাকে চুমু খেয়ে ঝুড়ির ভিতর রাখতে গেল। রোচনা চেয়ে চেয়ে দেখছিল। সে বলে উঠল, ‘‘পুরুহুত, তুমি বাঁশী বাজাতে পার?’’